চৌধুরী মোহাম্মদ কাজল | বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট ২০২০
ঢাকায় সাংবাদিকতা না করেও হাতে গোনা যে কয়েকজন সাংবাদিক দেশব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে মোনাজাতউদ্দিন, শামছুর রহমান ও আহমদ সফিউদ্দিন অন্যতম। কঠোর পরিশ্রম, পেশার প্রতি আন্তরিকতা ও সততা দিয়ে তারা মফস্বল সাংবাদিকতাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে প্রথম দুজন বেচে নেই। একজন সন্ত্রাসীদের হাতে নিজ কার্য্যালয়ে জীবন দিয়েছেন, অন্যজন সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে ফেরী থেকে পড়ে নদীতে ডুবে প্রান হারিয়েছেন। আহমদ সফিউদ্দিন বেচে আছেন। মাঝে মাঝে টেলিফোনে কথা হয় তার সাথে। সেকালের সাংবাদিকতার গল্প শুনি। কি নিদারুন কষ্ঠ সহ্য করে তারা সংবাদ সংগ্রহ করতেন। তখন ইন্টারনেট ছিল না, ই-মেইল ছিল না। মোবাইল ফোন, ফ্যাক্স বা ফটোকপি ছিলনা। সংবাদ সংগ্রহ করে রিপোর্ট তৈরী করতে যদি লাগতো পাচ ঘন্টা, সেই সংবাদ ঢাকায় পাঠাতে লাগতো সাত ঘন্টা। প্রায় সারাটা দিনই চলে যেত পেশাগত কাজে।
মোনাজাতউদ্দিনকে বলা হতো চারন সাংবাদিক। উত্তর বঙ্গের গ্রামে গঞ্জে চষে বেড়িয়েছেন। সংবাদের পেছনে ছোটাই ছিল তার নেশা। শেষ পর্যন্ত সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়েই প্রান দিয়েছেন। তিনি একজন ভালো চিত্রগ্রাহকও ছিলেন। উত্তরাঞ্চলের নানা জায়গা ঘুরে খবর ও ছবি সংগ্রহ করে কিভাবে যে ঢাকায় পাঠাতেন তা ভাবলে অবাক লাগে। সাংবাদিকতায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন একুশে পদক। মোনাজাতউদ্দিন গাইবান্ধার ফুলছড়িতে যমুনা নদীতে নৌকাডুবির খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে ফেরির ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যুবরন করেন ১৯৯৫ সালে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নীহার বানু নিহত হয়েছিলেন ১৯৭৬ সালে। সেই রিপোর্ট ধারাবাহিকভাবে দৈনিক বাংলায় লিখে সারা দেশে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন আহমদ সফিউদ্দিন হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা ও বস্তুনিষ্ট সংবাদ পরিবেশনার ফলে নীহার বানুর প্রতি সহানভূতিশীল হয়ে পড়েছিল দেশবাসী। সে সময় কম্পিউটার ছিল না, একটানে হাতে রিপোর্ট লিখতে হতো। কাটাছেড়ার সুযোগ ছিলনা। ক্যামেরা দিয়ে নিজেরাই ছবি তুলতেন। হাত দিয়ে ফোকাস ঠিক করে ছবি তুলতে হতো। তারপর নিজেরাই সেই ছবি ডেভেলপ ও প্রিন্ট করে ঢাকায় পাঠাতেন। কিভাবে সংবাদ পাঠাতেন তখন? সফি ভাই বলেন রাজশাহী থেকে সারাদিনে বাংলাদেশ বিমানের একটি মাত্র ফ্লাইট ছিল। সেটি ধরার চেস্টা করতাম। না পারলে ছুটতে হতো বাসস্ট্যান্ডে। পরিচিত (অথবা অপরিচিত) কাউকে খামটি ধরিয়ে দিতাম। অনেক সময় তারা নিজেরাই রিপোর্টগুলি পৌছে দিতেন, কখনওবা পত্রিকা অফিস থেকে লোক গিয়ে নিয়ে আসতো। তারপরও কাজ শেষ হতো না। ঢাকায় ফোন করে জানাতে হতো কিভাবে রিপোর্ট পাঠানো হচ্ছে। আর ফোনও কি যে সে ফোন। বুকিং দিয়ে ট্রাঙ্ক কল করতে হতো। কথা শোনা যেত খুবই নীচু স্বরে। চিৎকার করে কথা বলতে হতো। তারপরও বোঝা যেত না। ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকা মফস্বলে পৌছতে পৌছতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। পত্রিকা হাতে পাওয়ার পর বোঝা যেত কতটুকু কি ছাপা হয়েছে।
মোনাজাতউদ্দিন সম্পর্কে সফি ভাই বলেন সংবাদ পাঠানোর ব্যাপারে তিনি খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতেন। কাউকে রিপোর্টগুলি দেওয়ার পর লক্ষ্য রাখতেন সেগুলি ব্যাগে ঠিকমত ঢোকানো হয়েছে কিনা। লোকটি বাসে ওঠেছে কিনা, বাসটি ছেড়েছে কিনা। বাস ছেড়ে দেওয়ার পরও তাকিয়ে থাকতেন। একেবারে দৃস্টি সীমার বাইরে যাওয়ার পর ওঠতেন।
সে সময়ের সাংবাদিকতা সম্পর্কে আহমদ সফিউদ্দিন বলেন তখন হয়তো সম্মানী ছিল না, কিন্তু সাংবাদিকদের সম্মান ছিল। মানুষ তাদের শ্রদ্ধা করতো। সাপ্তাহিক বিচিত্রার নীহার বানু সংখ্যাটি প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি প্রচুর প্রশংসা পান। সেই সংখ্যাটির জন্য তিনি মাত্র ২,২০০ টাকা বিল করেছিলেন। সম্ভবত তিনিই একমাত্র সাংবাদিক যার রিপোর্টের সাথে রিপোর্টারের প্রোফাইলও ছাপা হয়েছিল। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে তথ্য সংগ্রহ করা, রিপোর্ট তৈরী করা ও পাঠানো এখন অনেক সহজ। অথচ একাজটি এক সময় কতটা কঠিন ছিল এ যুগের সাংবাদিকরা হয়তো তা কল্পনাও করতে পারবে না।
Posted ৮:১৮ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh