সেতারা কবির সেতু | শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২০
খলিল সাহেব পেশায় একজন ব্যবসায়ী। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো। কিছু দিন আগেই বিয়ে করেছেন। নতুন সংসার গুছিয়েছেন মনের মতো করে। বাবা,মা, স্ত্রী, সংসার সবকিছু নিয়ে ভালোই আছেন। বিয়ের দুই বছর পর খলিল সাহেবের ঘর আলোকিত করে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। সেদিন খলিল সাহেবের আনন্দের সীমা ছিল না। বাবা হওয়ার খুশিতে পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করেন। আরও দুই বছর পর খলিল সাহেব দ্বিতীয় সন্তানের বাবা হন। এবারও খলিল সাহেবের পরীর মতো একটি মেয়ে হয়েছে। তিনি দারুণ খুশি। তবে কোথাও যেন সামান্য হলেও অপ্রাপ্তি ছিলো। খলিল সাহেব খুব করে চেয়েছিলেন একটি ছেলে সন্তান। যে তার ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু দেখাশোনা করবে। এক, এক করে খলিল সাহেব চার কন্যা সন্তানের পিতা হোন। কন্যা সন্তানের জন্ম হওয়ায় খলিল সাহেব অসুখী ছিলেন না। আমাদের সমাজের অধিকাংশ পিতার মতোই খলিল সাহেবে চাওয়া ছিল তার যদি পুত্র সন্তান থাকতো তাহলে তার মৃত্যুর পর ছেলে বাবার খাটিয়া ধরতে পারতো।
অবশেষে, আল্লহর অশেষ রহমতে খলিল সাহেবের চাওয়া পূর্ণ হয়। খলিল সাহেব দুই ছেলের বাবা হন। খলিল সাহেব এতো আনন্দ কোথায় রাখবেন? তিনি গরু, খাসি জবাই করে এলাকার সকল মানুষের মাঝে গোশত বিতরণ করেন। সকলের কাছেই ছেলেদের জন্য দোয়া চান। খলিল সাহেব আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। আল্লাহ তার সকল চাওয়া পূর্ণ করেছেন। তার আর কোন অপ্রাপ্তি নেই।
খলিল সাহেব চায় ছেলেরা তার কাছে, কাছে থাকুক । স্কুল শেষ করে দুপুরে ছেলেরা যখন বাড়িতে আসে তখন খলিল সাহেব দুপুরের খাবার খেতে বাড়ি আসেন। আগে কখনো তিনি দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য বাড়ি আসতেন না। স্ত্রী মাঝে মধ্যে আসতে বললেও তার সময় হতো না। এখন প্রতিদিন দুপুরে খলিল সাহেব দুপুরের খাওয়ার জন্য বাড়িতে আসেন। খাওয়া শেষ হলে প্রায় প্রতিদিনই খলিল সাহেব ছেলেদের নিয়ে আড়তে যান। দুই ছেলে দৌড়াদৌড়ি করে, দুষ্টমি করে খলিল সাহেব খুব মুগ্ধ হয়ে তা দেখেন। ছেলেদের শৈশবের মধ্যে খলিল সাহেব নিজেকে খুঁজে পান। এতো ব্যস্ততার মাঝেও ছেলে দুটিকে চোখের আড়াল হতে দেন না খলিল সাহেব।
খলিল সাহেব চার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। সব মেয়েরই ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে। খলিল সাহেব তার সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেছেন মেয়েদের সুখে রাখতে। দুই ছেলে পড়াশোনা শেষ করেছে। তিনি চান এবার তার ছেলেরা তার ব্যবসা দেখবে। তিনি মাঝে মাঝে যাবেন আড়তে ছেলেরা কেমন ব্যবসা করছে তা দেখার জন্য। তিনি দুই ছেলেকে ব্যবসা বুঝিয়ে দিয়েছেন। এখন আর আগের মতো ব্যস্ততা নেই। স্ত্রীকে সাথে নিয়ে মেয়েদের বাড়িতে যান, আত্নীয়দের বাড়িতে যান। বেশ ভালোই চলছে খলিল সাহেবের দিনকাল। কিন্তু খলিল সাহেবের ভালো থাকা হলো না বেশিদিন। তার আদরের ছোট মেয়েটার কপাল পুড়লো। শ্বশুর বাড়ির সবাই তাকে নির্যাতন করে বের করে দিয়েছে। একদিন তপ্ত দুপুরে মেয়েটা কাঁদতে, কাঁদতে বাবার বাড়ি চলে এলো। সেই থেকে মেয়েটা বাবার বাড়িতেই থাকে।
আগের মতো তেজস্বী-ভাব আর খলিল সাহেবের মাঝে নেই । দেখলেই বুঝা যায়, তার বয়স হয়েছে। ছোট মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা করেন। তার অবর্তমানে ছোট মেয়ের কি হবে তা ভেবে কোন কূলকিনারা পান না। বেশ ক’বার মেয়েটিকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মেয়ে কিছুতেই রাজি হয় না। এখন আর মেয়েকে জোর করেন না। ভাবেন, আমি না থাকলেও তার ভাইয়েরা আছে, ওরাই তাকে দেখবেন। আপন ভাই কোনদিন বোনকে ফেলে দিতে পারবে না।
অনেক দিন পর খলিল সাহেবের বাড়িতে উৎসব চলছে। বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা। কতো আয়োজন করা হয়েছে। খলিল সাহেবের কতো দায়িত্ব। সবকিছু তদারকি করছেন। রান্নার কি অবস্থা, সবার খাওয়া হয়েছে কিনা সবকিছুর খোঁজ নিচ্ছেন। যদিও ইদানীং তার শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। তারপরও তিনি তৎপর। পুরো অনুষ্ঠান নিজে তত্ত্বাবধান করছেন যেন কোন ত্রুটি না হয়। সন্ধ্যার দিকে নতুন বউ যখন বাড়িতে আসে তখন যেন খলিল সাহেবের আনন্দের শেষ থাকে না। নতুন বউকে তিনি বলেন, তুমি আজ থেকে আমার মেয়ে। এখন থেকে আমার পাঁচ মেয়ে।
আজকাল খলিল সাহেব আর আগের মতো শক্তি পান না। বিভিন্ন রোগ ব্যাধি লেগেই থাকে। তাই একটু তাড়াহুড়ো করে ছোট ছেলের বিয়ে দিলেন। বড় সংসার দুই ছেলে এবং তাদের বউ, খলিল সাহেব ও তার স্ত্রী এবং ছোট মেয়ে। সবাই একই বাড়িতে থাকে, একসাথে খায়। অনেকদিন পর খলিল সাহেব আড়তে গেলেন, পুরনো কর্মচারীরা তাকে দেখে মহা খুশি। মনে হয় খুব একটা খুশি হতে পারলেন না তার দুই ছেলে। ছেলেদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কেমন চলছে ব্যবসা? ছেলেরা খুব একটা আগ্রহ না দেখিয়ে বললো, ভালো। তারপরও তিনি ব্যবসার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে থাকলেন। এবার বড় ছেলে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো, এই শরীর নিয়ে আপনার আসার দরকার কি ছিলো? আমরাতো ভালোই করছি। বাড়ির সবার খরচ দিতে তো কোন সমস্যা করছি না। খলিল সাহেব একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন, কি বলবেন ভেবে পান না। ঠিক তখনই ছোট ছেলে বলে উঠলো, ব্যবসায় এখন নতুন নতুন পলিসি এপ্লাই করতে হয়। পুরনো পলিসি নিয়ে ব্যবসা করলে ব্যবসায় লাল বাতি জ্বলবে। বাবা, আপনার বয়স হয়েছে। আপনি এসব বুঝবেন না। খলিল সাহেব কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। আহত হৃদয় নিয়ে বাড়ি ফিরছেন, আর ভাবছেন, আমি যখন ছোট তখন আমার আব্বা মারা যান। কতো কষ্ট করে এই ব্যবসা আমি দাঁড় করিয়েছি। একজন সফল ও ভালো ব্যবসায়ী হিসেবে আমি পরিচিত। অথচ আজ ছেলেরা বলে আমি ব্যবসা বুঝি না! নিজের অজান্তেই চোখের কোনে পানি এসেছে খলিল সাহেবের। হঠাৎ রিকশা চালকের কথা শুনে কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসেন। দুই পাশে তাকিয়ে বলেন, বাড়ি পিছনে ফেলে এসেছি। রিকশাচালক কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো, চাচা আপনি কি এতোক্ষণ ঘুমাচ্ছিলেন! আপনার বাড়ি ছেড়ে এসেছি তারপরও কিছু বলেন নি। খলিল সাহেব কিছুই না বলে অসহায় দৃষ্টিতে রিকশা চালকের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
একদিন রাতে যখন খলিল সাহেব ঘুমাতে যাবে ঠিক সেই সময় বড় ছেলে দরজার ওপাশ থেকে বলে, বাবা আসতে পারি। তিনি ছেলেকে আসতে বললেন এবং কাছে বসালেন। বললেন, ‘তোমাকে এতো অস্থির দেখাচ্ছে কেন?’ ‘বাবা, আপনি অনুমতি দিলে আমি একটি কথা বলতে চাই।’ ‘তুমি এতো সংকোচ করছো কেন বাবা।’ ‘কি বলতে চাও?’ ‘বাবা আপনাকে তো বলা হয়নি, আমি একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। আপনার বউমার ইচ্ছে আমরা সেখানে গিয়ে বাস করি। আপনি, মা চাইলে আমাদের সাথে আসতে পারেন।’ খলিল সাহেব কিছুই বলতে পারছে না। তার গলাটা ভারি হয়ে আসছে। সুখ, দুঃখের সাথী তার স্ত্রী বুঝতে পেরেছেন তার অবস্থা। শক্ত করে স্বামীর হাতটা ধরেন। ছেলেকে বলেন, ‘তুমি এখন ঘরে যাও, সকালে তোমার বাবা এ বিষয়ে তোমার সাথে কথা বলবে।’ ছেলে চলে যাওয়ার পর খলিল সাহেব আর চোখের পানি আড়াল করতে পারেন না। স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলেন। স্ত্রী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘ছেলেরা বড় হয়েছে। কিসে তাদের ভালো হবে সেটা তারা আমাদের থেকেও ভালো বুঝে। আপনি কেন কষ্ট পাচ্ছেন। আপনি চান না যে তারা সুখে থাক।’ খলিল সাহেব কিছুই বললেন না, সারারাত জেগে থাকলেন। খুব সকালে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে বড় ছেলের দরজায় কড়া নাড়লেন। ছেলে চোখ ঘুষতে, ঘুষতে দরজা খুলে বললেন বাবা, ‘আপনি?’ খলিল সাহেব বললেন, ‘তোমরা যেতে পারো নতুন বাসায়। তোমরা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকবো।’
(আগামী সংখ্যায়)
Posted ৩:১৩ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh