ড. মাহবুব হাসান | বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট ২০২০
একজনের বিরুদ্ধে যখন কোনো অভিযোগ ওঠে তখন নিশ্চয় তার পেছনে কিছু কারণও থাকে। এই ধারণাটি সামাজিক না রাজনৈতিক সে বিবেচনাও আমরা করি না। আমরা ধরে নিই ঘটনার পেছনে কারণ আছে।
হ্যা, আছে বা থাকে। এক. একজন নিরপরাধের বিরুদ্ধে যখন কেউ প্রশ্ন তোলে তখনও থাকে প্রশ্নকর্তার নিজের কোনো স্বার্থ উদ্ধারের গোপন বিষয়। আবার ভিকটিমেরও থাকতে পারে এমন স্বার্থ, যা সমাজের চোখে, রাষ্ট্রের চোখে, সরকারের চোখে, পুলিশ বা র্যাবের চোখে, মিলিটারির চোখে, সাংবাদিকের চোখে, বুদ্ধিজীবীর চোখে ‘অপরাধ হিসেবে’ গণ্য হতে পারে। ঠিক একই ভাবে অপরাধীর বিষয়েও উল্লিখিত পক্ষ ভাবতে পারেন যে, সে অপরাধী। অপরাধ’ শব্দটি আমরা গ্রহণ করেছি সমাজের কল্যাণকে সামনে রেখে। কল্যাণের যে রুপ তাকে বিচার করলেও দেখা যাবে সেখানে ঘাটতি আছে। যেমন কোনো অপরাধী, যিনি অপরাধী হিসেবে চিহিৃত বা আদালতে প্রমাণিত, তারও রয়েছে ‘হিউম্যান রাইটস’। অর্থাৎ অপরাধী ও অপরাধী নয়, উভয়েরই রয়েছে মানবিক অধিকার। সেই অধিকার সে পায় কি না সেটাই দেখার বিষয়।
নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানে খুন হওয়া প্রযুক্তিবিদ ফাহিম সালেহ হত্যার পর তার সম্ভাব্য খুনিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শাদা চোখে মনে হয় আইন বেশ তৎপর এ-সব নিয়ে। আইন প্রয়োগেও পুলিশ প্রশাসন সততার সাথেই দায়িত্ব পালন করে থাকে। এটাই সমাজের বিশ্বাস। আবার কালো মানুষ জর্জ ফ্লয়েডকে যে শাদা পুলিশ হত্যা করেছে, তার ভিডিও পৃথিবী জুড়েই ভাইরাল হয়েছে, সেই অপরাধীকে কিন্তু আটক করা হয়নি সহসাই। যতক্ষণ পরযন্ত ‘ব্লাক লাইভস ম্যাটার্স’ মিছিল গোটা আমেরিকর ২৫টি শহরে ছড়িয়ে না পড়া পরযন্ত সরকার ও পুলিশের টনক পড়েনি। তখন তারা বুঝতে পেরেছে যে জর্জ মানুষ ছিলো। সে যদি অপরাধও করে থাকে, তাকে গলার চেপে হত্যার অধিকার নেই পুলিশের। তার অপরাধের জন্য আদালতে সোপর্দ করাই পুলিশের দায়িত্ব। কিন্তু শাদা চামড়ার পুলিশ নিজেই বিচার করেছে, সে অপরাধী, তাকে হত্যা করতে হবে। সে সেই কাজটি করেছে।
ঠিক একই কাজ করেছে কক্সবাজারের টেকনাফ পুলিশকর্তা প্রদীপ ও লিয়াকত, মোট ছয়টি গুলি করে মেরে ফেলে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো; রাশেদ খানকে। আর তার দুই সহযোগী শিপ্রা দাশ ও সিফাতকে আটক করে। পুলিশ ‘হত্যা ও মাদকের’ কারণ দেখিয়ে মামলা করে সিফাত ও শিপ্রার বিরুদ্ধে। কিন্তু মেজর রাশেদের বিরুদ্ধে কোন অপরাধের কারণে তাকে হত্যা করা হলো, সে বিষয়টি আমি আজো জানি না। মেজর সিনহা ও তার সহযোগীরা টেকনাফে কেন গিয়েছিলেন, কি কাজ করছিলেন, সে তথ্য কোনো নিউজে চোখে পড়েনি। পুলিশের মামলার সূত্রে এটা মনে হতে পারে যে তারা মাদক চোরাচালনের সাথে জড়িত ছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে মানুষ হত্যার অভিযোগ ছিলো বা আছে। তারা যদি অপরাধী হয়ে থাকে পুলিশের চোখে, তাহলে সেই পুলিশের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব তাদের আইনের হাতে সোপর্দ করা। অপরাধীকে গুলি করে হত্যার কোনো অধিকার পুলিশের নেই। আইন শৃঙ্খলা রক্ষা ও সমাজে শান্তি রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ যে জনগণের সেবাদানকারী বাহিনী, পুলিশের আচরণ তা প্রমাণ করে না। তারা যে জনগণের জান-মাল রক্ষায় নিয়োজিত , সেটাও তারা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ এই পুলিশ ব্রিটিশের হাতে তৈরি বিধায় জনগণকে প্রজা বা অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করে। তাদের শিক্ষায় ও প্রশিক্ষণে শেখানো হয়, তোমরা শাসকের অংশ। আর জনগণ শাসিত তোমাদের হাতে। অর্থাৎ তোমার প্রভু, ব্রিটিশরা যা শিখিয়ে গেছে। আর সে কারণেই অপ্রমাণিত অপরাধীকে গুলি করে হত্যা করতে দ্বিধা করেনি প্রদীপের মতো পুলিশেরা। ঠিক শাদা চামড়ার আমেরিকান পুলিশ আর বাংলাদেশের পুলিশের মধ্যে মনোবাস্তবিক চেতনার মধ্যে তেমন কোনো ফারাক নেই।
বাংলাদেশের টিভি রিপোর্টগুলোতে দেখেছি, অনেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন এসআই লিয়াকত মেজর সিনহাকে চারটি গুলি করেছে। আর পরে প্রদীপ এসে দুটি গুলি করে সিনহার মৃত্যু নিশ্চত করে। এখন ওই প্রত্যক্ষদর্শীরা আদালতে যদি তাদের কথাগুলো সাক্ষী হিসেবে বলে বা বলার সাহস রাখে, তাহলেই আদালত বুঝবেন যে, হ্যা, পুলিশ দোষী। আর যদি তারা না বলে, ভিন্ন কথা বলে তাহলে পুলিশ নির্দোষ। কিন্তু গুলি খেয়ে যে মেজর সিনহা মৃত্যু বরণ করেছে, এর চেয়ে নির্মম সত্য তো আর কিছু নেই। পুলিশের সন্ত্রাস যে কতোটা সেটার জন্য ওই সব বিচারককে বেশি দূর যেতে হবে না। তিনি যদি রাজনৈতিক কর্মী হয়ে ছাত্রজীবন কাটিয়ে থাকেন, তিনি যদি বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে অধ্যয়ন করে থাকেন, তাহলে পুলিশের নির্মমতা দেখে থাকবেন। তার কাছে কোনো সাক্ষীই প্রয়োজন থাকবে না। কিন্তু বিচারালয় তো সাক্ষী নির্ভর ব্যবস্থা, যাতে মিথ্যাকে সত্য, আর সত্যকে মিথ্যা হিসেবে চিত্রিত করা যায়, তারই এক আদর্শ জায়গা। এই বিচারালয়ও যে ঔপনিবেশিক শাসকদের হাতের পুতুল, ব্রিটিশ আমলের বিচারগুলোর দিকে নজর বুলালেই তার প্রমাণ মেলে। কতো যে অসঙ্গতি, কতো যে মিথ্যাচার এই সব আদালতে চলে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারপরও আমরা এই পরিত্যক্ত-প্রায় বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে নারাজ। কারণ ক্ষমতায় গেলেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এই আইন আর এই ব্যবস্থা এক মোক্ষম অস্ত্র।
দোষী বিবেচনা করে পুলিশ দুজনকে গ্রেফতার করে কাস্টডিতে নেয়া হয়েছে, সেটাও জেনেছি খবরে। কিন্তু তারা সঠিক বিচার পাবে বলে মনে হয় না। যে পক্ষের ‘প্রভাব বেশি হবে রায় তাদেরই পক্ষে যাবে। মনে রাখতে হবে বিচারকরাও আমাদেরই নিত্যদিনের প্রতিবেশি, সমাজেরই অংশ। তারাও ভীত হয়। আমরা হাই কোর্টের বিচারপতিকে দেখেছি ‘মামলা নিয়ে বিব্রত’ হতে। এবং তিনি রিলিজ নিয়েছেন। কাদের ভয়ে বিচারপতি ভীত ও বিব্রত হন, আমরা তাদের চিনি। সন্ত্রাসই তাদের মূলে আছে। রাজনৈতিক দলগুলো সেই সন্ত্রাসের জিম্মাদার। আর তাদের লালন পালন করে সরকার। লালন পালন করে রাজনৈতিক দলগুলো। সমাজপতিরা। এমন কি ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী পালেন। এ-সবের অবসান না হলে কোনোদিনই ন্যায় ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে না।
মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহার হত্যা ঘটনার পর সামরিক বাহিনী প্রধান ও পুলিশ বাহিনী প্রধান মিলে বলেছেন—তাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। অর্থাৎ তারা পরস্পরকে বা বাহিনীকে দোষারোপ করবেন না। তাদের মধ্যে সম্পর্ক ‘সু’ আছে। ইঙ্গিতে বোঝা গেলো তারা বলতে চান দুই বাহিনীর মধ্যে কোনো এক মহল বিরোধ তাগিয়ে দিতে চায়। সুগোপনে বিরোধ আছে বলেই তাদেরকে প্রকাশ্যে তা অস্বীকার করতে হলো। পুলিশ ও মিলিটারির মধ্যে বিরোধ থাকলে কি এই দুই বাহিনীর মধ্যে ‘যুদ্ধ’ লেগে যাবে। না, কোনোভাবেই সেটা হবে না। পুলিশ একটি ক্ষুদ্র বাহিনী এবং তাদের দায়িত্ব সমাজের সুরক্ষা। আর মিলিটারি দেশরক্ষা বাহিনী। এদের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হবার কোনো আশঙ্কা অমূলক। তবু সে-কথাই দুই বাহিনীপ্রধান বলেছেন মিডিয়াতে।
কেন বলেছেন? নিশ্চয় তারা কিছু আঁচ করে থাকবেন।
একজন মেজরকে গুলি করে হত্যা করেছে এই ভয়ে পুলিশ মনে করছে মেলিটারিদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। সেটা হতেই পারে। সেটা কি কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে? না, পারবে না। তবে এ-ধরণের অসন্তোষ কখনোই দানা বাঁধতে পারতো না যদি বিচার বিভাগ অরাজনৈতিক হতো, যদি বিচার বিভাগ নিজস্ব বিচারক নিয়োগপ্রাপ্ত হতো, যদি স্বাধীন বিচার বিভাগকে পরাধীন করে রাখার মতো আয়োজন করা না হতো, যদি বিচারবিভাগকে তার শক্ত কদমের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়া হতো। না, সেটা হতে দেয়া হয়নি। ব্যক্তিগত স্বার্থ ও রাজনৈতিক দলের স্বার্থে সেটা করতে দেয়া হয়নি। সেটা আর আমরা দেখতে পাই সাবেক প্রধানবিচারপতি সুরেন্দ্রকুমার সিনহাকে দেশান্তরে পাঠানোর কায়দা দেখেই। সরকারই সেটা করেছে ডিজিএফআইএর এক কর্মকর্তাকে দিয়ে।
আমি জানি, এই হত্যামামলার ন্যায় বিচারও হবে না। হলেও আসামি মুক্ত হবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার সুযোগ নিয়ে। রাষ্ট্রের প্রধান কর্মধারের কি শরম নেই? তিনি সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে মাফ করে দিচ্ছেন? তিনি কী হত্যার শিকার যিনি, তাকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন? পারবেন না। তাহলে কোন যুক্তিতে তিনি খুনি অপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়ে আবারো খুনের সুযোগ করে দিচ্ছেন?
এবারও যদি একই ঘটনা ঘটে, তাহলে আমরা ধরে নেবো, দেশটা গার্বেজে পরিণত হয়েছে।
Posted ১২:৩০ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh