সেতারা কবির সেতু | শুক্রবার, ২৮ আগস্ট ২০২০
নীরবতার ফল প্রার্থনা/প্রার্থনার ফল বিশ্বাস/বিশ্বাসের ফল ভালোবাসা/ভালোবাসার ফল সেবা/সেবার ফল শান্তি। এই বাণীটি সমজসেবী মাদার তেরেসার। আজ বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মানুষ মাদার তেরেসার জন্মদিন। আসুন সমাজসেবী মাদার তেরেসা সম্পর্কে জানি। মাদার তেরেসা ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট যুগোস্লাভিয়ার স্কপিয়েতে জন্মগ্রহণ করেন। শহরটি ছিল আলবেনিয়া রাজ্যে। আলবেনিয়া ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। তাঁর পরিবারের বাস ছিল শহরে। তাঁর পিতা নিকোলাস বোজাঝিউ ছিলেন বাড়ি তৈরির ঠিকাদার। মাদার তেরেসার বিবরণ অনুযায়ী তাঁর বাবা সহৃদয় মানুষ ছিলেন।গরীব লোকদের তিনি প্রত্যাখ্যান করতেন না।তাঁর মায়ের নাম ছিল ড্রানাফিল বার্নাই। তাঁর এক ভাই ও বোন ছিল। ১৯১৭ সালে তাঁর বাবার অকাল মৃত্যু হয়। ১৮ বছর বয়সে তিনি সিদ্ধান্ত নেন গৃহ ত্যাগ করে নান’ হবেন। ১৯২৮ সালে তিনি কলকাতা আসেন। সেখান থেকে তাকে লরেটোর আশ্রমে পাঠানো হয়। লরেটো হলো দার্জিলিং এর একটি শহর।সেখানে একটি মিশনারী স্কুলে যোগ দেন।মাদার তেরেসার সবচেয়ে ভালো লাগতো সানডে স্কুল। সেখানে তিনি গরীব ঘরের ছেলেমেয়েদের পড়াতেন। স্কুল শেষে প্রতিটি ছেলেমেয়েকে তিনি গোসল করিয়ে দিতেন। বছর শেষে পুরস্কার বিতরণীয় হতো। ১৯৩১-১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন শিক্ষিকা।একদিন মাদার তেরেসা বুঝতে পারলেন লরেটো ছেরে রাস্তায় নেমে গরীবদের সেবা করতে হবে। তিনি অনুভব করলেন মানুষের দুঃখ কষ্টের ভাগ না নেওয়া অন্যায়।এই উদ্দেশ্যে ১৯৪৮ সালে তিনি পাটনার মেডিকেল মিশন থেকে কয়েক মাসের শিক্ষা নিয়ে কলকাতার একটি বস্তিতে কাজ শুরু করলেন। বস্তির ছেলেমেয়েদের তিনি শুধু পড়াতেন না পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাও শিখাতেন। প্রথমদিকে তিনি তেমন কোন সাহায্য সহযোগিতা পাননি। কিন্তু পরে লোকজন বুঝতে পারে তিনি ভালো কাজ করছেন। সেখানে তিনি একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন বিদ্যালয়টির নাম রাখা হয় নির্মলহৃদয়।
মাদার তেরেসার বিবরণ অনুযায়ী :
১৯৪৯ সালের ১৪ জানুয়ারি বস্তিতে একটি নতুন পরিবার এসেছে,এক বাঙালি মহিলা,তার ছোট, ছোট দুটি শিশু এবং তার বোন। বোনটি নার্স।মাদার তেরেসা তখন ক্লাস নিচ্ছিলেন। একটি বাচ্চা এসে বললো, জানেন মিস জেনা আর তার ছোট ভাই সকাল থেকে কিছুই খায়নি।আজ রাতেও খেতে পাবে না। সে বেচারিরা নিজের মুখে এ কথা বলতে পারলো না।আমার কাছে তিন আনা পয়সা ছিল মাত্র। ঠিক আছে, আমি সেন্ট টেরিজা’স থেকে হেঁটেই যেতে পারবো। একটু মুড়ি কিনলাম।আর আমার কাছে দুটো ডিম ছিল। তাই দিয়ে ঐ দুটি ছেলেমেয়েদের জন্য একটু খাবার তৈরি করে দিলাম।
মাদার তেরেসা অনুভব করেন দরিদ্রদের সাহায্য করতে হলে দারিদ্র্যতাকে বুঝতে হবে। তিনি খুবই সাদাসিধা জীবন যাপন করতেন। একদিন বৃষ্টির দিনে মাদার ট্রামে করে ওষুধ আনতে যাচ্ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন গাছের তলায় ঢলে পরে আছে এক লোক।তিনি ঠিক করলেন ফিরার পথে লোকটির জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু ফেরার পথে তিনি দেখলেন লোকটি মারা গেছেন। তিনি খুব কষ্ট পেলেন। তিনি অনুভব করলেন মৃত্যুর পূর্বে লোকটি হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিলেন। কেও ছিল না তার শেষ কথা শোনার। তিনি চিন্তা করলেন একটি জায়গা যদি পেতেন যেখানে মানুষ মর্যাদা নিয়ে মরতে পারবে।আর সে লক্ষ্যেই তিনি কালীঘাটে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করলেন।
শিশুদের দুঃখ কষ্ট মাদারকে খুব পীড়া দিত। তাই সার্কুলার রোডে” নির্মলা শিশু ভবন প্রতিষ্ঠা করেন। দুঃসহ অসহায় অনাথ প্রতিবন্ধী মানসিক ভারসাম্যহীন সকল শিশুর জন্য নিরাপদ আশ্রয় ছিল এটি। মাদার তেরেসা কুষ্ঠ রোগীদের জন্য একটা সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। অন্য সিস্টারদের পাশাপাশি তিনি নিজেও তাদের সেবাযত্ন করতেন। মাদার এসকল কাজ করতে গিয়ে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। দু’একটা ঘটনা তিনি বলেছেন এভাবে। একদিন ট্রামে করে হাওড়া যাচ্ছিলাম। আমাকে দেখে একজন বললেন উনি নান হিন্দুদের খৃষ্টান বানানোর চেষ্টায় আছেন।আরেক জন বলল বিদেশি যে কাজ করছেন তা টাকার জন্য নয় শুধু খৃষ্টানদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য। অনেকক্ষণ আমি চুপ করে শুনলাম তারপর বললাম আমি ভারতের, ভারত আমার দেশ। মাদার তেরেসার বিরুদ্ধে সমালোচনার কথা জানতেন মাইকেল গোমস।একদিন তিনি দেখেন একটি লরির পিছনে চাল আর ময়দার বস্তার ওপর মাদার বসে আছেন। মালগুলো ছাড়িয়ে আনার জন্য তিনি গিয়েছিলেন স্টেশনে। এসব কাজ তিনি নিজেই করেন। তার কোন ক্লিয়ার এজেন্ট ছিল না। মাদার তেরেসা মিশনারী অব চ্যারিটি’ প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৫৮ সালে।পৃথিবীর অনেক দেশে এই প্রতিষ্ঠানটি তার কাজ পরিচালনা করছে। এরপর আর মাদার তেরেসাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানায় তাদের দেশ সফরের জন্য। ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ে আহত মানুষদের দেখতে তিনি বাংলাদেশ সফর করেন। ১৯৬২ সালে ভারত সরকার মাদার তেরেসাকে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭১ সালে ষষ্ঠ পোপ পলের হাত থেকে গ্রহণ করেন ২৩ তম পোপ জন শান্তি পুরস্কার। ১৯৭১ সালে জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অ্যাওয়ার্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং পুরস্কারে ভূষিত করা হয় মাদার তেরেসাকে। প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পুরস্কার দেওয়া হয় ১৯৮৫ সালে।বালজান পুরস্কার দেওয়া হয় ১৯৭৮ সালে।
১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর মাদার তেরেসাকে নোবেল পুরস্কার” প্রদান করা হয়। পুরস্কার গ্রহনের বত্তৃতায় মাদার তেরেসা বলেন, এক নারীকে রাস্তা থেকে আমি তুলে এনেছিলাম। মারা যাচ্ছিলেন সেই নারী।আমি তাকে কালীঘাটে মুমূর্ষুদের ভবনে নিয়ে সিস্টারদের বললাম আমি নিজেই তার দেখাশোনা করবো। আমার ভালোবাসা দিয়ে তার জন্য যা কিছু করতে পারি তাই করলাম।তাকে বিছানাই শুইয়ে দিলাম। কি সুন্দর একটি হাসি তার মুখে। আমার হাতটি নিজের হাতে চেপে ধরে একটি মাত্র কথা তিনি বললেন, ধন্যবাদ তারপরই তার মৃত্যু হলো।
তার পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে আত্মপরীক্ষা করতেই হলো।আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম তার জায়গায় আমি হলে কি বলতাম। উত্তরটা খুব সহজ। আমি বলতাম,আমার খিদে পেয়েছে, আমি মারা যাচ্ছি, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ইত্যাদি। কিন্তু তিনি আমাকে অনেক দিলেন, সকৃতজ্ঞ ভালোবাসা দিলেন।
পাশ্চাত্যের দারিদ্র্যের কথাও বলেন তিনি, সারা পৃথিবীতে, শুধু গরীব দেশেই নয়, পাশ্চাত্য দেশেও আমি এমন দারিদ্র্য দেখেছি যা দূর করা অনেক বেশি কঠিন। রাস্তা থেকে কোন একজনকে হয়তো তুললাম,সে হয়তো ক্ষুধার্ত তাকে খাদ্য দিলাম,ক্ষুধা দূর হলো।কিন্তু যে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন, নিজের মধ্যে নিজে বন্দী,কেউ যাকে চায় না,ভালোবাসে না,একটা আতঙ্কের মধ্যে যে বাস করে,সমাজ যাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।তার দারিদ্র্য অনেক বেশি হানিকর এবং তা দূর করা অনেক বেশি কঠিন। এ রকম সব মানুষকে নিয়েও আমি কাজ করছি।
পুরস্কার প্রদান উপলক্ষ্যে নোবেল শান্তি কমিটি একটি ভোজ সভার আয়োজন করেন। মাদার তেরেসা সেই ভোজসভা বাতিল করেন। ফলে যে টাকা বাঁচে তা যাদের সত্যিকার খাদ্যের প্রয়োজন তাদের দিয়ে দিতে কমিটির সবাইকে রাজি করান। মাদার তেরেসাকে অমর করে রাখার সবচেয়ে বড় প্রয়াসটা জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার।বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে যারা খাদ্য পৌঁছে দেন তাদের স্বীকৃতি হিসেবে দেওয়া হয় সেরেসা মেডেল। এই মেডেলের এক পিঠে রয়েছে ভিক্ষার পাত্র হাতে অপুষ্টিতে ভুগা এক শিশুর মূর্তি। অপর পিঠে মাদার তেরেসার ছবি।
১৯৮৯ সালে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মাথা ঘুরে পড়েন তিনি। সে সময় তাঁর হৃদরোগ ধরা পড়ে। বুকে পেসমেকার লাগানো হয়। কিন্তু বিশ্রাম নেয়ার একেবারেই পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি।ডাক্তারদের কথা না শুনে ছুটে বেড়াতেন দেশ থেকে দেশে। এভাবে পেরিয়ে যেতে থাকে সময়, ঘনিয়ে আসে তার অন্তিম মুহূর্ত। অবশেষে ১৯৯৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর কলকাতার মাদার হাউসে চিরনিদ্রায় ঢলে পরেন মানবতার প্রতীক মাদার তেরেসা।
মানুষ একটা সীমাবদ্ধ সময়ের জন্য পৃথিবীতে আসে। এখানে সে নানা কাজে ব্যস্ত থাকে, নানা স্মৃতি রেখে যায়- তারপর চলে যায় চিরদিনের জন্য। এটা সৃষ্টির অপরিবর্তনীয় নিয়ম। আমরা তা জানি।জন্মালে মরতেই হবে – এ কথাও অজানা নয় কারো। তবু কোন কোন মৃত্যু যেন নিঃ স্ব করে দেয় সবাইকে। মাদার তেরেসার মৃত্যু ছিল আমাদের জন্য তেমনি একটি অনুভূতি।
Posted ৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৮ আগস্ট ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh