ড. মাহবুব হাসান | বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই ২০২০
অর্থাৎ কুকুর দেখে সেই রকম মুগুর ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। আপনি এই কথাটা যে কোনো ক্ষেত্রেই ব্যবহার করতে পারেন, যদি তার অন্তর্নিহিত মানে অনুভব করা যায়। আমি যদি বলি বাংলাদেশের জনগণ যেমন ঠিক তেমনই দেশের সরকার। অনেকে মানবেন, কেউ কেউ মানবেন না। জনগণের সাহসের ওপরই নির্ভর করে সরকারগুলো তাদের কাজ (কুকাজ) করে থাকে। জনগণের সাহস নেই, এটা তো আমরা বলতে পারি না। অন্তত মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে (বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরের কথা বলছি, সাহস অতীতে আরো ভালো ছিলো।) গত ৪৯ বছরে আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ধীরে ধীরে কমে গেছে। আমরা গা বাঁচিয়ে কেমন করে চলতে হবে, তা শিখেছি। কিন্তু পাকিস্তানি শাসনামলে আমরা আরো বেশি সাহসী ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধটা প্রমাণ করেছে সেই অসম শক্তির মধ্যেকার যুদ্ধে সাহসটাই ছিলো আমাদের মূলধন। আর আজ আমাদের মূলধন হচ্ছে পলায়নপরতা। পালিয়ে যতটা বাঁচা যায়,। সেই পথ ধরেই কি মানুষ শিখেছে ‘আপন প্রাণ বাঁচা বা নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ –এই প্রবাদ-কথন? কে জানে।
বাংলাদেশ আর ইন্ডিয়ার মধ্যেকার সম্পর্ক ওই যেমন কুকুর/তেমন মুগুরের মতো। ভারত আমাদের কি চোখে দেখে, সেটা তাদের হাতে থাকা মুগুর (আমাদের জন্য ) দেখলেই বোঝা যায়। আবার ভারতকে দেখে আমাদের হাতে সেই মাপের মুগুর ওঠে আসে। মানে ভারতকে বিশাল শক্তির দেশ হিসেবে আমরা মনে করি। আর সে কারণে আমাদের হাতের মুগুরটার সাইজও সেই রকমই হয়ে থাকে।
এ-কথাগুলো বললাম এ-জন্য যে গত ৪৯ বছরে ‘শ্রেষ্ঠতম’ বন্ধুরাষ্ট্র যারা মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলো, কি রকম আচরণ করেছে আমাদের সাথে তার বহু নমুনা আমি না লিখলেও পাঠকের মনে ভেসে উঠবে। বিশেষ করে সীমান্তে গুলি চালিয়ে বাংলাদেশি হত্যা তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক প্র্যাকটিসের অন্তর্গত। কিন্তু সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি সরকারগুলো মিউ মিউ করে বা নিশ্চুপ থাকে।
দিন কয়েক আগেও পাঁচজন গরু ব্যবসায়ীকে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছে। বিজিবি পতাকা বৈঠকের আয়োজন করেছে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিবাদ জানানো হবে এবং তারা শুনবেন এবং বলবেন ওরা গরুর চোরাকারবারি ছিলো। এই উত্তর শুনে আমাদের বিজিবি নেতারা নিশ্চুপ হয়ে যাবেন। কারণ তারা তো অপরাধী ছিলো, ভাববেন তারা। অর্থাৎ চোরাকারবারি হলে সে বা তারা হত্যযোগ্য। আর সেই যোগ্য কাজটিই করেছে বিএসএফ।
প্রশ্ন হচ্ছে গরুর চোরাকারবারি কি মানুষ নন? গরুর কারবারি কি গরু যে তাকে কোরবানি, গুলিতে ঝাজরা করলে তা অপরাধের হবে না? বিএসএফর এমন জবাব আমরা ৪০ বছর ধরেই শুনে আসছি। তারা বলে থাকে, বাংলাদেশিরা আমাদের সীমানায় ঢুকে পড়েছিলো। ঢুকে পড়লেই তাকে বা তাদের গুলি চালিয়ে বা পিটিয়ে মেরে ফেলাটা কি বৈধ কাজ?
তারা তাই মনে করে। আমাদের দেশের শাসকরাও তাই মনে করে। একবার এক মন্ত্রী বলে ফেলেছিলেন –আমাদের লোকেরা ওদের সীনায় যায় কেন? তারা সীমান্ত রক্ষায় গুলি চালালে আমরা কি করতে পারি? তাদের দায়িত্ব তাদের সীমানা রক্ষা করা।
কথায় যুক্তির অভাব নেই, অকাট্য যুক্তি। যা মূলত কুযুক্তি। কিন্তু পৃথিবীতে যুক্তির উর্ধ্বে কিছু সত্য আছে, যা লঙ্ঘন করা অন্যায়। আর নেই অন্যায়টাই ভারত নির্বিঘ্নচিত্তে করছে। কারণ কুকুরটার স্বভাব ক্যাউ ক্যাউ করার, সে কামড়ানোর সাহস রাখে না। তাই বিশাল মুগুরটা নিয়ে সীমান্তে এসে দাঁড়ায় দাদাদের খুনি স্কোয়ার্ড। আমরা ভয়ে বিড়াল-ছানা। তার ওপরে ৭১-এর বন্ধু। যেন খুন করার তাদের রাজনৈতিক অধিকার জন্মেছে সেই থেকেই। কেউ এর প্রিতিবাদ করলেই, ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে করা বললেই তারা এবং বাংলাদেশি ভারতীয় অনুচররা প্রতিবাদকারীকে চিহিৃত করে পাকিস্তানি দালাল বা রাজাকার বলে। ইন্ডিয়ার হত্যাযজ্ঞের বিরোধিতা মানেই পাকি-দালাল! ভাবুন একবার। কতো নিম্নমানের দালাল তারা। হত্যাকারীর কোনো দোষ নেই। দোষ কেবল প্রতিবাদকারীর। সেই পাকিস্তানি শাসক ইমরান খানের সাথে কথা বলতে কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো অসুবিধা হয় না। কারণ তিনি রাষ্ট্রনায়ক। তিনি প্রটোকল মেইনটেইন করেই কথা বলেন, এটাই ভব্যতা। তাই তিনি পাকি দালাল হন না। তিনি যে বিএসএফের হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলেন না, সোচ্চার ভূমিকা নেন না, তাতে কোনো দোষ নেই তাঁর। সে-কথা বরতেও দেবে না। বুয়েটের এক শিক্ষার্থী ফাহাদ ফেসবুকে ভারতের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দিযেছিলো। তাকে তারই চারপাশের শিক্ষার্থীরা পিটিয়ে হত্যা করেছে। ভাবুন একবার, ভারতের হয়ে কেমন তরো কাজ করতে কসুর করে না ওই যুবকেরা। কেন করছে? তাদেরকে শেখানো হচ্ছে যে ভারতের স্বার্হানি ঘটলে তা বাংলাদেশের বিরোধী মক্তির কাজ। অর্থাৎ তারা রাজাকার, তারা পাকিস্তানি দালাল। কিন্তু তারা যে ভারতের পক্ষে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে তাতে তারা ভারতের দালাল হচ্ছে না এবং খুনিও বলা হচ্ছে না।
কিন্তু ভারতের ক্ষুদ্র প্রতিবেশী ল্যান্ডলক নেপাল ও ভূটান সরকার কিন্তু সীমান্তে দাদাগিরি করার বিরোধিতা জানিয়েছে জোরগলায়। ভেঙে দিয়েছে ভারতের পোঁতা সীমানা পিলার। বলেছে ভারত তার আগ্রাসী আচরণ বন্ধ করতে না পারলে খবর করে দেবে। ভারত কোনো জবাব দেয়নি। তবে ভারতপন্থীদের বিশ্লেষণ হচ্ছে—নিশ্চয় এ-দুটি রাষ্ট্রের পেছনে আছে চীন। কিন্তু এ-কথা সত্যতা মেলেনি এখনতক। চীনের সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এটা ধারণজাত মন্তব্য। বা চাটুকারদের বিশ্লেষণ।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে ভূটান ও নেপালের চেয়ে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টের দিক থেকে অনেক ভালো। বিশেষ করে পৃথিবীর পরাশক্তিগুলোর জন্য বাংলাদেশ তাদের টার্গেটের মধ্যে আছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত অনেক বড়। প্রায় তিনদিক থেকেই ঘিরে আছে ভারত। সে চায় বাংলাদেশকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে। কিন্তু তার হিংস্র স্বভাব ও দাদাগিরির জন্য বাংলাদেশের আমজনতা তাদের বিরোধী। যদিও কালচারাল আগ্রাসনের মাধ্যমে ব্রেন ওয়াস করে অনেক দালাল সৃষ্টি করেছে ভারত।পাশাপাশি তাদের ৩৬ হাজার লোককে বাংলাদেশে চাকরির সুবাদে পাঠিয়েছে, যারা অধিকাংশই বেনওয়াসের কাজে লিপ্ত। কালচারাল সেক্টরে তারা দখল নিয়েছে অনেকটাই। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে এখনো সফল হতে পারেনি। অন্যদিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশকে তাদের প্রভাব বলয়ের মধ্যে রাখতে চায়। কারণ তার প্রধান শত্রু দেশ ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ-দুটি দেশ চনের অর্থনৈতিক শক্তি রোধ করতে, সামরিক সমৃদ্ধি রোধে তৎপর। চীনকে শাসন রাখতে ব্যর্থ যুক্তরাষ্ট্র ওই দেশটির চিরদিনের শত্রূ ভারতের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করেছে। আবার ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের এ-রকম অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে চীন ভিন্ন পথ নিয়েছে। আর তাহলো বাংলাদেশের সামরিক ও সামাজিক উন্নয়নের শরিক হয়েছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ও সামাজিক উন্নয়নের অবকাঠামো খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ চীনকে বাংলাদেশের বন্ধু দেশে পরিণত করেছে। অথচ বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতে ৭৫ সালের আগে চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। সেই চীনই বাংলাদেশের এখন প্রধান বন্ধু দেশ। আর যারা ‘শ্রেষ্ঠবন্ধু ‘ দেশ, তারা সীমান্তে প্রতি সপ্তাহেই গুলি করে বাংলাদেশি-মানুষ হত্যা করে চলেছে।
আমাদের দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা যে মানসিকভাবে দেশের জনগণকে রিপ্রেজেন্ট করতে ব্যর্থ, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এ-জন্যই রাজনৈতিক মানুষদের সাহসহীনতার কথা বলেছি। কালচারাল হেগেমনির শিকার আমরা। আমরা যদি আমাদের আত্মপরিচয় না জানি, প্রকৃত সত্য উচ্চারণ না করি, যদি না বুঝি কোনটা আমাদের সংস্কৃতি তাহলে ভারতের অধিপত্যবাদি কালচার আমাদের শোষণ করে নি:স্ব করে দেবে। আমরা হারাবো আত্মপরিচয় ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাথে ভৌগলিক স্বাধীনতাও।
০৭/২৭/২০২০
নিউ ইয়র্ক
Posted ৯:৫৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh