সাধন সরকার | রবিবার, ২১ জুন ২০২০
বৈশিক মহামারী করোনার প্রভাবে এলোমেলো হয়ে গেছে জীবনযাত্রা। মানুষের জীবন-জীবিকা, ব্যবসাবাণিজ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। করোনার কারণে মার্চ মাস থেকে বর্তমান পর্যন্ত (তিন মাসেরও বেশি সময়) প্রায় সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বন্ধ রয়েছে। ফলে এই সময়ের মধ্যে লাখ লাখ চাকরিপ্রত্যাশীর চাকরির আবেদনের বয়স (৩০ বছর) পার হয়ে গেছে। করোনা-কালের এক একটি দিন যাচ্ছে, আর কত শত বেকার চাকরিপ্রত্যাশীর চাকরিতে আবেদনের বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে তার হিসাব কে রাখে! একজন বেকারের জীবনে চাকরির আবেদনের বয়স পার হওয়ার শেষ দিনগুলো যে কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই ভুক্তভোগীই শুধু বলতে পারবেন। এই ভয়াবহ দুর্যোগের কবে পরিসমাপ্তি ঘটবে তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল! করোনার কারণে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ফলে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে (সরকারি-বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে) সেশনজটের সম্ভাবনা বেশি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে লাখ লাখ চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণের চাকরির বয়স শেষ হওয়া এবং সম্ভাব্য সেশনজটের কথা চিন্তা করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। শুধু করোনা-কালের এ সময়ে নয়, চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবিটি দীর্ঘ দিনের। এ নিয়ে গত এক দশক ধরে জাতীয় সংসদের ভেতর-বাইরেও ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। তরুণ জনগোষ্ঠীর জোর আন্দোলনের মুখে কোনো কোনো সময় সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে চাকরিতে প্রবেশের বয়স যৌক্তিকভাবে বাড়ানোর আশ^াসও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই!
চাকরিতে যোগদানের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছিল সর্বশেষ ১৯৯১ সালে। তখন চাকরিতে যোগদানের বয়স ৩০ বছর করা হয়েছিল ২৭ থেকে বাড়িয়ে। দেশে তখন গড় আয়ু ছিল ৪৫ বছর। অতঃপর প্রায় ৩০ বছর পার হতে চলল। আমাদের গড় আয়ুও এখন বেড়ে ৭২ বছর হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার সাথে সম্পর্কিত প্রায় সবকিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ব্যবসা, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও গড় আয়ু ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এমনকি, দেশে অবসরের বয়সসীমাও বেড়েছে। কিন্তু চাকরিতে প্রবেশের বয়স আর বাড়ানো হয়নি। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বছরের পর বছর শুধু বেড়েই চলেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘বিআইডিএস ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট’র মতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সর্বোচ্চ। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন জরিপ মতে, শিক্ষিত বেকারের হার আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় এ দেশে সর্বোচ্চ। অথচ এ দেশে শিক্ষার সাথে চাকরির মিল খুব কমই। পড়ালেখা শেষ করে আলাদাভাবে চাকরির প্রস্তুতি নিতে হয় প্রত্যেক তরুণকে। পড়ালেখা শেষ করে কাক্সিক্ষত চাকরির জন্য আলাদাভাবে শ্রম ও অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। তার পরও চাকরি নামের ‘সোনার হরিণ’ কপালে জুটবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই!
তারুণ্যের শক্তি বা কর্মদক্ষতার ওপর একটি দেশ উন্নতি লাভ করে থাকে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে মর্মপীড়া কাজ করছে। সদ্য চাকরির বয়স পার হওয়া লাখ লাখ তরুণের প্রাণ গুমরে গুমরে কাঁদছে! প্রত্যেক বছর আগের বছরের চেয়ে আরো বেশি চাকরিপ্রত্যাশী বাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্র ও পদসংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে চাকরি পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে। সত্যি বলতে, মানসম্মত চাকরি পেতে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করতে করতে প্রায় ২৫-২৬ বছর লেগে যাচ্ছে! চাহিদা ও বাস্তবতা বিবেচনায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চাকরির বয়স বেড়েছে। ১৬০টিরও অধিক দেশে এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০-এর অধিক। বাস্তবতা এটাই যে, এদেশে বর্তমানে লাখ লাখ ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা আছে, সনদ আছে, কিন্তু চাকরি নেই! বয়স ৩০ পার হওয়া মানে যেন অর্জিত সার্টিফিকেটের মেয়াদ শেষ! তথ্য মতে, বর্তমানে প্রায় ২৭ লাখের বেশি কর্মক্ষম তরুণ-তরুণী বেকার। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ‘৩০’-এ বেঁধে রাখার ফলে সব শিক্ষার্থীর মেধা কি আদৌ কাজে লাগানো যাচ্ছে ?
করোনায় স্থবির হয়ে যাওয়া জীবনযাত্রা সরকার অনেক সেক্টরে প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করেছে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্ভাব্য সেশনজটের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া, করোনাকালে লাখ লাখ চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণের চাকরির বয়স বিবেচনা এবং দীর্ঘ দিনের যৌক্তিক দাবির প্রেক্ষাপটে এখনই চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ বছর করা দরকার। বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালে কোনো প্রকার ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। বরং সব পর্যায়ের তারুণ্যের মেধা কাজে লাগালে দেশ এগিয়ে যাবে, বেকারত্ব কমবে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর সুবিধাগুলো হলোÑ ১. সেশনজটের শিকার হওয়া তথা পড়ালেখা শেষ করা কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের চাকরিপ্রত্যাশী তরুণরা চাকরির পড়াশোনায় প্রস্তুতি গ্রহণে বেশি সময় পাবে। ২. উন্নত দেশগুলোর সাথে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার সমন্বয় হবে। ৩. শিক্ষিত বেকারের হার কমবে। ৪. রাষ্ট্র সব শিক্ষিত তরুণের মেধা কাজে লাগাতে পারবে। ৫. মেধা পাচার বন্ধ হবে। ৬. অপরাধপ্রবণতা কমে যাবে। ৭. রাষ্ট্র দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে বেশি সময় পাবে। ৮. তরুণরা নিজেকে গুছিয়ে নিতে যেমন সময় পাবে, তেমনি বেশি বেশি উদ্যোক্তা তৈরি হবে। ৯. গড় আয়ু অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার সমন্বয় হবে। ১০. বাস্তবতা ও চাহিদা বিবেচনায় অবসরের বয়সসীমাও বাড়ানো যাবে। ১১. শিক্ষিত তরুণদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা গেলে বিদেশ থেকে দক্ষ কর্মী আনা বন্ধ হবে এবং। ১২. সর্বোপরি, তরুণ জনগোষ্ঠী ও উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন সুদৃঢ় হবে।
লেখক : পরিবেশকর্মী
Posted ৫:১৬ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২১ জুন ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh