মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ | ৫ চৈত্র ১৪৩০

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

ডা. সিনহার সাথে শেষ সেলফি

ডা. ওয়াজেদ খান   |   বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর ২০২১

ডা. সিনহার সাথে শেষ সেলফি

চিকিৎসা একটি মহৎ পেশা। একজন অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তোলার দায় চিকিৎসকের। তাই স¦ভাবত:ই চিকিৎসকদেরকে হতে হয় মহান। হতে হয় বিনয়ের অবতার। ব্যাধিগ্রস্থ অসহায় মানুষের নিকট মহান সৃষ্টিকর্তার পর একজন চিকিৎসকই হয়ে উঠেন শেষ ভরসাস্থল।

পেশাগত জীবনে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচাতে সেবা দিয়ে থাকেন একজন চিকিৎসক। সৃষ্টির কি অমোঘ বিধান সেই চিকিৎসককেও একদিন ঢলে পড়তে হয় মৃত্যুর কোলে। রোগ বালাই যথারীতি বাসা বাঁধে তার দেহে। সবকিছু চুকিয়ে একদিন পৃথিবীর মায়াজাল ছিন্ন করে পরলোকে চলে যেতে হয় তাকেও। কোন কিছুর বিনিময়েই বেঁধে রাখা যায়না তাকে। যেমন আমরা বেঁধে রাখতে পারিনি ডাঃ সিনহা আবুল মনসুরকে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন প্রতিথযশা চিকিৎসক সিনহা তার স্ত্রী-সন্তান, স্বজন, সহায় সম্পত্তি সব ছেড়ে চলে গেছেন। মাত্র ৫৭ বছর বয়সে গত ১৪ অক্টোবর দুপুরে অন্তর্ধান ঘটেছে স্বপ্নবাজ চিকিৎসক সিনহার। যে হৃদয় দিয়ে ডাঃ সিনহা জয় করেছিলেন পৃথিবী। যে হৃদয়ের পুরোটা জুড়ে ছিলো মানুষের প্রতি স্নেহ-মমতা ভালোবাসা। সেই হৃদয়ে বসতি গড়েছিলো মরণব্যাধি। এই হৃদরোগই কাল হলো তার জন্য। যিনি মানুষকে সুস্থ্য থাকার পরামর্শ দিয়েছেন অথচ তিনি নিজের সুস্থতা নিয়ে ভাবেননি কখনো। যত্নবান হননি নিজ স্বাস্থ্যের প্রতি। এজন্যই বলা হয় ‘ডাক্তাররা নাকি বড় বেশী খারাপ রোগী”। যদি তিনি স্বাস্থ্য সচেতন হতেন তাহলে হয়তো বা আরো অনেকটা দিন নিঃশ্বাস ফেলতে পারতেন পৃথিবীর মুক্ত আলো-বাতাসে। এগিয়ে নিতে পারতেন তার অপূরণীয় স্বপ্নগুলো। হৃদরোগের পাশাপাশি কিডনীর জটিলতায় ভুগছিলেন ডাঃ সিনহা। বছর খানেক ধরে চলছিলো ডায়ালাইসিস। মারাত্নক এসব অসুস্থতা নিয়েও তার পথচলা ছিলো নিরন্তর।


লং আইল্যান্ডের স্টোনিব্রুক হাসপাতালে সপ্তাহকাল নিবিড় পরিচর্যায় থেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। স্ট্রোনিব্রুক হাসপাতালেই দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন ডাঃ সিনহা। তার স্ত্রী ফেরদৌসী শিল্পীও একজন চিকিৎসক। ডাঃ সিনহা ছিলেন এ্যানেসথেটিস্ট। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয় এটি। অপারেশন থিয়েটারে সার্জন রোগীর দেহে কাঁচি চালান। আর রোগীকে অচেতন করে হৃদস্পন্দন জিইয়ে রাখেন একজন এ্যানেসথেটিস্ট। এভাবেই হাজারো রোগীকে বাঁচাতে সহায়তা করেছেন তিনি। নিউইয়র্ক সিটির জ্যামাইকা হাসপাতাল ছিলো তার শেষ কর্মস্থল।


ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে সিনহা মনসুর ছিলো আমার অনুজ। আমি এম-১৪ ব্যাচ’র। আর সিনহা ছিলো এম-২০ ব্যাচের। সে সময় থেকেই পরিচয় ছিলো তার সাথে আমার। আশির দশকের মাঝামাঝি ময়মনসিংহ থেকেই পাড়ি জমাই বিদেশে। নব্বুই দশকের প্রথমার্ধে আগমন আমেরিকায়। পৃথিবীটা আসলেই অনেক ছোট। আমেরিকা এসে আবারো দেখা হয় অনেকের সাথে। তাদের মধ্যে সিনহা একজন। নিউইয়র্কে সিনহার সাথে প্রথম দেখা আমার এক সহপাঠি ডাক্তার বন্ধুর বাসায়। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের পুনর্মিলনীতে সিনহা ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয়। এছাড়া বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে আমরা একত্রিত হয়েছি। আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন প্রসঙ্গে। বিক্রমপুরের সন্তান সিনহা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী স্কুল ও ঢাকা কলেজে অধ্যয়ন করেছেন। চিকিৎসা পেশার পাশাপাশি শিল্প সাহিত্যে দখল ছিলো তার। ভ্রমণ পিপাসু সিনহা জীবন ঘনিষ্ট বই লিখেছেন অনেকগুলো।


“জীবন এত ছোট কেন?” লেখা বইটি থেকেই প্রমাণ মেলে সিনহার দূরদর্শীতার। মৃত্যুর মাস দু’য়েক আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে তার নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র মুক্তি পায়। প্রামাণ্য চিত্রটির অভিষেক অনুষ্ঠানে আমাদেরকে আমন্ত্রণও জানান সিনহা।

ডাঃ সিনহার মাঝে নেতৃত্বের গুণাবলী ছিলো স্পষ্ট। বাংলাদেশী আমেরিকান চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন নর্থ আমেরিকা নিউইয়র্ক চ্যাপ্টারের সেক্রেটারী ছিলেন তিনি। সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে সবসময় শিরোমনি হিসেবে দেখেছি তাকে। বন্ধু বাৎসল সিনহার বাসায় আমন্ত্রণ পেয়েছি অনেকবার। সবসময় আমন্ত্রণ রাখতে পারিনি। মেডিকেল কলেজের জীবন অনেকটাই রেজিমেন্টাল। যেখানে সিনিয়র জুনিয়রের বিষয়টি আমলে নেন সবাই। সেদিক থেকে সিনিয়রদের প্রতি তার ছিলো অগাধ শ্রদ্ধাবোধ। উদার ও অতিথিপরায়ণ হিসেবে চিকিৎসক মহলে ভিন্নতর কদর ছিলো সিনহার। জীবন ধারা, চাল-চলন ও পোশাক পরিচ্ছদে একধরণের আভিজাত্য ও বৈপরীত্য ছিলো লক্ষ্যণীয়।

নানা কারণেই বিএমএনএ’র অনুষ্ঠানে যাওয়া সম্ভব হতো না। তারপরও প্রতিটি অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য বার বার ফোন করতেন সিনহা। গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিএমএনএ’র নিউইয়র্ক চ্যাপ্টারের ছিলো দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন। লাগোর্ডিয়া ম্যারিয়ট হোটেল বলরুমে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে যথারীতি আমন্ত্রণ জানান সিনহা ও সংগঠনের প্রেসিডেন্ট ডাঃ আলম। সেদিন আমার পূর্ব নির্ধারিত একটি নিমন্ত্রণ থাকায় বিএমএনএ’র অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া সম্ভব হবে না বলে জানাই তাদের। তারপরও সকাল ১১টার দিকে এক চক্কর যেতে হয়েছিলো মিশিগান থেকে আগত বন্ধু ডাঃ সেলিমের সাথে। ম্যারিয়টের লবিতে বসেছিলেন সিনহা। আমাকে দেখে অনেকটা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন। আপ্লুত হয়ে বললেন-‘ওয়াজেদ ভাই-আমি ভাবতেই পারিনি আপনি আসবেন।’ জিজ্ঞাসা করলেন আমার স্ত্রী আসছেন কিনা। আমি তার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতেই সিনহা বললেন-ভাই আপনার সাথে একটা সেলফি তুলবো। আমাকে নিয়ে একটি সেলফি তুললেন। ভেবেছিলাম সন্ধ্যায় আরেকবার যাবো অনুষ্ঠানস্থলে। তা আর সম্ভব হয়নি। আমার ধারণা ছিলো সেলফিটি আর কখনোই দেখা হবে না। এ ঘটনার পর মাস না গড়াতেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন সিনহা। তার অসুস্থতায় উদ্বিগ্ন ছিলাম।

প্রতিদিনই খবর নিয়েছি। গত ১৫ অক্টোবর জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে নামাজে জানাযা শেষে কফিন তুলে দিলাম ফিউনারেল হোমের গাড়িতে। তার আগে এক পলক দেখে নিলাম দীর্ঘদিনের চেনা মুখটি। ওয়াশিংটন মেমোরিয়াল পার্ক কবরস্থানে দাফন হয়েছে সিনহার।

স্টোনিব্রুকে তার বাসায় ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয়েছে দোয়া মাহফিল। ডাঃ সিনহাকে নিয়ে সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’র ২১ অক্টোবর সংখ্যায় কিছু লেখার কথা ভাবছিলাম। লেখার আগে একবার চোখ বুলাতে গেলাম তার ফেইসবুক ওয়ালে। আমি বিস্মিত হলাম তার ফেইসবুক ওয়ালে আমার সাথে তোলা সেলফিটি সাঁটানো দেখে। আমি ভাবতেই পারিনি ছবিটি সিনহা ফেইসবুকে দিয়েছে। সিনহার সাথে সেদিনই ছিলো আমার শেষ দেখা। আর এটাই হচ্ছে তার সাথে শেষ সেলফি। সিনহা আর ফিরে আসবে না কখনোই। কিন্তু তার তোলা এ সেলফি স্মৃতির মনিকোঠায় থাকবে চিরদিন। সিনহা আমরা তোমাকে ভালোবাসি। আমাদের অফুরান দোয়া রয়েছে তোমার বিদেহী রূহের প্রতি। জীবনের খানিকটা আকাশ শূণ্যতার পরিবৃত্তে সীমিত থাকে প্রত্যেকেরই। হয়তো বা তোমার ক্ষেত্রেও ঘটেছে তাই। তোমার স্ত্রী-সন্তানদেরকে প্রবোধ দেয়ার মতো ভাষা নেই। অনেকের প্রয়াণে তোমার ক্ষুরধার লেখনী পড়েছি। সাহিত্যাঙ্গণে তোমার সৃষ্টি দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখবে তোমাকে। আমরা যত দুঃখই করিনা কেন আসলে মৃত্যুর কোন কাল নেই। পরলোকে তুমি ভালো থেকো। মহান আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য নির্ধারণ করুক বেহেস্তের সর্বশ্রেষ্ঠ আসন। এটাই আমাদের প্রার্থনা। আমিন।

advertisement

Posted ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর ২০২১

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

গল্প : দুই বোন
গল্প : দুই বোন

(6091 বার পঠিত)

মানব পাচার কেন
মানব পাচার কেন

(1142 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.