ড. মাহবুব হাসান | শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০
আনন্দে সময় কাটানোর জন্য নিজেকে তৈরি করতে হয়। সেটা মানসিকভাবে নিজেকে সাজানো। আমি রোজ একবার না একবার আনন্দের খোঁজে নিজেকে বাইরে নিয়ে
যেতে চাই। বাইরে বেরুলেই যে আনন্দ এসে করজোড়ে ধরা দেবে, এমনটা ভাবা ঠিক না, বরং নিজেকেই নমিত-শমিত করে তোলা দরকার এই আনন্দ-ধ্যানীর কাছে। সেই আনন্দধ্যানী বাস করে এই মহানগরে, পার্ক আর লেকে সাজানো প্রকৃতির মধ্যে। সামারে নিউ ইয়র্কবাসী হলিডেগুলোতে বেরিয়ে পড়ে সমুদ্র উপকূলে, সী-বীচের মনোরম সমুদ্র হাওয়ার নিচে বালুকা বেলায়, কিংবা পার্কের ঘনসবুজ আঙিনায় আনন্দ বিনোদনে।। নিউ ইয়র্কার’দের দলে আমি ভিড়ে যাই কোনো কোনো দিন।
ম্যানহাটানে যখন কাজ করতাম, তখন যাওয়া হতো ছোট্টো বায়ান্ট পার্কে। পাশে সেই পরম কামনার ধন সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরী, বিস্ময়করভাবে ওই লাইব্রেরী আরেক ধ্যানী জায়গা আমার কাছে।পার্কের টান এর আরো কারণ আছে। প্রথম যখন যাই আমি একা একা ঘুরতে, দুপুরের রোদে ঠান্ডা পানীয় আর গাছের নিচে শ্মশুষাময় ছায়ায় বসে তৃপ্তি পেয়েছিলাম। আর পার্কের প্রোগ্রাম ফোল্ডার খুলে তো আমার চোখ চরক গাছ। কোনো এক মঙ্গল বা বুধবারে আছে ‘রিডিংরুমে’স্বরচিত কবিতা পাঠের প্রোগ্রাম। আমি জহিরকে জানালাম সে-কথা। তিনিও এলেন সেই প্রোগ্রামে। পরিচিত হলাম কয়েকজন তরুণ কবির সাথে। ওরা নিজেদের কবিতা পাঠ করলেন। তাদের একজনের নাম কাজিম আলী। মিশরের লোক। ইউনির্ভাসিটি অব ক্যালিফোরনিয়ার, সান ডিয়েগো ক্যাম্পাসে তিনি ট্রান্সন্যাশনাল লিটেরেচার এ্যান্ড ক্রিয়েটিভ রাইটিংসের অধ্যাপক। সেদিন বেশ আনন্দেই কাটলো আমাদের।
ওখানে যাওয়ার আরো যে সব টান কাজ করতো, তার মধ্যে রয়েছে অনেক সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম। কবিতা পাঠ, গান, ছবিসহ আরো অনেক রকম খেলাধুলায় জমজমাট থাকে ব্রায়ান্ট পার্ক। আর দ্বিতীয় আকর্ষণ ছিলো সেন্ট্রাল পার্ক। তার হৃদয়ের মাঝখানে আছে জ্যাকুলিন ওন্যাসিস পন্ড। গোটা পার্কের চারপাশেই বিভিন্ন গাছের বাগান। ঘাসের গালিচায় বসে আড্ডার একটি বড় উৎস সেন্ট্রাল পা্র্েকর বিভিন্ন স্পট। আমি, মাযহার আর আজাদের স্মৃতির মধ্যে শুয়ে আছে সেন্ট্রাল পার্কের সুশীল দুপুর।
আনন্দের দিনগুলো নিরানন্দ হতে দেরি লাগে না। করোনাভাইরাস আমাদের জীবনকে অনেকটাই স্থবির করে দিয়েছিলো। এখন কিছুটা ভালো পরিস্থিতি। জনগণ বলছে ‘ থাকবো নাকো আর বদ্ধ ঘরে/ দেখবো ঘুরে জগৎটাকে।’
আজ আমি বের হলাম সেই আনন্দধ্বনির জন্য, যা অপেক্ষা করছে যেন আমারই জন্য বেলমন্ট লেক স্টেট পার্ক। আমাকে তুলে নিয়ে কাজী জহির গেলেন মনজু ভাইকে তুলতে। তার পর আমরা ছুটে চললাম প্রায় ৩০ মাইল দূরে সাফোক কাউন্ট্রিতে, বেলমন্ট লেক স্টেট পার্কের উদ্দেশে। আজকে জহিরের দুই মেয়েই আমাদের সাথে আছে। কিন্তু আজকে যাচ্ছে না নাজমী-দম্পতি, ফজলুর রহমান ও ভাবীও। তাদের নাকি জরুরি কাজ পড়ে গেছে।
গত সপ্তাহে আমরা গিয়েছিলাম এলিপন্ড পার্কে। সেদিন ছিলেন মানবাধিকার কর্মী কাজী ফৌজিয়া, ফজলুর রহমান ও ভাবী, মনজু ভাই ও মনি ভাবী, রাজিয়া নাজমী ও ফেরদৌস নাজমী দম্পতি এবং কাজী জহিরুল ইসলাম ও মুক্তি জহির দম্পতি। ওদিন তাদের দুই কন্যা সারাফ জল ও নভোকে সঙ্গে নেয়নি।
সারপ্রাইজ হিসেবে কালকে আমি আমের ভর্তা বানিয়ে নিয়ে গেছিলাম। এই আইটেম হতে পারে তা হয়তো কেউ ভাবেননি। তাই সবাই উল্লসিত হলেন। গত রোববারটি ছিলো ঝকঝকে রোদে ভরা দিন। টিকিট কেটে যখন পার্কের পার্কিয়ে ঢুকলাম, আমার মনটা ভরে গেলো গাছ-গাছালির ঘনসবুজ দোলায়। বাতাস গাছের পাতায় পাতায় নাচছিলো। খোলামেলা জায়গা আর ভেতরে বিশাল লেক, সেখানে রাজহাঁসগুলো সম্রাজ্ঞির মতো মাথা তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর রো-বোটিংয়ে চলছে নৌভ্রমণ।
আমরা লেকের পার ঘেঁষে একটি টেবিল পেলাম। সেখানেই খাবার-দাবারের ব্যাগ রেখে পাশে নিচে বিছালাম একটি চাদোয়া। সকালের নাস্তা খেলাম চিকেন স্যান্ডোইচ,তরমুজ, আমের বর্তার পর সেই ঝাল লাগা মুখে গরম চা। তারপর দল বেঁধে বেরুলাম পার্কের চারদিকে ঘুরতে। মাল-সামান সেখানেই পড়ে রইলো। জানি কেউ ছুঁয়েও দেখবে না। এলিপন্ডের ভেতরে পাকা ট্রেইল যেমন ছিলো, তেমনি কাচা ট্রেইলও। কিন্তু এ-পার্কে যতটা হাঁটলাম তার পুরোটাই পাকা ট্রেইল। জহির ও মুক্তির পার্ক সম্পর্কে জানা তথ্য বেশি। কারণ ওরা প্রায়শই এই স্টেটের বিভিন্ন পার্কে বা রিসোর্টে বেড়াতে যায় সপরিবারে। ফলে অনেক কিছুই তাদের চেনা। কিন্তু পার্ক সম্পর্কে একবারে অজ্ঞ নন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু । তিনি জানালেন পার্কের এরিয়ার মাপটি। ২৯ একরের একটি লেকসহ এ-পার্কের মোট আয়তন ৪৬৩ একর। এই পার্ক গড়ে উঠেছে ১৯৩৫ সালে। তার আগে এই জায়গাটি ছিলো মিস্টার অগাস্ট বেলমন্টের ফসল উৎপাদন, রেসকোর্স ও রেসের ঘোড়া প্রজননের খামার। পরবর্তীকালে তার ছেলে অগাস্ট বেলমন্ট জুনিয়ার এই খামার পরিচালনা করতেন। মনে হলো মনজু ভাই হোমওয়ার্ক করে এসেছেন। আমার বেশ লাগলো। আমি এদিক থেকে এক বিশিষ্ট নাদান।
পার্কে মানুষ গমগম করছে না। তাই বলে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে আনন্দপিয়াসীদের ভিড় নেই। আমরা অনেক চেষ্টার পর টেবিল পেয়েছি। রো-বোটিংয়ের জন্য, দেখলাম মানুষ, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। গোটা লেকে পনেরোটি বোট হাওয়া খাচ্ছে জলে আর বাতাসে। আর যারা আশায় বুখ বেঁধে আছে, তারা বিকেল ৪টার পর আর বোটিংয়ের সুযোগ পাবে না। ভেবেছিলাম সুযোগ পেলে, মানে সহজে সুযোগ পেলে, ভিড় না থাকলে, জনপ্রতি ১০ ডলারের টিকিট কেটে ভেসে বেড়ানোর আনন্দ নেবো। তবে সে আনন্দ মনে মনে নিলে মন্দ কী? আমার ছেলেবেলায় নৌকায়, চাঁদনি রাতে বেড়ানোর অনেক স্মৃতি আছে। বর্ষার দিনে, পাটকাটা শেষ হলে আমাদের বাড়ির সামনে জল আর জ্যোৎস্নার যে মহব্বত হতো সেখানে ছোটো ডিঙি ভাসিয়ে, শুয়ে থাকতাম আর গলা ছেড়ে গান করতাম। ওই সময় আমার কেবল রবীন্দ্রসঙ্গীতেই মগ্ন থাকতে ভালো লাগতো। আশ্চরয সেই দিনগুলো কি এই নগর বাগানের লেকে পাওয়া যাবে? জানি যাবে না, তবু এই আনন্দ যে আমি উপভোগ করতে পারছি বিশ্ব প্রকৃতির একবিন্দু, তাই বা কম কিসে?
আমাদের জীবনে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ কি জরুরি, তা যদি আমরা বুঝতাম! তাহলে আমাদের এতো ক্ষতি হতো না। সভ্যতার এই ব্যর্থতার দায় শেষ পরযন্ত আমাদেরই কাঁধে চেপে বসে আছে, যা আমরা শত চেষ্টাও নামাতে পারছি না। শুধু যদি সম্পদ গড়ার লোভটিকে অন্তর থেকে কেঁচে নামানো যেতো, তাহলেও বিশ্ব উষ্ণতার এমন খারাপ দৃশ্য দেখতে হতো না। বনভূমি নি:শেষ তো করেছি আমরা, নগরায়নের জন্য যেমন বন ধ্বংস করছি, তেমনি শিল্পায়নের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব হনন করে।
Posted ৯:১৯ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh