মো. জামিন আহমেদ | মঙ্গলবার, ২৩ জুন ২০২০
সম্প্রতি প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে সড়ক-কাঠামো নির্মাণ করে ভারত। যুদ্ধ শুরু হলে সৈন্যদের রসদ পরিবহনে এ রাস্তা ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি চীনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার ভারত লিপুলেখের সঙ্গে তিব্বতের মানস সরোবর যাওয়ার নতুন রাস্তা তৈরি করে যাতে নেপাল প্রতিবাদ জানায়। অথচ দুই বছর ধরে রাস্তা নির্মাণের কাজ চললেও নেপাল কিছু বলেনি। এ রাস্তা নির্মাণের কাজটি হালকাভাবে নেয়নি চীনও। কেননা এ রাস্তাটি ভারত-নেপাল-চীন সীমান্তে এসে মিশেছে যা ভৌগোলিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নেপালে কেপি ওলির সরকার যখন গদিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় পড়ে তখন ভারতের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেপালের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায় চীন। এতে কেপি ওলির সরকারের সঙ্গে চীনের দহরম মহরম সম্পর্ক স্থাপিত হয়। মূলত চীনের আশকারা পেয়েই নেপাল ভারতের উত্তরাখণ্ডের বিতর্কিত তিনটি এলাকা নিজেদের মানচিত্র অন্তর্ভুক্ত করার মতো দুঃসাহস দেখায়। সীমান্তে নেপালি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ভারতীয় নাগরিক নিহত হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে।
এ বছরের মে মাসের শেষে বিতর্কিত লাদাখ সীমান্তে সেনা সমাবেশ ঘটায় চীন-ভারত। সীমান্তে চলমান উত্তেজনার মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতকে শিল্পোন্নত দেশগুলোর সংগঠন জি-৭-এ অন্তর্ভুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়ায় রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয় বেইজিং। চীনা সরকারের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত গ্লোবাল টাইমস দাবি করে, চীনের প্রভাব কমাতেই জি-৭ সম্প্রসারিত করার কূটকৌশল গ্রহণ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। পত্রিকাটি ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকারকে ক্ষমতালোভী বলেও কটাক্ষ করে। ভারতে বেশ কিছু সংগঠন চীনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালালেও বিজেপি সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলেও পত্রিকাটি উল্লেখ করে। জুনের প্রথম দিকে সীমান্তে টানটান উত্তেজনার মধ্যেই ভারতের বিরুদ্ধে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ভারত আগুন নিয়ে খেলছে, তাদের ভুগতে হবেই। এর কিছুদিন পরই ভারতীয় সেনার ওপর চীনা সেনাদের হামলার খবর পাওয়া যায়।
ভারত-চীনের মধ্যকার এই সংঘাত নতুন কিছু নয়। ১৯৬২ সালে অরুণাচল ও আকসাই চীন নিয়ে দুই দেশের সীমান্তে যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধে চীনা আর্মি এ দুইটি অঞ্চল দখল করে নেয়। পরে অবশ্য আকসাই চীন দখলে রেখে দেয় চীন এবং অরুণাচলকে ভারতের কাছে ফেরত দিয়ে দেয়।
১৯৬৭ সালে নাথুলা ও চাওলার যুদ্ধে ধরাশায়ী হয় চীন। চীন এ যুদ্ধে ভারতের কাছে পরাজিত হয়।
১৯৮৭ সালে অরুণাচলের সুলুলা ও বুমলাতে দুই দেশের সেনা মুখোমুখি হয়। ভারতের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী এন ভি তিওয়ারি বেইজিং গেলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। অনেক দিন পর ২০১৩ সালে আবার নিয়ন্ত্রণ রেখায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এর পরের বছর ডেমকে ও চুমারে বাঁধ নির্মাণকে কেন্দ্র করে ফের অশান্ত হয়ে ওঠে সীমান্ত।
২০১৫ সালে উত্তর লাদাখের বুর্তসেতে চীনা ঘাঁটি নিয়ে দুই দেশ মারমুখী অবস্থানে চলে যায়। ২০১৭ সালের জুনে ডোকালামে ৭৩ দিন ধরে দুই বাহিনী মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। পরের বছর আগস্ট মাসে ডেমচকে চীনা তাঁবু নির্মাণকে কেন্দ্র করেও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে নিয়ন্ত্রণ রেখা। ২০১৯ সালে পূর্ব লাদাখে ভারত সামরিক মহড়া চালালে চীন তাতে আপত্তি জানায়।
সর্বশেষ এ বছরের মে মাসের শেষের দিকে পেংগং লেকের পাশে পাথর ছোড়াছুড়ি ও হাতাহাতিতে জড়ায় দুই দেশের বাহিনী। এরপর সিকিমে দুই দেশের সেনা আবার মুখোমুখি হয়। এ সময় ট্রাম্প মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেন। তাতে কোনো পক্ষই সায় দেয়নি। উত্তেজনার মধ্যেই চীনা রাষ্ট্রদূতের সুর নরমের খবর পাওয়া যায়। এতে সবাই ভাবল শান্তির বাতাস মনে হয় চীন-ভারতে বইতে শুরু করেছে; কিন্তু সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে অনেকটা আচমকা চীন ভারতীয় সেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হতাহত হয় বহু সৈন্য।
রাশিয়ার সঙ্গে অনেক দিন ধরে চীনের সখ্যতা। মিয়ানমার ও পাকিস্তান চীনপন্থি- এটা কারো কাছে অজানা নয়। নেপাল ও ভারত দুইটি হিন্দু প্রধান দেশ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে ভারত নেপালে অঘোষিত স্থল অবরোধ আরোপ করলে নেপালকে ভীষণ নাস্তানাবুদ হতে হয়। সেটি নেপাল ভুলে যায়নি। দীর্ঘদিন ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও নেপাল চীন বলয়ে যোগ দেয়। ভারতের অতি নিকটবর্তী তিন প্রতিবেশীকে হাত করে ফেলার ঘটনাটি নিঃসন্দেহে চীনের কূটনীতিক সাফল্য বহন করে। ফলে যুদ্ধে জড়ালে তাদের কাছ থেকে সাহায্য পাবে চীন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট নয়।
যুদ্ধ কখনো শান্তি বয়ে আনতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে একটি যুদ্ধে হারে দুই পক্ষই! কারো ক্ষতি কম হয়, কারো হয় বেশি। আমরা চাই এশীয় অঞ্চলে শান্তির সুবাতাস বয়ে যাক। যুদ্ধ নয় আমরা শান্তি চাই।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Posted ৭:৪০ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৩ জুন ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh