সম্পাদকীয় | বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০
মহান বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর। এটা আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। ১৯৭১ সালের এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আসে। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্যমুক্ত ও শোষণমুক্ত স্বদেশ, যে বাংলাদেশ হবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমুন্নত। মানুষ পাবে তার সার্বজনীন মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার স্বাধীনতা। নাগরিকরা পাবে নিজেদের অবস্থান উত্তরণের সুযোগ। বিপুল মানুষের আত্মত্যাগে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হতে আর মাত্র এক বছর বাকি।
২০২১ সালেই আমরা পালন করব স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এই দীর্ঘ সময়ে বিশ্বের বুকে দেশটির অবস্থান কোথায়, সেটি মূল্যায়নের সময় এসেছে এখন। প্রায় পাঁচ দশকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক খাতে দৃষ্টিকাড়া পরিবর্তন ঘটেছে। উন্নয়নের কিছু সূচক বৈশ্বিক প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে বৈষম্য হ্রাস করে একটি সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্র অর্জনের ক্ষেত্রে আমরা এখনো কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছতে পারিনি। দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এসেছে বটে। গ্রাম-শহরে উন্নয়ন দেখার মতো। দেশে বড় বড় শহরে গড়ে উঠেছে আকাশচুম্বি ভবন। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার উন্নয়ন রীতিমতো চোখ ধাঁধানো। কিন্তু গ্রাম-শহরে জীবনযাত্রার ফারাকও অনস্বীকার্য। বাইরের এমন চাকচিক্য দেখে মনে হতে পারে, বাংলাদেশ একটি ধনী দেশ না হোক মধ্যম মানের দেশে পরিণত হয়েছে। বাস্তবে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। এই ব্যবধান ঘোচানোর রাষ্ট্রীয় তেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। দেশে এখনো রয়েছে দারিদ্র্য। রয়েছে অনাহারী মানুষ। অর্থনীতির আকার বেড়েছে, কিন্তু সেটি সব মানুষের জন্য সমান সুযোগ আনতে পারেনি। এর বদলে বড় বড় দুর্নীতি অনেক বেড়েছে। মনে হয়, অর্থনৈতিক বৈষম্য অমোচনীয়। যার প্রমাণ মেলে দেশী-বিদেশী জরিপের ফলাফলে। তাতে দেখা যাচ্ছে, দেশের বেশির ভাগ সম্পদ গুটিকয় ব্যক্তি বা পরিবারের হাতে কুক্ষিগত। অথচ আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষ্য ছিল বৈষম্যহীন একটি সমাজ কায়েম। দেশে টেকসই গণতন্ত্রের অভাবে এই পরিস্থিতির উদ্ভব বলে মনে করা হয়।
রাজনীতি ও প্রশাসনে গণতন্ত্রচর্চায় আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। বিশেষত রাজনৈতিক বিভাজন এখন প্রকট। সব মত-পথের মানুষের জন্য সমান ব্যবস্থা করা যায়নি। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে পারছে না। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকশিত হয়ে ওঠেনি। মানবাধিকার নিয়ে তীব্র সমালোচনা বিদ্যমান। জনগণ সেবা গ্রহণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ অবস্থান পাচ্ছেন না। তবে নাগরিকদের সচেতনতা আগের চেয়ে বেড়েছে। জনগণ তাদের অধিকার নিয়ে আরো সোচ্চার হলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও তাদের পক্ষে অবস্থান নেয়ার সুযোগ হবে, আশা করা যায়।
স্বাধীনতাকামী মানুষ একটি চেতনা নিয়ে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আজ সেই চেতনাকে স্মরণের প্রয়োজন রয়েছে। আমরা দেখেছি, প্রায় একই সময় পাড়ি দিয়ে অনেক দেশই উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। নির্মাণ করেছে একটি বিকশিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। সমৃদ্ধ একটি দেশ প্রতিষ্ঠা আমাদের পক্ষেও সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কাগজ-কলমে আটকে না রেখে, সেটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে তা করা যেতে পারে। সে জন্য দরকার জাতীয় ঐকমত্য। ভেঙে ফেলতে হবে বিভেদের সব দেয়াল। তৈরি করতে হবে সাম্য। এ কথা বলা যায়, টেকসই গণতন্ত্র ও উন্নয়ন সমান্তরালে চললে আমরা যে লক্ষ্যে দেশ স্বাধীন করেছি; সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব নয়।
মুক্তিযুদ্ধের অনেক প্রত্যাশাই আমরা এখনো পূরণ করতে পারিনি। এ আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা। এ দুর্বলতা থেকে জাতির উত্তরণ ঘটাতেই হবে। এ জন্য প্রয়োজন সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য, ঠিক যেভাবে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিলাম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে আমরা আবারো জাতীয় জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারি কাক্সিক্ষত জাতীয় ঐক্য। আমাদের হাঁটতে হবে জাতীয় সমঝোতা, সম্প্রীতি ও ঐক্যের মহাসড়কে। কারণ মহান এই বিজয় দিবসে অনন্য সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ সবারই কামনা।
Posted ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh