চৌধুরী মোহাম্মদ কাজল : | বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২২
বিশ্বকাপ ফুটবলের সাথে রাত জাগার একটি সম্পর্ক আছে। চার বছর পর পর বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আসতো সীমাহীন আনন্দ ও উত্তেজনা যা আমরা রাতজেগে উপভোগ করতাম। আমরা যখন বিশ্বকাপ দেখা শুরু করি তখন আমাদের কিশোরগঞ্জে টিভির সংখ্যা ছিল কম। গভীর রাতে দেখা যেত কয়েকটি বাড়ীতে টিম টিম বাতি জ্বলছে। অর্থাৎ সেই বাড়ীতে লোকজন খেলা দেখছে। হঠাৎ হঠাৎ গোল হলে শোনা যেত চিৎকার। যেহেতু আমরা বাসার সবাই খেলাধূলা পছন্দ করতাম আমাদের বাসায় ফুটবল দেখার জন্য প্রচুর লোক আসতো। এরপর ১৯৯০ সালে রঙ্গীন টিভির প্রসার ঘটে। বাসায় টিভি থাকার পরও আমরা তখন অন্য বাসায় গিয়ে খেলা দেখতাম রঙ্গীন বিশ্বকাপ দেখার জন্য। আরও পরে ঢাকায় কলাবাগান মাঠে গিয়ে খেলা দেখেছি জায়ান্ট স্ক্রীনে। ততদিনে মধ্যরাতে রোমাঞ্চটুকু কমে এসেছিল।
ব্যাপক বিদ্যুতায়ন ও ঝোপঝাড় কেটে ফেলায় এখন রাতের সেই নিঝুম পরিবেশটা পাওয়া যায় না। সারারাত জেগে থাকলেও গভীর রাত দেখা যায় না। স্পেনে অনুষ্ঠিত ১৯৮২ বিশ্বকাপে ম্যাচগুলি শুরু হতো রাত ১১টার পর। এরপর ১৯৮৬ সালে ম্যাক্সিকো বিশ্বকাপে খেলা শুরু হতো আরও পরে। বিশেষ করে দ্বিতীয় ম্যাচটি শুরু হতো অনেক রাতে। খেলা যদি টাইব্রেকারে গড়াতো তাহলে শেষ হতে হতে ভোর হয়ে যেত। বিশ্বকাপ শুধু একবারই আমরা দিনে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম ২০০২ সালে (যুক্তরাস্ট্রে অবশ্য আমরা দিনেই বিশ্বকাপ দেখছি)। জাপান ও কোরিয়া যৌথভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল। এবারের বিশ্বকাপের মত তখনও একটি মুসলিম দেশ তুরস্ক বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলার সুযোগ পেয়েছিল। সেমিফাইনালে ব্রাজিলের কাছে ১-০ গোলে পরাজিত হওয়ার পর তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে স্বাগতিক কোরিয়াকে ৩-২ গোলে হারিয়েছিল। সে ম্যাচে তুরস্কের হাকান সুকুর মাত্র ১১ সেকেন্ডে প্রথম গোলটি করে বিশ্বকাপে দ্রুততম গোল করার রেকর্ড করেন। তার এই রেকর্ড এখনও অক্ষুন্ন আছে। এর আগের রেকর্ডটি ছিল চেকস্লোভাকিয়ার ভেকল্যাভ ম্যাসেকের। তিনি ১৯৬২ বিশ্বকাপে ম্যাক্সিকোর বিরুদ্ধে ১৬ সেকেন্ডে গোল করেছিলেন। হাকান সুকুর ২০১৬ সালে রাজনৈতিক রোষানলে পড়ে দেশ ছেড়ে এখন যুক্তরাস্ট্রে বসবাস করছেন। কয়েক বছর আগেও তিনি আমেরিকায় ট্যাক্সি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
আশির দশকে বাংলাদেশে ক্রিকেট এতটা জনপ্রিয় ছিলনা। ফুটবলই ছিল প্রধান আকর্ষণ। আন্তর্জাতিক ফুটবল বলতে আমরা বুঝতাম বিশ্বকাপ ফুটবল। বিশ্বকাপের পুরো মাসটা আমরা আনন্দ ও উত্তেজনায় বিভোর থাকতাম। এই সময় সবত্রই চলতো ফুটবল নিয়ে আলোচনা। বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পর কয়েকটা দিন আমাদের নিরানন্দে কাটতো। টিভির মাধ্যমে গত একমাসে যে ফুটবল খেলোয়াড়রা আমাদের ঘরের মানুষ হয়ে ওঠেছিল তাদের মিস করতাম।
বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ছিল লোডশেডিং। কখন কোন খেলার সময় বিদ্যুৎ চলে যায় এজন্য সবাই শঙ্কিত থাকতো। তখন জেনারেটর বা ইউপিএস সহজলভ্য ছিল না। অবশ্য খেলাগুলি গভীর রাতে হওয়ায় আমাদের খুব বেশী সমস্যা হয়নি। তারপরও একটা ভয় সবসময় কাজ করতো। কবির ভাষায়ও ফুটে ওঠেছিল এই আশঙ্কার কথা। ইত্তেফাকে প্রকাশিত বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে রচিত কবিতায় এক কবি লিখেছিলেন ‘লোড শেডিংয়ের অত্যাচারে দেখবো কি আর বিশ্বকাপ/যে শালারা বাত্তি নেভায় ধরুক তাদের হাজার পাপ’।
কিশোরগঞ্জে ১৯৮২’র গ্রীষ্মে প্রত্যেক রোববার সন্ধ্যারাতে কিছুক্ষনের জন্য বিদ্যুৎ থাকতো না। বিশ্বকাপ ফাইনালের দিনও যখন বিদ্যুৎ ছিলনা আমরা কিছুটা আতঙ্কিত ছিলাম। যদি খেলার সময়ও বিদ্যুৎ না আসে। সেদিন একটু দেরী করেই বিদ্যুৎ এসেছিল রাত সাড়ে নয়টার দিকে। এরপর আমরা নির্বিঘ্নেই খেলা দেখতে পেরেছিলাম। এখন আমরা যারা যুক্তরাস্ট্রে বসবাস করছি দিনেই বিশ্বকাপ দেখতে পারছি। এখানে লোডশেডিংয়ের ভয়ও নেই। কিন্তু এখানকার যে লাইফস্টাইল তাতে কতজন কাজ বাদ দিয়ে খেলা দেখতে পারবে। এখন মনে হয় রাতের বিশ্বকাপই ভাল ছিল। যদিও খেলার পরদিন কস্ট হতো রাতের বেলা খেলাটা অন্তত দেখার সুযোগ ছিল।
Posted ২:৫৫ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh