শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

শহীদ শাফী ইমাম রুমী

সেতারা কবির সেতু   |   বৃহস্পতিবার, ২৬ আগস্ট ২০২১

শহীদ শাফী ইমাম রুমী

রুমী যুদ্ধ যেতে চান। মাকে জানালে মা শুনে আঁতকে ওঠেন। কুড়ি বছর বয়সী একটি ছেলে যুদ্ধের কী বোঝে? অনেকের মতো রুমী ও হয়তো মা-বাবাকে না জানিয়ে লুকিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারতেন; কিন্তু লুকিয়ে বা পালিয়ে কিছু করতে নেই। সে শিক্ষা তো মা-ই দিয়েছেন। মাকে বোঝাতে লাগলেন, ‘আম্মা, দেশের এই অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত; কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় কোনো ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব; কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনো দিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও, আম্মা? মা হার মেনে বললেন, ‘দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।’ ১৯৫১ সালের ২৯ মার্চ অর্থাৎ আজকের এই দিনে শরীফ ও জাহানারা ইমামের উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে রুমী জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর যে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রুমীর জন্ম হয়, তিনি সদ্য ভূমিষ্ঠ এ শিশু সম্পর্কে তার মাকে বলেছিলেন– ‘এটি ১৯৫১ সাল। ২০ বছর পর ১৯৭১ সালে এই ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে।’

রুমী ঠিকই তার ভবিষ্যদ্বাণীর দিকে দ্রুতগতিতে এগোচ্ছিলেন। তিনি ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ১৯৬৮ সালে স্টার মার্কস নিয়ে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৭০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এ ছাড়া বিশেষ অনুমতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ক্লাস করতেন তিনি।


ব্যক্তিগত জীবনে রুমী ছিলেন তুখোড় বিতার্কিক। নানান জ্ঞানে তার মস্তিষ্ক ছিল পূর্ণ। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, উদ্যমী ও প্রাণবন্ত। ইতিমধ্যে আমেরিকার ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভর্তি হওযার সুযোগ পান রুমী। যোগ্যতার সঙ্গেই তিনি ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে সেখানে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর আদর্শগত কারণে দেশকে যুদ্ধের মধ্যে রেখে তিনি বিদেশে নিরাপদ আশ্রয়ে নিজের ক্যারিয়ারের জন্য পড়তে যাননি।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। চালায় হত্যাযজ্ঞ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্র-শিক্ষককে হত্যা করে। আশপাশের ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে মেশিনগানের গুলিতে অসহায় মানুষকে মেরে ফেলে। ২৫ মার্চের পর ঢাকা শহর ছিল নরকের মতো। যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকে আগুন আর আগুন। গোলাগুলির শব্দ আর মানুষের আর্তচিৎকার।


তিনি সেক্টর-২ এর অধীনে মেলাঘরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই সেক্টরটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন খালেদ মোশাররফ ও রশিদ হায়দার। প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি ঢাকায় ফেরত আসেন এবং ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দেন। ক্র্যাক প্লাটুন হল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী একটি সংগঠন। রুমী ও তার দলের ঢাকায় আসার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন হামলা করা। এ সময় তাকে ঝুঁকিপূর্ণ আক্রমণ পরিচালনা করতে হয় যার মধ্যে ধানমণ্ডি রোডের একটি আক্রমণ ছিল উল্লেখযোগ্য। সেখানে একটি পাকিস্তানী সেনা জিপ তাদের বহনকারী গাড়ির পিছু নিলে তিনি গাড়ির পেছনের কাচ ভেংগে “‘দেখো দেখো, একটি জিপ আমাদের অনুসরণ করছে”‘ বলে স্টেন গান ব্রাশফায়ার করেন। তার গুলিতে পাকিস্তানি জিপের ড্রাইভার নিহত হয় এবং গাড়ি ল্যাম্পপোস্টে যেয়ে ধাক্কা খায়। বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা তার গুলিতে মারা যায়। “একাত্তরের দিনগুলি ” বইটিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বর্ণনা করেছেন এভাবে, হাত বাড়িয়ে রুমীর মাথাটা বুকে টেনে বললাম, ‘রুমী। এত কম বয়স তোর, পৃথিবীর কিছুই তো দেখলি না। জীবনের কিছুই তো জানলি না।’

রুমী মুখ তুলে কী একরকম যেন হাসল। মনে হলো অনেক বেদনা সেই হাসিতে। একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন একটা কথা আছে না আম্মা? হয়তো জীবনের পুরোটা তোমাদের মতো জানি না, ভোগও করিনি, কিন্তু জীবনের যত রস-মাধুর্য, তিক্ততা-বিষ—সবকিছুর স্বাদ আমি এর মধ্যেই পেয়েছি আম্মা। যদি চলেও যাই, কোনো আক্ষেপ নিয়ে যাব না।’
কোনো আক্ষেপ নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাননি মুক্তিযোদ্ধা শাফী ইমাম রুমী বীরবিক্রম। এই কথাগুলো তিনি বলেছিলেন তাঁর মাকে ১৯৭১ সালের ২৮ আগস্ট। এর পরদিনই গভীর রাতে বাবা, ভাই, বন্ধু, চাচাতো ভাইসহ রুমীকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই সময় পাকিস্তানি জান্তার হাতে ধরা পড়ে ক্রাক প্লাটুনের দুর্র্ধষ মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম, মাসুদ সাদেক চুল্লু, আলতাফ মাহমুদ এবং তাঁর চার শ্যালক, আবুল বারক আলভী, আজাদ জুয়েল, বাশারসহ অনেকে। এমপি হোস্টেলে টর্চার সেলে নেওয়ার পর রুমী তাঁর বাবা, ভাইকে বলেছিলেন, ‘তোমরা কেউ কিছু স্বীকার করবে না। তোমরা কেউ কিছু জান না। আমি তোমাদের কিছু বলিনি। ভয়ংকর অত্যাচারেও একটি তথ্যও রুমীর কাছ থেকে বের করা যায়নি।’ ৩০ আগস্টের পর রুমী ও তার সহযোদ্ধা বদী এবং চুল্লুকে আর দেখা যায়নি।


ইয়াহিয়া খান ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলে অনেক আত্মীয় তার জন্য আবেদন করতে বলেন। কিন্তু রুমী যে বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ধরা পড়েছে, তাদের কাছেই ক্ষমা চাইতে রুমীর বাবা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী, দেশপ্রেমিক শরীফ ইমাম রাজি ছিলেন না। ২৯ মার্চ রুমির জন্মদিন। আর ১৯৭১ সালের এই দিনে অর্থাৎ রুমির জন্মদিনে তাঁর বাবা, মা তাকে আশীর্বাদ করে লিখেছিলেন, ” বজ্রের মতো হও, দীপ্ত শক্তিতে জেগে ওঠ,দেশের অপমান দূর কর, দেশবাসীকে তার যোগ্য সম্মানের আসনে বসাবার দূরূহ ব্রতে জীবন উৎসর্গ করো। ” শহীদ রুমি তাই করেছেন। দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। রুমির নাম চিরকাল জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

advertisement

Posted ১০:০১ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৬ আগস্ট ২০২১

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

গল্প : দুই বোন
গল্প : দুই বোন

(6285 বার পঠিত)

মানব পাচার কেন
মানব পাচার কেন

(1151 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.