এজেডএম সাজ্জাদ হোসেন | শুক্রবার, ২৪ জুন ২০২২
আগামী ২৫ জুন বাঙালি জাতির জন্য আরেকটি ঐতিহাসিক ও স্মরণীয় দিন হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান পেতে যাচ্ছে। যতদিন বাঙালি জাতি বিশ্বের বুকে বেঁচে থাকবে, ততদিন এই দিনটির কথা সোনার অক্ষরে জ্বলজ্বল হয়ে থাকবে। জাতির দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে ওই দিন। বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ এই মাহেন্দ্রক্ষণের স্বাক্ষী হতে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে বসবাসরত বাঙালিরাও এই ঐতিহাসিক দিনটির জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা এক জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ওই দিন সকালে বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা নদী পদ্মার ওপর নির্মিত ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নান্দনিক সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন। এর পরের দিন সকাল ৬টা থেকে সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে ও দূর হতে চলেছে যাতায়াতের ক্ষেত্রে তাদের দীর্ঘদিনের সীমাহীন দুর্ভোগ ও দূর্দশার।
উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়া প্রান্তে সকাল ১০টায় সুধীসমাবেশে অংশ নেবেন। এরপর তিনি টোল দেবেন এবং সেতুর ফলক উন্মোচন করবেন। পরে তিনি গাড়িতে সেতু পাড়ি দিয়ে জাজিরা প্রান্তে আরেকটি ফলক উন্মোচন করবেন। এরপর বিকেলে তিনি মাদারীপুরের শিবচরে বিশাল জনসভায় বক্তব্য রাখবেন। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। শিবচরের জনসভায় ১০ লাখ লোকের জমায়েত করার পরিকল্পনা নিয়েছে আওয়ামী লীগ। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে বসবাসরত বাঙালীরাও এই উপলক্ষে আনন্দ সমাবেশসহ অন্যান্য কর্মসূচি পালন করবে।
নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এই পদ্মা সেতু বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্বে ৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের সবচেয়ে বৃহৎ অর্জন বললে অত্যুক্তি হবে না। এই অর্জন এসেছে জাতির জনকের তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। পদ্মা সেতু আমাদের অহংকার, এটা আমাদের গৌরব ও আত্ম-মর্যাদার প্রতীক। বিশ্বব্যাংক কথিত ‘দূর্নীতির ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ তুলে ২০১২ সালে পদ্মাসেতুর অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ালে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরবর্তীতে নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মানের এক সাহসী ঘোষণা দেন। দেশ-বিদেশের অনেক খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতিবিদ যখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেন তখন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং বিদেশী অর্থায়ন ছাড়াই এই দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নে অবিচল থাকেন।
সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ও সন্দেহকে অমূলক প্রমাণ করে পদ্মা সেতু আজ বাস্তবতা। দেশী-বিদেশী সকল ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্ব এবং ইস্পাত কঠিন সংকল্প ও মনোবলের কারনে এটা সম্ভব হয়েছে। ৭১’-এ বঙ্গবন্ধুর মতো তিনি আবার প্রমান করেছেন বাঙালি বীরের জাতিও এ জাতি কোন দেশ, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান অথবা ষড়যন্ত্রের কাছে কখনো মাথানত করে না বা চোখ রাঙানিকে ভয় পায় না। যা তিনি শিখেছেন তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছ থেকে। পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসের সোনালী ফসল, যা বাংলাদেশের সামর্থ ও সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। তিনি সেতুটি নির্মাণ করে সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন, এমন একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা ও সামর্থ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত সফলতার সাথে কাজ সম্পন্ন করে দেশের ও প্রবাসের কোটি কোটি বাঙালির দীর্ঘ প্রতিক্ষিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। গর্বিত বাঙালি জাতি দেশের জন্য তার এই অসামান্য অবদানকে চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে পদ্মা সেতু দেশের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনবে এবং এর ফলে দেশের জিডিপি কমপক্ষে ১.৫ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। তারা মনে করেন পদ্মা বহুমূখী সেতু দেশের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের সাথে রাজধানীসহ অন্যান্য অঞ্চলের সরাসরি যোগযোগ স্থাপনের পাশাপাশি দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপটকে পাল্টে দেবে। ২৫ জুন পদ্মাসেতুর উদ্বোধনের পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত মোংলা ও পায়রা বন্দরের মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য আরো বাড়বে বলে সংশ্লিষ্ট সকলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশকে সংযুক্ত করবে এবং যোগাযোগ, বাণিজ্য, শিল্প ও পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে ব্যাপক অবদান রাখবে।
পদ্মা বহুমুখী সেতু বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত। কংক্রিট ও স্টিলের কাঠামো দিয়ে নির্মিত দ্বি-স্তর বিশিষ্ট পদ্মা সেতুতে উপরের স্তরে একটি চার লেনের মহাসড়ক এবং নীচের স্তরে একটি একক ট্র্যাক রেলপথ রয়েছে। ৬.১৫০ কিলোমিটার (৩.৮২১ মাইল) দীর্ঘ এবং ২২.৫ মিটার (৭৪ ফুট) প্রস্থসহ সেতুটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু, এবং এটি গঙ্গার উপর সবচেয়ে দীর্ঘতম সেতু। এর মোট স্প্যান ও পিলারের সংখ্যা ৪২ ও ৪১। এই সেতুর পাইলের সর্বোচ্চ গভীরতা ১২২ মিটার, যা অন্য সব সেতুর মধ্যে সর্বোচ্চ। মূল সেতু নির্মাণ করেছে চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন, নদী শাসন কাজের জন্য চীনের সিনোহাইড্রো কর্পোরেশনএবং দুটি অ্যাপ্রোচ রোড ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেডকে নিযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বুয়েট এবং কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে কর্পোরেশন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস ব্রিজ নির্মাণের তদারকি করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মুল সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। তার আগে ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী জাজিরা ও মাওয়া পয়েন্টে এ্যাপ্রোচ রোড ও সার্ভিস এরিয়া-২ এর কাজ উদ্বোধন করেন। ৭ অক্টোবর ২০১৭ সেতুর প্রথম স্প্যান বসে শরিয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টে। পদ্মা সেতুর মূলরেল প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের জুলাই মাসে।
এক নজরে পদ্মা ব্রীজ
আনুমানিক খরচঃ ৩০,১৯৩ কোটি টাকা (ইউএস ডলার ৩.৮৬৮ বিলিয়ন),
মূল সেতুর দৈর্ঘ্যঃ ৬.১৫০ কিলোমিটার,
প্রশস্তঃ ২২.৫ মিটার মিটার,
ভায়াডাক্টঃ ৩.১৪৮কিঃ মিঃ (রোড), ৫৩২ মিঃ (রেল),
এপ্রোচ রোডঃ ১২.১১৭ কিলোমিটার,
উচ্চতাঃ ১২০ মিটার,
জমি অধিগ্রহণ: ১,৪৭১ হেক্টর,
মূল সেতুর কাজের উদ্বোধনঃ ডিসেম্বর ১২, ২০১৫,
প্রথম স্প্যান স্থাপনঃ ০৭ অক্টোবর, ২০১৭,
এপ্রোচ রোডের কাজ শুরুঃ নভেম্বর ১২, ২০১৩,
মোট পিলার ও স্প্যানঃ ৪২টি ও ৪১টি,
লেনঃ ০৪ লেন,
লোড লিমিট: ১০,০০০ টন,
পানির মধ্যে গভীরতাঃ ১২২ মিটার,
মূল রেল প্রকল্পের কাজ শুরুঃ জুলাই, ২০১৮
মোট রেল লাইনের দৈর্ঘ্যঃ ১৬৯ কিলোমিটার,
রেল লাইন স্থাপনের আনুমানিক ব্যয়ঃ ৩৯,২৪৬.৭৯ কোটি টাকা (ইউএস ডলার ৪.৫৫ বিলিয়ন),
রেল লাইন স্থাপনের কাজ শেষ হবে: জুন, ২০২৪।
লেখক: প্রেস মিনিস্টার, বাংলাদেশ দূতাবাস, ওয়াশিংটন ডিসি।
Posted ৩:৪৬ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৪ জুন ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh