সেতারা কবির সেতু | বৃহস্পতিবার, ১৯ নভেম্বর ২০২০
ছোট বেলা থেকেই ঈদে বা কোন অনুষ্ঠান উপলক্ষে কেনাকাটা করার জন্য আব্বার সাথে আমরা দুই বোন শপিং এ যেতাম। বরাবরই আব্বা আমাদের মতামতের গুরুত্ব দিতো। আমাদের পছন্দের কাপড় কিনে দিতো। আমাদের কেনাকাটার পর আব্বাকে দেখতাম আরো অনেক কাপড় কিনছে। কিন্তু একই কাপড় দুইটা করে। খুব আগ্রহ নিয়ে আব্বাকে জিজ্ঞেস করি এই কাপড়গুলো কাদের জন্য। আব্বা হাসিমুখে বলে তোমরাতো কিনেছ, তোমাদের দাদা বাড়ির সবার এবং নানা বাড়ির সবার জন্য কেনা হয়নি। তাদের জন্য কিনলাম। খুব অবাক হতাম ভেবে যে, মা একবরো বলেনি নানার বাড়ির জন্য কেনাকাটা করতে। আব্বা নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই করেছে। বিস্মিত হয়ে আব্বার দিকে তাকিয়ে থাকি, যেমন শাড়ি আব্বা তার মায়ের জন্য কিনেছে ঠিক তেমনি শাড়ি শাশুড়ির জন্যও কিনেছে। সেই সাথে আব্বা চাচাতো ও ফুফাতো ভাই বোনদের জন্য যা কিনেছে মামাতো ও খালাতো ভাইবোনদের জন্যও একই জিনিস কিনেছে। কারোও ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য করেনি।
আমার বিয়ের পর ঈদের সময় শপিং এ গেলাম। আমাদের জন্য কেনাকাটার পর শাশুড়ি ও আমার মায়ের জন্য শাড়ি কিনলাম। ননদ, দেবরের পরিবারের জন্য কেনাকাটা করলাম। বাসায় আসার পর বর আমার কেনাকাটা দেখে একটু হলেও অবাক হয়। কারন সে আমাকে বলেনি তার পরিবারের জন্য কিনতে। পরের দিন দেখি সে আমার ভাই, বোনের জন্যও কেনাকাটা করে এনেছে। আমার মা যখন ঢাকায় আসে এবং চলে যাওয়ার সময় আমি মায়ের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনে দেই সেই সাথে শাশুড়ির যা কিছু প্রয়োজন সেগুলোও মায়ের হাতে শাশুড়ির জন্য পাঠিয়ে দেই। বিষয়টি বরের মনে হয় খুব পছন্দ হয়। বর যখন বাহিরে যায় তখন আমার শাশুড়ির জন্য যা কিছু কিনেঠিক একই জিনিস আমার মায়ের জন্যও কিনে। খুবই ভালো লাগার বিষয় হচ্ছে আমাদের কাত্তকেই কখনো বলতে হয় না তোমার পরিবারের পাশাপাশি আমার পরিবারের জন্যও কেনাকাটা করো। আমরা নিজের থেকেই এই কাজগুলো করে থাকি।
আমি মনে করি, জীবনে চলার পথে কিছু ছোট, ছোট কাজ একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধি করে। ভালোবাসার বন্ধনকে দৃঢ় করে। স্বার্থপর হয়ে বেঁচে থাকার নাম জীবন নয়, সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার নামই জীবন।
আমি যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি তখন আমার বড় বোনের বিয়ে হয়। আপা আব্বার খুব আহ্লাদি মেয়ে। আমাকে সাথে নিয়ে আব্বা প্রায় আপাকে দেখতে যেত। আপার বিয়ে হয় যৌথ পরিবারে। আব্বা আপার বাড়িতে যাওয়ার সময় অনেককিছু নিয়ে যেত। আপা যা কিছু পছন্দ করে তার সবকিছুই থাকতো।কিন্তু খুব অবাক হতাম আব্বা কোন খাবার আপার হাতে দিতো না।সবকিছু আপার শাশুড়ির হাতে দিত। আব্বা আগে আপার শ্বশুর, শাশুড়ির সাথে দেখা করে বেশ কিছুক্ষণ সেখানে থাকার পর উপরে আপার রুমে যেত। আমি জানতাম আপা এ নিয়ে কোনকিছু আব্বাকে বলতে পারবে না। বললে আব্বা হয়তো আর কখনোই আপার বাড়িতে যাবে না।
পরে অবশ্য আপার শাশুড়ি আপার পছন্দের খাবার আপাকে দিত। একমাত্র ছোটবোন হওয়ার কারনে আমি আপার বাড়িতে থাকতাম বেশি। অবাক হতাম আব্বা যাওয়ার কথা শুনলে আপার শ্বশুর, শাশুড়ি ব্যস্ত হতেন আব্বা কি পছন্দ করে সেই খাবারগুলো রান্না করতো।
ছোট হলেও বিষয়টি আমি বুঝতে পারি। খাবার এখানে মূল বিষয় না। কাওকে সম্মান দেওয়া,গুরুত্ব দেওয়াই প্রধান বিষয়। যা সম্পর্কের বন্ধনকে দৃঢ় করে।
আমার বিয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত আমিও এই কাজটি করে আসছি। আমার বাড়ি থেকে কেও কিছু আনলে আমি সেগুলো আমার শাশুড়ির হাতে দেই।এমনকি তার ছেলেও কিছু আনলে আমি সেগুলো শাশুড়ির হাতে দিয়ে বলি সবাইকে দিয়ে যা থাকবে আপনি রাখেন। আমি জানি বিষয়টি হয়তো তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। কিন্তু একজন মা যে এতে কতোটা খুশি হয় সেই বিষয়টি অন্তরকে ছুঁয়ে যায়।
এবার আমার ছেলের কথা বলি। গতবছরের ঘটনা। ছেলে তখন প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। ছেলেকে স্কুল থেকে একদিন বাসায় নিয়ে আসছি। রাস্তায় আমি কিছু ফল কিনেছিলাম। বাসার সামনে পরিচিত কয়েকজন ছিল আমি তাদেরকে একটি করে ফল দেই। কিন্তু ওখানে সবজি বিক্রেতা ছিল তাকে আমি দেইনি। ছেলে বিষয়টি লক্ষ্য করেছে। আমাকে একটু সাইডে নিয়ে বলে মা একসাথে যতোজন থাকে সবাইকে খাবার দিতে হয়। কাত্তকে বাদ দিতে হয়না। একজনকে না দিলে তার মনটা খারাপ হয়। বেশ কিছুদিন আগে ছেলের বন্ধু আর তার ছোট ভাই আমাদের বাসায় এসেছিল। পিচ্চিটা খুব দুষ্টুমি করছিল। আমি পিচ্চিটাকে একটু শাসন করছিলাম। আমার ছেলে পাশ থেকে আমাকে বলে মা ওরা এখন আমাদের গেস্ট। গেস্টের সাথেতো কখনোই খারাপ আচরণ করতে হয় না। তাহলে আল্লাহ খুশি হবেন না। অবাক হলাম সেই কবে ছেলেকে কথাগুলো বলেছিলাম এখনো ছেলে মনে রেখেছে।
বলা যায় ছেলে বড়ই হয়েছে ক্যাম্পাসে। একদিন সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে আইসক্রিম খাওয়ার সময় কয়েকজন পথশিশু আসে। আমি ওদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে চলে যেতে বলি। ছেলে ওদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দৌড়ে তার বাবার কাছে গিয়ে বলে তাকে আরোও কিছু আইসক্রিম কিনে দিতে হবে। পরে সে আইসক্রিমগুলো ঐ বাচ্চাগুলোকে দিয়ে দেয়। আমি ছেলের দিকে তাকাতেই সে আমাকে বলে মা ওরাতো আমার বয়সী। আমার আইসক্রিম পছন্দের হলে তাদেরও পছন্দের। আমি মনে করি, পরিবার হচ্ছে প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর বাবা,মা হচ্ছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। শিশুর সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। শিশু নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা পেয়ে থাকে পরিবার থেকে। তাই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সচেতন থাকা উচিৎ শিশুদের সুষ্ঠু বিকাশের ক্ষেত্রে।সবার বোঝা উচিৎ যে,ভালো ছাত্র হওয়ার ইঁদুর দৌড়ের বদলে ভালো মানুষ হওয়াটা বেশি জরুরী।
Posted ১০:৪৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৯ নভেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh