সেতারা কবির সেতু | বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারি ২০২১
হাসপাতালে মূল দরজায় আকস্মিক ভাবে দাঁড়িয়ে যায় খলিল সাহেবের স্ত্রী। তার পা যেন আটকে যায়। কিছুতেই ভিতরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। মনের মধ্যে হাজারো চিন্তার উদয় হচ্ছে। ভাবছে, সেই অসুস্হ লোকটি কি আসলেই তিনি। কি হলো তার, বড় কোন সমস্যা হয়নিতো। ঠিক তখনই মেয়ে তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, কি হলো মা! তুমি এখানে দাঁড়িয়ে গেলে কেন? ভিতরে যাবে না। তিনি কিছুই বলতে পারছে না, মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়ে এক প্রকার জোর করেই তাকে ভিতরে নিয়ে যায়। রতন ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে বাসস্ট্যান্টে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া রোগী কোথায় আছে?
ডাক্তার যা বললো, সেটা শোনার জন্য তারা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ডাক্তার বললো, কিছুক্ষণ আগেই সেই রোগী মারা গেছে। আপনারা কি রোগীর আত্নীয়? কেউ কিছু বলতে পারছে না। খলিল সাহেবের স্ত্রী উচ্চ স্বরে কাঁদতে থাকে। দুই ছেলে মায়ের কাছে এসে আস্তে করে বলে, মা তুমি এতো কান্নাকাটি করো না। আগে দেখি তিনি বাবা কিনা। ছোট বোনকে বলে, তুই মাকে দেখ, আমরা লাস ঘরে গিয়ে দেখছি। কিন্তু খলিল সাহেবের স্ত্রী কারো কথা শুনতে রাজি না। তিনি নিজেই যাবেন। ছেলেমেয়েরা তাকে ধরে ট্রেতে শুয়ে রাখা লাসের সামনে নিয়ে যায়। সাদা কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা। মুখের কারড় সরানোর সাহস করো হচ্ছে না। রতন কাপড়টা সরালে খলিল সাহেবের মেয়ে উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠে এবং মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মা আল্লাহর অনেক রহমত উনি বাবা না।
বাবা বেঁচে আছে। নিশ্চয়য় বাড়ি ফিরে আসবে। তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো মা। বাবা এসে আমাদের দেখতে না পেলে অস্থির হবে। তখনো খলিল সাহেবের স্ত্রী সেই মুখটির দিকে নির্বাক হয়ে থাকিয়ে আছে। মেয়ে এবার উচ্চ স্বরে বলে উঠলো, কি হলো মা কথা বলছো না কেন? বাড়ি যাবে না। মেয়ের কথায় যেন চেতন ফিরে পায় তিনি। মেয়েকে বলে, হ্যাঁ তাড়াতাড়ি চল। বাড়ি ফিরে দেখে বড় মেয়ে ছাড়া বাকি তিন মেয়ে বাড়ি এসেছে। কিছুক্ষণ পরই বড় মেয়ে চলে আসে। বড় মেয়েকে দেখে খলিল সাহেবের স্ত্রী দৌড়ে মেয়ের কাছে গিয়ে বলে, তোদের বাবাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি কোথায় আছেন, কিভাবে আছেন কিছুই জানিনা। আমি আর ভাবতে পারছি না। বড় মেয়ে মাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে বলে, তুমি শান্ত্ব হও মা। বাবা ভালো আছে, সুস্হ আছে। কিছুক্ষণ পরই চলে আসবে।
খলিল সাহেব দুপুর তিনটার দিকে বাড়ি আসলেন। তাকে দেখেই তার স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা সবাই দৌড়ে তার কাছে আসলো। সবাই খলিল সাহেবকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। আশেপাশের সকল মানুষ বাড়িতে এসেছে। সবাই বার, বার জিজ্ঞেস করছে কোথায় ছিলেন খলিল সাহেব? খলিল সাহেবের স্ত্রী স্বামীর হাতদুটি ধরে বলতে থাকে, আমাকে ছেড়ে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? একবারও আমার কথা মনে হয়নি, এতোটা বছর আমি আপনার সাথে আছি আর আজ আপনি…। আর কিছু বলতে পারলো না গলাটা তার ভারী হয়ে আসছে। খলিল সাহেব কারো কোন কথার উত্তর দিলেন না। নিজ হাতে স্ত্রীর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো তুমি আমার সাথে ঘরে আসো। কিছুক্ষণ পর খলিল সাহেব এবং তার স্ত্রী ঘর থেকে বাহিরে আসলেন।
বড় ছেলে খলিল সাহেবের কাছে গিয়ে বললো, বাবা আপনি কেন এমন করেন? আপনাকে আমরা যেভাবে বলি আপনি কেন সেই কথা শুনতে চান না। সেই সাথে ছোট ছেলে বলে উঠলো, আপনি জানেন বাবা, আপনার চিন্তায় আমরা কতোটা অস্হির ছিলাম। আড়তে যেতে পারিনি। আপনিতো জানেন একদিন আড়তে না গেলে কতোটা ক্ষতি হয়। খলিল সাহেব ছেলেদের কথার কোন উত্তর দিলেন না। বাড়ি ভর্তি মানুষ। সবাইকে খলিল সাহেব বললেন, আপনারা শান্ত্ব হয়ে বসেন। আমি সবার সামনে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে চাই।
সবার আগ্রহ আমি কোথায় ছিলাম। আমি বৃদ্ধাশ্রমে ছিলাম। আমি মূলত সেখানে খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। সেখানে থাকা যাবে কিনা। মাত্র একদিন আমি সেখানে থেকেই অনেকের জীবনের গল্প শুনেছি। অনেকেই তাদের জীবনের সর্বশ দিয়ে ছেলেমেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু জীবনের শেষ সময়ে ছেলেমেয়ে যখন বাবা, মায়ের নিরাপদ আশ্রয় হবে তখন সেই প্রতিষ্ঠিত ছেলেমেয়ে বাবা,মাকে নিজেদের কাছে রাখে না। রাখে বৃদ্ধাশ্রমে। হায়! সেই ছেলেমেয়ে কি একবারও চিন্তা করে না এই বার্ধক্য একসময় তাদের জীবনেও আসবে। তারাও সন্তানের বাবা, মা হবে। বাবা, মা একটি সন্তানকে শিশু থেকে প্রাপ্ত বয়স পর্যন্ত বুক দিয়ে আগলে রাখতে চায়। কিন্তু ছেলেমেয়ে কেন তা বুঝতে পারে না। আবেগ তাড়িত হয়ে অনেক কথা বললাম, এবার মূল কথায় আসি।
সবাই কৌতূহলী। একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। খলিল সাহেব সবার অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটালেন। সবার উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, আগামীকাল থেকে আড়তে আমি যাবো। ঠিক তখনই বড় ছেলে বলে উঠলো, বাবা কি বলছেন এসব আপনি? খলিল সাহেব একটু রাগান্বিত হয়ে বললেন, তোমাকে তো কথা বলতে বলিনি। আমি আমার সিদ্ধান্ত সকলকে জানাচ্ছি। কারোও মতামত নিচ্ছি না। সবাই নীরব। যেন সেই তেজস্বী খলিল সাহেবকে দেখছে। খলিল সাহেব আবারো বলা শুরু করলো, ছেলেদের বললো, কাল থেকে তোমরা আড়তে যাবে না। এতোদিন কি করেছ তার সকল হিসেব তোমরা রাতে আমাকে দিবে। আমি তোমাদের দুই ভাইকে ব্যবসার জন্য কিছু পুঁজি দিবো তা দিয়ে তোমরা তোমাদের মতো ব্যবসা করবে। বড় ছেলেকে বললো, তুমি নতুন ফ্ল্যাট কিনেছ আশা করি দ্রুত সেখানে চলে যাবে। তারপর ছোট ছেলেকে বললো, তুমি চলে যেতে চাইলে চলে যেতে পারো আর এখানে থাকলেও আমার কোন আপত্তি নেই। তবে আলাদা খাবে।
এরপর মেয়েদের উদ্দেশ্যে খলিল সাহেব বললো, আমি কাউকে বঞ্চিত করবো না। আমর যে সম্পদ রয়েছে তার এক অংশ আমি তোমাদের সবাইকে সমানভাবে ভাগ করে দিবো। আর বাকি দুই অংশের মধ্যে এক অংশ আমার আর এক অংশ তোমাদের মায়ের নামে থাকবে। এখন তোমাদের প্রশ্ন হতে পারে আমাদের অংশটা আমরা কি করবো? আমরা দুইজন সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা একটি বৃদ্ধাশ্রম করবো। যে সকল বাবা মায়ের সমাজের প্রতিষ্ঠিত সন্তানদের কাছে আশ্রয় হয় না সেসকল বাবা, মা এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকবে। এরপর খলিল সাহেব ছোট মেয়েকে তার কাছে ডেকে বলে, মা আমাদের একটি ইচ্ছে তোমাকে বলতে চাই। ছোট মেয়ে বাবা মায়ের হাত ধরে বলে তোমরা নিশ্চিন্তে বলতে পারো। আমরা যে বৃদ্ধাশ্রম করবো সেটার দায়িত্ব আমরা তোমাকে দিতে চাই। আমাদের অবর্তমানে তুমিই সেটা সুন্দর ভাবে পরিচালনা করবে। বাবা, মায়ের কথা শুনে ছোট মেয়ে চোখ বয়ে পানি পড়তে থাকে। সে শুধু বলে আমি কি পারবো এতো বড় দায়িত্ব পালন করতে। তুমি পারবে, সেই বিশ্বাস আমার আছে। তাইতো দায়িত্ব তোমাকে দিলাম মা।
চারপাশটা নীরব। সবাই বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে খলিল সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে। খলিল সাহেব সবার উদ্দেশ্যে বললো, আমি আমার সিদ্ধান্তে অটুট থাকবো। আশা করি সবাই আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিবে। কারো কোন আপত্তি থাকবে না। সবাই এতোক্ষণ ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনেছেন। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। আর বেশিক্ষণ আপনাদের আটকে রাখবো না। আর দুই মিনিট সময় নিবো সবার।
জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছি আমি। বিভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, আপনার জীবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু একজন উওম জীবনসঙ্গী। আপনার সন্তানকে আপনি জীবনের শেষ অবলম্বন করে বেঁচে থাকতে চান। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মেই তাদের সাথে আপনার দূরত্ব সৃষ্টি হবে। সন্তান যতো বড় হবে তাদের ব্যস্ততা বেড়ে যাবে। একসময় তারা নিজেদের মতো করে থাকবে। যেখানে বৃদ্ধ বাবা, মাকে বড্ড বেমানান লাগবে। কিন্তু আপনার জীবনসঙ্গী সুখে, দুঃখে আপনার পাশে থাকবে। আজ আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, আমার কোন দুঃখ নেই। আমি এই সমাজের অবহেলিত পিতা, মাতার জন্য কিছু করতে পেরেছি। (সমাপ্ত)
Posted ১০:০১ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারি ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh