চৌধুরী মোহাম্মদ কাজল | বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট ২০২০
আমি সবসময় বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিরোধিতা করে এসেছি। র্যাব সৃষ্টির শুরুতে যখন চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ধরে ধরে মারছিল তখনও বিরোধিতা করেছি। যখন তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরাও বলতে শুরু করল র্যাব ভাল মানুষকে মারে না, বেছে বেছে শুধু খারাপ লোকদেরই মারে তখনও বিরোধিতা করেছি। র্যাব যখন মমিনুল্লাহ ডেভিডকে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রেখেছিল খুশী হইনি। যখন সন্ত্রাসী পিচ্ছি হান্নানকে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে নিয়ে ক্রয়ফায়ারে মেরে ফেলেছিল মানতে পারিনি। গতবছর রিফাত হত্যাকান্ডের অন্যতম আসামী নয়ন বন্ডকে ক্রসফায়ারে হত্যাও সমর্থন করিনি। ক্রসফায়ারের নামে মানুষ হত্যার প্রতিবাদ করেছি সবসময় (নিজস্ব অবস্থান থেকে যখন যেভাবে পেরেছি)। বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিরোধিতা করে অনেক রিপোর্ট করেছি। ফেসবুকে লিখেছি, টক শোতে বলেছি। এজন্য অনেকের বিরাগভাজন হয়েছি। তারপরও থেমে যাইনি। যা বিশ্বাস করেছি তাই লিখেছি। আমি মনে করি এটি স্বাভাবিক practice নয়। সন্ত্রাস দিয়ে সন্ত্রাস দমন করা যায় না। প্রত্যেক অপরাধীরই বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। সেই আমারতো মেজর (অবঃ) সিনহা হত্যাকান্ডের অভিযুক্তদের গ্রেফতারে খুশী হওয়ার কথা। কিন্তু ততটা উচ্ছসিত হতে পারছি না। কোথায় যেন একটা কিন্তু রয়ে গেছে।
বাংলাদেশে সম্ভবত এই প্রথম আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বন্দুক যুদ্ধে মানুষ হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। অতিদ্রুততার সাথে তাদেরকে রিমান্ডেও পাঠানো হয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান ও পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নিহতের মাকে ন্যায় বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। এগুলি কি তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে করেছেন? এখন কি আমরা আশা করতে পারবো যে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড আর হবে না? নিহত সিনহা একসময় সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি একজন সাধারন লোক হলে কি সরকার এতটা তৎপর হতো? সিনহার আগেতো হাজার হাজার লোক দেশে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। বাড়ী থেকে তুলে নিয়ে কতজনকে গুম করে ফেলা হয়েছে। কখনো সীমান্তের ওপারে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আর্মি, র্যাব ও পুলিশ সবাই একাজ করেছে। সরকার বা কোন সংস্থাকে তখন তৎপর হতে দেখিনি।
সিনহার হত্যাকান্ড ক্রসফায়ার নয়। এটি extra judicial killing হতে পারে, কিন্তু কোনভাবেই custodial death নয়। ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে আমরা চিরাচরিত যে গল্পটি শুনি তা হলো র্যাব আসামীকে নিয়ে অভিযানে যায়। তখন অভিযুক্তের উৎপেতে থাকা সঙ্গীরা আকষ্মিকভাবে র্যাবের ওপর আক্রমন করে। র্যাব আত্মরক্ষার জন্য পাল্টা গুলি ছোড়ে। আসামী তখন পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এই গল্প সামরিক বাহিনী থেকে আগত র্যাবের মিডিয়া উইং এর কর্মকর্তারা আমাদের বছরের পর বছর শুনিয়েছেন। সিনহা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হননি। তিনি গ্রেফতার হওয়ার আগেই মারা গেছেন। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী সিনহা পুলিশের তল্লাশী কাজে বাধা দিয়েছিলেন। তিনি পুলিশকে পিস্তল দেখিয়েছিলেন। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুড়েছে। সিনহার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তিনি পিস্তল দেখাননি। তিনি দুহাত উচু করে গাড়ী থেকে বের হওয়ার পর পুলিশ তাকে সরাসরি গুলি করেছে। এখন কোনটি সত্য একথা কি যাচাই করা হয়েছে?
তদন্ত কমিটি তদন্ত সম্পন্ন করার আগেই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে। পুলিশের নিশ্চয়ই আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। চোরচালানীর স্বর্গরাজ্যে দায়িত্ব পালন করার সময় যে আগ্নেয়াস্ত্র তারা বহন করে সেগুলি নিশ্চয় শো পিস নয়। আদালত পুলিশের কথা বিশ্বাস করেনি। বাদীপক্ষের কথা বিশ্বাস করেছে। কিন্তু কি এমন তথ্য প্রমান সিনহার পক্ষ থেকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছিল যে পুলিশের কথা বিবেচনায়ই নেওয়া হয়নি। কোন রূপ তদন্ত ছাড়াই সিনহার পক্ষে সবকিছুই সত্য বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন আমাকে উদ্বিগ্ন করছে।
#সিনহা ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা। তাহলে ঘটনার সময় তিনি কেন সামরিক বাহিনীর ইউনিফর্মে ছিলেন।
# চোরচালানীর জন্য আদর্শ একটি জায়গায় রাত নয়টা পর্যন্ত পাহাড়ে কি দৃশ্য ধারন করেছিলেন সিনহা। অন্ধকারে বা স্বল্প আলোয় চিত্রধারন করার মত সরঞ্জাম কি তাদের ছিল। সেই ফুটেজগুলি কি আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছিল।
# স্থানীয় লোকদের সাথে সিনহা বিতন্ডায় জড়িয়ে ছিলেন কেন? এলাকাবাসী যদি তাদের ডাকাত মনে করতো তাহলেতো তারা তাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়তো। ঝগড়া করতো না।
# রিসোর্টে থাকা সিনহার সঙ্গীদের কাছ থেকে মাদক দ্রব্য উদ্ধারের ঘটনাকে বলা হচ্ছে পুলিশের সাজানো নাটক।এর ভিত্তি কি? ওদের অতীত ইতিহাস কি যাচাই করা হয়েছে। ওদের কি ড্রাগ টেস্ট হয়েছিল।
# সিনহা হত্যার মোটিভ কি? চোরচালানের বিরুদ্ধে তিনি কি ডকুমেন্টারী বানাচ্ছিলেন? ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট কি এতই সহজ। অভিজ্ঞ সাংবাদিকরাও গলধঘর্ম হয়ে যায়। সিনহার মত একজন ’এমেচার ইউটিউবার’ কি এমন ডকুমেন্টারী বানিয়েছিলেন যে চোরাচালানীরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। তার সেই ভিডিও ফুটেজ কি দেখা হয়েছে।
# সিনহা হত্যার পর সেনা প্রধান ও আইজিপি যে আগ্রহ দেখিয়েছেন এটা কি আদালতের ওপর এক ধরনের psychological pressure নয়। আমাদের বিচারকদের কি এই চাপ উপেক্ষা করার মত মানসিক শক্তি ও সাহস আছে।
# যে সাক্ষীদের সোশাল মিডিয়ায় বক্তব্য রাখতে দেখা যাচ্ছে ওদের authenticity নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। যখন কোন ক্রসফায়ার বা খুনোখুনির ঘটনা ঘটে তখন সেখানে সাধারন মানুষকে থাকতে দেওয়া হয় না। সিনহা হত্যা যদি ঠান্ডা মাথার খুন হয়ে থাকে তাহলে পুলিশ সেখানে সাক্ষী রাখবে কেন। সাক্ষীরা এত গভীর ভাবে ঘটনা পর্যবেক্ষন করার সুযোগ পেল কিভাবে।
# পুলিশের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ফোনগুলি কারা হ্যাক করছে। তাদের কথোপকোথন সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য কি।
# আদালত কি তাহলে ওসি প্রদীপের অতীত ঘটনা বিবেচনা নিয়ে তার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছে? অভিযোগ আছে ক্রসফায়ারের নামে তিনি অতীতে দুই শতাধিক লোককে হত্যা করেছেন। কিন্তু যতদূর জানি, মামলাগুলি পধংব নু পধংব বিবেচনা করার কথা। তারপরও যদি সেগুলি বিবেচনায় নেওয়া হয় তাহলেতো প্রদীপের বিরুদ্ধে সেই সব হত্যার অভিযোগও আনার কথা, কিন্তু তার বিরুদ্ধে শুধু সিনহা হত্যার অভিযোগই আনা হয়েছে।
আমরা চাই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ হোক। মাদক চোরাচালান নির্মূল হোক। পুলিশের বিরুদ্ধে শত অভিযোগ। তারপরও পুলিশ বাহিনী ডিসব্যান্ড করার কথা কেউ বলে না। এটা সম্ভব না। বিপদে পড়লে সবাইকে এই দূর্নীতিগ্রস্থ পুলিশের দ্বারস্ত হতে হয়। এই পুলিশদের নিষ্ক্রিয় রাখতে পারলে সমাজবিরোধীদের অনেক সুবিধা। আমরা জানি মাদক চোরাচালানে সরকারের রাঘব বোয়ালরা জড়িত। তারা কখনো চাইবে না পুলিশ সৎ ও কর্মতৎপর থাকুক।
সিনহা সামরিক কর্মকর্তা হওয়ার জন্য বা অন্য কোন কারনে যদি অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের শাস্তি হয় তাহলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। অবস্থা এমন হলে কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বেপড়োয়া হয়ে ওঠবে। তাদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ালে কেউ ন্যায় বিচার পাবে না। শত অপরাধ করলেও পুলিশ তখন তাদের ধরতে যাবে না। তাই আমি মনে করি সিনহাকে এক তরফাভাবে নির্দোষ ও পুলিশের সব দাবী উপেক্ষা করা সঙ্গত নয়। পুলিশকে এভাবে হতোদ্যম করা হলে ভালো ছেলেরা পুলিশে আসতে চাইবে না। আমি বলছি না যে সিনহা দোষী বা অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা নির্দোষ। আমার বক্তব্য স্পস্ট, বিচার প্রক্রিয়া চলুক তার স্বাভাবিক গতিতে।
আমি জানি আমার এ কথা অনেকের ভাল লাগবে না। কারো ভালো লাগার জন্য আমি লিখিনি। যা লিখেছি একান্তই আমার নিজস্ব চিন্তা থেকে লিখেছি। সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে লিখেছি। এতে যদি সমাজ ও নীতি নির্ধারকরা উপকৃত হন তাহলেই যথেষ্ট।
Posted ৮:২৮ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh