ড. মাহবুব হাসান | বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০
‘কাজ নেই তো খৈ ভাঁজ’ বলে একটা কথা আমাদের দেশে চালু আছে। এর আসল মানে কি, তা আমি জানি না। তবে এটুকু বুঝি যে এর সোজাসাপ্টা অর্থ হলো কিছু না কিছু করো। অলসভাবে বসে থেকো না। অলস বা আলস্য, আলসেমি করে জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করো না। এই কথাটা যারা সৃষ্টি করেছিলো তাদের উদ্দেশ্য যে সাধিত হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তারা এটা কখনোই ভেবে দেখেননি যে কাজ না থাকলেও আছে অন্য কাজ, আসলে তা মাথার কাজ। মাথা তো কাজ করে। তাই যাকে অলসভাবে বসে থাকতে দেখা যায়, তিনি যে বসে থাকেন না, ভেতরে যে কাজ চলছে, তা তো আর দেখে না কেউ বা দেখানো সম্ভব হয় না, তাই বোধহয় ‘খৈ’ ভাঁজার কথাটা সামাজিক মানুষ বলেছেন। আমি ওই খৈ ভাঁজার বাইরের মানুষ। আমি শিওর না, তবে মনে হয়, প্রত্যেক মানুষ চায় এই দুনিয়াটা দেখতে। আমি তো তাদেরই একজন। দুনিয়া দেখার লোভ আছে আমার। কিন্তু যাকে বলে আর্থিক সামর্থ, তা নেই। মানে ট্যাকের জোর নেই। আর বয়স তো শেষ হয়ে এলো প্রায়। সময় কোথায় যে দুনিয়া ঘুরে দেখে মনের আশ মেটাবো?
করোনাকাল মহামারি হলেও কিছুটা সুযোগ করে দিয়েছে আমাকে। সেটা লেখার সুযোগ আর ঘোরাঘুরির সুযোগ। মহামারি করোনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আমরা বেড়ানোর তরিকায় নেমে পড়েছি। মনে ক্ষুধা মেটানো দরকার।
এখানে আমার কয়েকজন প্রিয় মানুষের সাথে সেই আশ মেটানোর সুযোগ হচ্ছে। আগে তেমনভাবে হয়নি। আগে একবার জহিরের সাথে গেছিলাম বস্টনে, বেড়াতে। সাথে ছিলো আমার বন্ধু রাগীব আহসান। রাগীব এখন শনিবারেও ব্যস্ত, তার কাজ নিয়ে। আর আমি তো আলস্যে ব্যস্ত। কদাচ লেখা নিয়ে পড়ি সেলফোনের স্ক্রিনে। ছোটো স্ক্রিন, কিন্তু তার হৃদপিন্ডটি অনেক বড়। আমার আবর্জনাগুলো ধরে রেখেছে সে বিনা দ্বিধায়। গত কয়েক সপ্তাহে বেশ কয়েকটি পার্কে ঘুরতে, বেড়াতে গেছি জহির ও মুক্তির সৌজন্যে। সাথে ছিলেন মন্জু ভাই, মনি ভাবী, ফৌজিয়া আর আমি। গত বছর , সামারে একদিন আমরা গেছিলাম বাড়ির কাছের আরশিনগর ক্যানিংহাম পার্কে। গান, কবিতা আবৃত্তি আর আড্ডায় মেতেছিলাম আমরা। কিন্তু এখন গান হলেও কবিতা মানে-মধ্যে পড়া হয়। সেদিন, মানে গত শনিবার ১৯ সেপ্টেম্বর আমরা গেলাম নাসাও কাউন্টির ওয়ানটাগ পার্কে। বেশ বড়ই বলতে হবে এর আকার। আর এই পার্কের লাগোয়া একটি বিশাল লেগুন, সেখানে বোট নিয়ে অনেকেই দৌড়াচ্ছে। আমরা পারে দাঁড়িয়ে /বসে দেখলাম সেই আনন্দ, আর উপভোগ করলাম দিনটিকে।
ভেবেছিলাম আজকে আর গাড়ির বাইরে বেরুতে পারবো না, সকালের ঝড়ো-হাওয়ার ঝাপটায় মনটা খারাপই হলো। যেতে যেতে মুক্তি বললেন, বাতাস কমে যাবে। ডোন্ট অরি। তিনি যে নিউ ইয়র্কের বাতাসেরও মন পড়তে পারেন কিংবা উল্টো করে বলা যেতে পারে, এখানকার বাতাসও মুক্তির মন পড়তে পারে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওয়ানটাগ পার্কে পৌছানোর পর দেখলাম বাতাস অনেকটাই শান্ত হয়ে এসেছে বাধ্য ছাত্রের মতো। লেগুনের কাছাকাছি একটি গাছের ছায়াকে জাড়িয়ে নিয়ে একটি টেবিল দখলে নিলাম। সব গোছগাছ করে প্রথমেই চা-এর সাথে টোস্ট ও সফ্ট বিস্কিট। আশেপাশে একচক্কর ঘুরে এসে জহির তার সেলফোন থেকে গান ছাড়লো। সাথে ছিলো তার একটি ছোটো সাউন্ড বক্স। পুরোনো দিনের গান। দিল খোলা সেই সব গানের সাথে রোদের শ্মশ্রুষা চললো কিছুক্ষণ। নভো ও জল ক্রিসবি খেলছে। ফৌজিয়ার কথা চলছে ক্যামেলিয়াকে নিয়ে। ক্যামেলিয়া এসে উঠেছিলো ওর ফ্লাটে, দিন কয়েকের জন্য। তিনি নাকি অ্যারিজোনা থেকে এখানে এসেছেন। ক্যামেলিয়াকে আমি চিনি সেই ৭২ সাল থেকে। তিনিও আমাকে চেনেন। দীর্ঘদিন তার সাথে আমার দেখা নেই। বছর বারো আগে জাতীয় প্রেসক্লাবে, এক প্রোগ্রামে তার সাথে দেখো হয়েছিলো আমার। এই চ্যাপ্টার ক্লোজ হতে সময় লাগলো অনেক। এর মধ্যে খাদ্য গ্রহণের তাগিদ এলো। কারণ ভোনা খিচুড়ি আর গরুর গোস্ত ঠান্ডা হয়ে গেলে আর খাওয়া যাবে না। খাবার শেষ করতেই নভো একটা কেক বের করলো। ওর মা মুক্তি বললো কি মমতার সাথে, সারাদিন খেটে সে এই কেক বানিয়েছে তার আন্টি মনি ভাবীর জন্মদিন উপলক্ষ্যে।
এবং আমার মনে পড়লো সেই সত্য, যা আমি ভুলে গেছিলাম। আমার বৌভাত ( আমরা বলি বৌখুদা—আমার খুব প্রিয় একটি খাবার। আমার ছেলেবেলা ভরে আছে বৌখুদা খাওয়ার স্মৃতিতে।) আর ডিমভাজি আনার কথা ছিলো। কিন্তু কপালে না থাকলে তা ঠিক রাখে কার সাধ্য? মনজু ভাই ফোন করে জানালেন মনিভাবী ভোনা খিচুড়ি নিচ্ছেন গুরুর মাংসও তার সাথে আছে। আমি ভেবে দেখলাম, তাহলে আমার কোনো পারটিসিপেশন থাকছে না। তাই একটা কোল্ডড্রিংস-এর বড় বোতল আর পান নিলাম। পরে দেখলাম ফৌজিয়া তার ব্যাগ নিয়ে নামতে পারছে না। তিনি যে কি কি নিয়ে চলেছেন আল্লা মালুম।
দুপুরের ভোজনপর্ব শেষ হলে আমরা তিন বীরপুরুষ হন্টনে বেরুলাম। আমরা যে দিক দিয়ে ঢুকেছিলাম সেই দিকে, তবে পার্কের ডান সাইডের ক্রিকের পাড় ধরে, নলখাগড়ার ঝোপের পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকলাম এবং টের পেলাম কতো বড়ো আর কতো ভাগে বিভক্ত এই পার্ক-ব্যবস্থা। সেখানে আছে শিশুদের শেখার জন্য একটি ছোটো গল্ফকোর্সও।কয়েকটি শিশু গল্ফ প্র্যাকটিস করছে। আছে বেসবল খেলার মাঠ।অনেকেই খেলছে সেখানে। প্রচুর ভিড় বলা ঠিক হবে না, তবে অনেক পরিবারই এসেছে উইন্ডের সুবাদে। আমাদের চারপাশের টেবিলগুলো ভরা মানুষে। ঠিক পাশের একটি টেবলে একটি আফগানি পরিবার এসেছে জন্মদিনের পার্টি করতে। আমাদের ডানদিকের আরেকটি পারিবার পাকিস্তানি, তারপরের পরিবারটি বাংলাদেশের, একটি স্কাউট গ্রুপও আছে আমাদের থেকে একটু সামনে,পশ্চিমে। সব মিলে পার্ক জমজমাট।
আমরা এবার গেলাম লেগুনের পারে। সেখানে বসার বেষ্ণ আছে। নলখাগড়ার ঝোপও আছে কিছু। আর স্বচ্ছজলে ক্ষুদে ডানকানার মতো মাছও। পশ্চিম দিকে রেলিং দেয়া জায়গায় কিছু লোক বড়শি ফেলে মাছ ধরছে। জানি না তারা কিছু ধরতে পেরেছে কি না।
কিছুটা ক্লান্ত বোধ করতেই পারি। কিন্তু তার চেয়েও ভালো লাগছে বেন্চে বসে বোটগুলোর ছুটে চলার খেলা। কে যেন বললো এক ঘন্টার বোট-সার্ফিংয়ের জন্য দুইশ ডলার চার্জ করে। এটা টু -মাচ। বেলা গড়িয়ে পশ্চিমের বাড়িগুলোর ওপর এখন। লেক পারের বা লেগুনের পারের বাড়িগুলোর নাকি বেশ দাম। আমার জানা নেই। জানার আগ্রহ নেই।
ছবি তোলার কথা তো বলা হলো না। এগুলো না দেখাতে পারলে পাঠক বুঝবেন না, কি সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে ওই পার্কে। আল্লার দুনিয়ার অপরুপ সৌন্দর্য দেখার সাধ আমার কোনোদিনই মিটবে না। এতো নিখুঁত তার সৃষ্টি এতো মনেহারী তার আয়োজন, হায় খোদা তুমি যদি তাকত দিতে তোমার এই ক্রিয়েশন দেখার, আমি ধন্য হতাম। আজকে বুঝি, তোমার সৃষ্টির চেয়ে তুমি কতো বড়, আর কতো মহান। তোমাকে কোটি কোটি শুকরিয়া।
# ০৯/২২/২০২০ #
নিউ ইয়র্ক
Posted ৩:৩৬ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh