চৌধুরী মোহাম্মদ কাজল | বৃহস্পতিবার, ১৯ আগস্ট ২০২১
যারা রবীন্দ্রনাথে ‘কাবুলীওয়ালা’ গল্পটি ও সৈয়দ মুজতবা আলীর ’দেশে বিদেশে’ বইটি পড়েছেন তারা আফগানদের সম্পর্কে কিঞ্চিত ধারনা করতে পারবেন। পেশাগত কাজে পাকিস্তান যাওয়ায়, বিভিন্ন সময়ে দেশে ও বিদেশে আফগানদের সংস্পর্শে যাওয়ার সুযোগ হওয়ায় এবং বই ও পত্রপত্রিকা পড়ে আফগানদের সম্পর্কে যৎসামান্য ধারনা আমারও হয়েছে। আফগানদের সম্পর্কে বলতে গেলে বলা যায় যদিও এদের একটি বিরাট অংশ পাকিস্তানে বসবাস করে, নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে ওরা সম্পূর্ণ আলাদা একটি জাতি। পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সাথে এদের কোন মিল নেই। ওরা নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে দক্ষিন এশীয় উপমহাদেশীয়দের সাথে মেলে না। মধ্য এশীয় দেশগুলির (যেমন উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান বা তুর্কমেনিস্তান) ককেশীয়দের সাথেই ওদের মিল বেশী।
আফগানরা হয় দীর্ঘদেহী, গায়ের রং ফর্সা। অন্য জাতের কারো সংস্পর্শে জন্ম না হলে একজন আফগান কখনোই কালো হয় না। ওদের ভাষা পশতু। ওরা প্রচন্ড বদমেজাজী, কথা বলে কম। আপনি উর্দু ছাড়াও পাকিস্তানের যে কোন অঞ্চলের ভাষার কিছু কিছু শব্দ হয়তো বুঝতে পারবেন (যেমন পাঞ্জাবী, সিন্ধী বা সিরাইকি) কিন্তু পশতু একটুও নয়। উপমহাদেশীয় অন্যান্য ভাষার চেয়ে এটি সম্পূর্ণ আলাদা। আফগানরা নিজেদের সৎ ও সাহসী বলে দাবী করলেও ইদানীং পাকিস্তানে চুরি, ছেচড়ামী, দুর্নীতি বা বাটপারীতে ওদের অবাধ অংশগ্রহন রয়েছে। যদিও পৃথিবীর সব জাতিতেই ভাল মন্দ, চোর, ছেচড়, মেধাবী ও গর্দভদের অস্তিত্ব বিদ্যমান, পাকিস্তানে ওদের মোটাদাগে ‘মাথামোটা’ বলে জ্ঞান করা হয়। আপনি যদি পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে যান প্রায়শ দেখবেন ওদের অনেকে প্রকাশ্যে বন্দুক নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। বন্দুক ওদের কাছে যেন শিশুদের খেলনা। অস্ত্র বানানোর প্রযুক্তিটা ওরা কুটির শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
এবার আসা যাক আফগানিস্তান প্রসঙ্গে। আফগানিস্তানের সবাই পশতুন নয়। ওখানকার প্রধান ভাষা হচ্ছে ফারসী ও পশতু। এছাড়া তুর্কী সহ অন্যান্য ভাষারও প্রচলন রয়েছে। এদের বেশীরভাগ প্রচন্ড রকমের গোড়া। এরা সরকারের নিয়ম কানুন মানতে চায়না। এখনও গোত্রপতিরা ওখানকার বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রন করে থাকে। ওরা ঐতিহ্যগত ভাবে সবসময় নিজেদের মধ্যে মারামারিতে লিপ্ত থাকে। একমাত্র সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধের সময়ই ওদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য তৈরী হয়েছিল। সোভিয়েতরা চলে যাওয়ার পর অবস্থা তথৈবচ। সোভিয়েতরা চলে যাওয়ার পর বিভিন্ন গোত্রের নেতারা বিভিন্ন দেশের মদদ নিয়ে আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল যে যার মত শাসন করছিল। নিজেদের মধ্যে মারামারি ও খুনোখুনিতো ছিলই। এমন সময় ব্যাপক উত্থান ঘটে তালেবানদের (১৯৯৫ সালে)। ওরা পরস্পর কলহে লিপ্ত বিভিন্ন দলগুলিকে ঝেটিয়ে বিদায় করে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে। এরপরের ইতিহাস সবার জানা। তালেবানরা বেশীদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। আফগানরা ঐতিহাসিকভাবে কষ্টসহিষ্ণু ও সাহসী যোদ্ধা। কোন বিদেশী শক্তি ওখানকার রুক্ষ পাথুরে ও পাহাড়ী অঞ্চলে গিয়ে সুবিধা করতে পারেনি। বৃটিশরা পারেনি, সোভিয়েতরা পারেনি। এবার আমেরিকাকেও ফিরে আসতে হলো। আমেরিকানরা ফিরে আসার পর আফগানিস্তানে শুরু হয়েছে দেশত্যাগের হিড়িক। সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। তালেবানরা ফিরে এসেছে এবার হয়তো জীবন বাচানো সম্ভব হবে না। কিন্তু জীবন কেন বাচবে না। তালেবানরা কি সবাইকে মেরে ফেলবে। তাহলে দেশে শাসন করবে কাদের নিয়ে। আসলে এর পেছনে রয়েছে অন্য কারন। আফগানিস্তানে এমন পরিস্থিতি নতুন নয়। আগেও এমন হয়েছে। এমনি এক পরিস্থিতিতেই সৈয়দ মুজতবা আলী বিশেষ বিমানে করে একসময় কাবুল ছেড়ে এসেছিলেন। সোভিয়েতরা চলে যাওয়ার পরও এমন হয়েছিল। তখন আফগান যোদ্ধারা সোভিয়েত সমর্থিত প্রেসিডেন্ট নজিবুল্লাহকে প্রচুর নির্যাতন করে হত্যা করেছিল। তখন অবশ্য ওদেরকে জঙ্গী বলা হতো না। বলা হতো ’মুজাহিদ’। পাশ্চিমাদের সাথে তখন সখ্যতা ছিল। এখন পাশ্চাত্যের স্বার্থে আঘাত লাগায় ওরা হয়ে গেছে জঙ্গী।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় পৃথিবীর সব দেশে, সবসময় ’রাজাকার’ শ্রেণীর একটি প্রজাতি থাকে। এরা সবসময় বিদেশী বহিরাগতদের তোষামোদ করে। নিজের দেশটাকে ওদের হাতে তুলে দিয়ে সামান্য কিছু পেয়ে (কখনও কিছু না পেয়ে) বিদেশী প্রভুদের পায়ের কাছে বসে লেজ নেড়ে তৃপ্তি অনুভব করে। আমরা ১৯৭১ এ পাকিস্তানী রাজাকারদের দেখেছি। এখন ভারতীয় রাজাকারদের দেখছি। আফগানিস্তানেও এরকম রাজাকার আছে। মজার ব্যাপার হলো বিদেশীরা চলে যাওয়ার সময় রাজাকারগুলিকে সাথে নিয়ে যায় না। মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানীরা রাজাকারদের বিপদে ফেলে চলে গিয়েছিল। পাকিস্তানী সৈন্যদের ভারত সরকার জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী জীবনের নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল্ এবং পরে পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল। কিন্তু রাজাকারদের প্রাণ গিয়েছিল জনতার হাতে মার খেয়ে। আফগান রাজাকাররাও সেরকম পরিণতিই আশঙ্কা করছে। আমেরিকানরা ওদের সব সহযোগীকে নিয়ে যাচ্ছে না। অধিকাংশকেই আফগানিস্তানে ফেলে যাচ্ছে। তাই ওদের যত ভয়।
আফগানদের দেশত্যাগের আরও একটি কারন রয়েছে। তালেবানরা যদিও গোয়াড় ও অনেকাংশে ধর্মান্ধ, তাদের বিরুদ্ধে অতিরঞ্জন ও অপপ্রচারও আছে। এদের অনেকে পাথর ছুড়ে মৃত্যুদন্ডের সমর্থক হলেও এরা নিশ্চয় সবাইকে মেরে ফেলবে না। অনেক আফগান ক্ষমতার এই পালাবদলকে বিদেশে পাড়ি জমানোর একটি সুবর্ন সুযোগ হিসেবে দেখছে। একবার যদি আমেরিকা বা ইওরোপের মাটিতে পা রাখা যায় পার্মানেন্ট রেসিডেন্স নিশ্চিত। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে পৌছাতে পারলেও সহজেই ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে বৈধভাবে থাকা যাবে অনেক বছর। তাই সবাই ছুটছে বিমানবন্দরের দিকে। পাসপোর্ট ভিসার প্রয়োজন নেই। বিমানে চড়তে পারলেই হয়। এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু অশিক্ষিত ও মাথামোটা বলে বিমানে ঝুলে যাওয়ার ঝুকিটা উপলব্ধি করতে পারছে না। তাই আকাশ থেকে পড়ে গিয়ে প্রান হারাতে হচ্ছে। অনেকে ভীড়ের নীচে পড়ে গিয়ে মরেছে, আবার আমেরিকার সৈন্যদের গুলিতেও অনেকের প্রাণ গেছে।
Posted ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৯ আগস্ট ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh