| বৃহস্পতিবার, ০২ মার্চ ২০২৩
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কট দেশটির সরকার পতনসহ দেশে বিপর্যস্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, গত ৭৫ বছর থেকে রাজনৈতিক সঙ্কট, সন্ত্রাস, আফগানিস্তানের শরণার্থীর বোঝা ও তাদের হয়ে প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার স্থায়ী সমস্যার পর দেশটির অর্থনৈতিক সঙ্কট এখন এমন এক পরিস্থিতিতে পৌছেছে যে সঙ্কট কাটাতে কোনো পদক্ষেপই আর সুফল বয়ে আনতে পারছে না। চরম ডলার সঙ্কটে পড়া বাংলাদেশও কি শ্রীল্কংা ও পাকিস্তানের মতো একই পরিণতির দিকে যাচ্ছে? সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের শনৈ শনৈ বৃদ্ধির অহঙ্কার করে আসছিল, সে অহঙ্কারের কণ্ঠ চুপসে এসেছে।
জোর গলায় কথা বলার অভ্যাসেও ভাটা পড়েছে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রীদের। এখন অর্থনীতিবিদরাও সন্দিহান যে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের যে হিসাব দেখাচ্ছে তা আদৌ সত্য কিনা। কারণ সরকারকে বৈদেশিক মুদ্রায় যে ব্যয় করতে হয়, তার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের কোনো মিল খুঁজে পান না অর্থনীতিবিদরা। গত বছর বাংলাদেশের আমদানি বিল ৮২.৪৯ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৬ শতাংশ বেশি। ডলার পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না? ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল আমদানির জন্য আমরা এলসি খুলতে পারছে না।’
ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারকদের পেছনে ব্যাংক ঘোরে-এখন তারাও আমদানির জন্য ডলারের সংস্থান করতে হিমশিম খাচ্ছে। ডলারের সংস্থান করতে পারছে না বলে শতভাগ আমদানিমুখী ব্যবসাগুলো বিপর্যয়ের মুখে। এতে তাদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বাংলাদেশ ব্যাংককে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে বলায় ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন যে, আগামী কয়েক মাসেও এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
এর অর্থ হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ করতে পারবে না। বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক সূচকগুলো-যেমন মাথাপিছু আয়, আনুপাতিক জিডিপি ও তুলনীয় আমদানি-রপ্তানি-প্রায় একই। তারপরও ভারত তাদের আর্থিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের তুলনায় ভালোভাবে সামলাচ্ছে। পরিস্থিতি পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক ভালো হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন এই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে? চলমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনার বেশ কিছু দুর্বলতা প্রকাশ্যে এনেছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পেয়েছে, এছাড়া ছয় মাসে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার মান হারিয়েছে ২০ শতাংশের বেশি। এর ফলে ডলার সংগ্রহে হিমশিম খাচ্ছে যেসব ব্যবসা ও আমদানিকারক, তারা সংকটে পড়েছে।
বাংলাদেশের আর্থিক সংকটের অন্যতম কারণ হলো দেশের অতিরিক্ত আমদানিনির্ভরতা এবং স্থানীয় পর্যায়ে কাঁচামাল ও পণ্য উৎপাদন না হওয়া। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ পড়েছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পণ্যমূল্য অনেক বেড়ে যায়। ব্যাংকারদের মতে, কয়েক মাস আগে খোলা এলসিগুলোর বিপরীতে অর্থপ্রদানের বাধ্যবাধকতার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর এখনও চাপ আছে। বাংলাদেশের বর্তমান সংকট ডলারের জন্য, টাকার জন্য নয়।
যেসব আমদানিকারক শতভাগ এলসি মার্জিন দিয়েই আমদানি করতে প্রস্তুত তারাও ব্যাংক থেকে ডলার পাচ্ছে না। সংকটের সময় মুদ্রার বিনিময় হার ঠিক করা দেশটির জন্য একটু সহজ হতো, কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার পরিস্থিতি অনুসারে বিভিন্ন মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয় করতে পারত।
বাংলাদেশ এক সময়ে ভাসমান বিনিময় হার চালু করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময়ই এ বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে বলে তা কখনোই বাজারভিত্তিক ছিল না। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করার কিছু সুবিধা আছে-যেমন প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা অর্জন, স্থিতিশীলতা ও মুদ্রানীতিকে সহায়তা দেওয়া। তবে বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস ও অদক্ষতাসহ বেশ কিছু গুরুতর সমস্যাও তৈরি হতে পারে।
বিশ্লেষক ও ব্যাংকাররা অনেকদিন ধরেই বলে আসছেন, বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত তাদের কথায় কান দেয়নি। এরপর গত আগস্টে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুঝতে পারে, বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য তারা রিজার্ভ থেকে পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে আশঙ্কা ঘনীভূত হয়েছে যে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের পরিণতির দিকেই ধাবমান হচ্ছে।
Posted ৭:৩৬ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০২ মার্চ ২০২৩
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh