ড. মাহবুব হাসান | বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট ২০২০
আসলে পুলিশ নিয়ে কিছু লেখা উচিত না। কারণ তারা এখন আর সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের রূপে নেই। তারা এখন বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। সামরিক বাহিনীর সাংগঠনিক স্ট্যাকচারের সাথে অনেকটাই মিল থাকলেও অন্যান্য বিষয়ে কোনো মিল নেই। পুলিশ সেবা দেবার কথা জনগণকে। কিন্তু পুলিশ জনগণকে সেবা তো দূরে থাক, তারা যেন জনগণের শাসক হয়ে উঠেছে। সেটা সরকারি ফরমানে নয়, নিজস্ব জৌলুশে। মিডিয়াও আজকাল লিখছে পুলিশ বাহিনী। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ খানের হত্যা ঘটনার পর আমরা টিভিতে দেখলাম সামরিক বাহিনী প্রধান ও পুলিশ প্রধানকে ‘দুই বাহিনীর প্রধান হিসেবে উল্লেখ করা হলো। সেবাদানকারী যদি বাহিনী হয়ে ওঠে, তাহলে সেখানে বিভেদ হতে বাধ্য।
আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বলে যে পুলিশকে পরিচয় দেয়া হয়ে থাকে, তাদের দায়িত্ব পড়ে আইন ও শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের শাসন করা। আইন ও শৃঙ্খলার যারা ভাঙেন, তারা ক্রিমিনাল বা সমাজের দুশমন। পুলিশের প্রতিপক্ষ তারা। কিন্তু আমরা লক্ষ করেছি পুলিশের সদস্যগণ সাংগঠনিকভাবেই মনে করেন জনগণ তাদের প্রতিপক্ষ।তাদের ওপর চড়াও হতে তাদের ব্যাপক উৎসাহ। কারণ তারা সংগঠিত নয় এবং অস্ত্রধারীও নয়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের হাতে সৃষ্ট এবং তাদের রক্ষার জন্য লাঠিয়াল হিসেবে গড়ে তোলা সংগঠনটিকে, না পাকিস্তানি আমলে, না বাংলাদেশ আমলে পরিশুদ্ধ করা হয়েছে। কেন করা হযনি সে ব্যাখ্যায় যাবো না। সে-কথায় গেলে আমাদের রাজনৈতিক সরকারগুলোর চরিত্র প্রকাশ হয়ে পড়বে। কিন্তু পুলিশের দাপটে ও তাদের কাজের নমুনা দেশের আপামর জনগণ টের পেয়ে আজ তারা বুঝতে পেরেছে যে ‘বাহিনী’ পুলিশ আর ‘কল্পিত সেবক পুলিশে’র মধ্যে কোনো মিল নেই।
বাংলাদেশের গণমানুষ হাড়ে হাড়ে জেনেছে গত ৪৯ বছরে যে পুলিশে ছুঁলে ৩৯ ঘাঁ। এটা কিন্তু নির্মমতার চিত্র থেকেই জাত হয়েছে। এটা আপনজালা নয়। পুলিশের নির্মমতা কতোটা হতে পারে, তার আপাতত শেষ নজির বাহারছড়া ফাঁড়ির চেক পোস্টে মেজর (অব.) সিনহা রাশেদ খানকে হত্যার ঘটনা। এই হত্যার ঘটনার পর অবশ্য টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকরতা প্রদীপ ও এসআই লিয়াকতকে আটক করে হেফাজতে নেয়া হয়েছে। শাদা চোখে দেখলে আমরা বুঝবো তারা বিচারের মুখোমুখির জন্য তাদের আটক করা হয়েছে। আর ভিন্ন চোখে দেখলে তাদের গণরোষ থেকে বাঁচানোর জন্য কাস্টডিতে নেয়া হয়েছে। আপনাকে/আমাকে কোনো কারণে পুলিশ ধরলে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করে ৫/১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। আর রিমান্ড মানে পুলিশি নিরযাতনের নারকীয় অত্যাচারকেই বোঝানো হয়। কিন্তু মূল আসামি হবার পরও কিন্তু প্রদীপ ও লিয়াকতকে আদালতে হাজির করা হযনি, রিমান্ড তো আরো দূরের কথা। আবার এরই পাশে আমরা দেখতে পাচ্ছি পুলিশি সংগঠনের লোকেরা ফেসবুকে নানারকম কুৎসা ও কুৎসিত বিষয় উপস্থাপন করেছে রাশেদের সাথে থাকা শিপ্রা দাশকে নিয়ে। শিপ্রা দাশের ব্যক্তিগত ছবি আপলোড করা হয়েছে যশোরের এসপির অধীনে থাকা অফিসারদের হাতে। অর্থাৎ গোটা পুলিশকেই নামিয়ে দেয়া হয়েছে রাশেদ হত্যার ঘটনাটিকে নানা মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যে ভরে দিয়ে, প্রকৃত সত্য ঢেকে ফেলতে। ঘটনা ঘটেছে বাহারছড়ায় আর জশোরে তার পুলিশি প্রতিক্রিয়ার কারণ কী তা উপলব্ধির সময় এসেছে। জনমনে এটাই তারা করতে চায় যে, শিপ্রা দাশ কোনো ভালো মেয়ে ছিলো না। কিন্তু এটা তারা ভুলে গেছেন যে ভালো- মন্দ বলে যা কিছু আমরা জানি বা চিনি, তার পেছনে যে সাংস্কৃতিক বিষয় আছে,, আছে তার গোলমেলে বিষয় ও পুরুষশাসিত সমাজের স্বার্থ, সেটা বুঝতে হবে এবং মনে রাখতে হবে। শিপ্রা ভালো কি মন্দ মেয়ে, সে বিচারের ভার তো তাদের নয়। আর শিপ্রা খারাপ বা অপরাধী হলেও তার হিউম্যান রাইটসকে টপকানো যে আরেকটি বড় অপরাধ, সেটাও কি পুলিশ জানে না। সাধারণের যেমন বিচার পাওয়ার অধিকার আছে, তেমনি খুনিরও আছে। এসআই লিয়াকত গুলি করে হত্যা করেছে বলে তাকেও গুলি করে হত্যা করতে হবে—এমনটা আমরা ভাবি না বা বলিও না। আমরা বলি বিচার সুষ্ঠু হোক সব হত্যাকান্ডের। যারা বিচারক, তারা বায়াসড হবেন না বলেই আমি মনে করি। কারণ তারা জাতির প্রতিনিধি। তারা সরকারের লোক নন। তারা বিরোধীদের লোক নন। তারা জাতির প্রতিনিধি। তবে আমরা অতীতে অনেক অপবিচার দেখেছি। এ-কারণেই আমাদের দাবি বিচার যেন ন্যায় ও সুষ্ঠু হয়।
একটি সমাজের মানসিক প্রতিচ্ছবিই ফুটে ওঠে ব্যক্তির মননে-মানসে ও তার রৈাজনৈতিক ও সামাজিক ক্রিয়াকর্মে। যারা পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি করেছিলো নিজেদের রক্ষা ও শাসকের লাঠিয়াল হিসেবে, আজকের শাসকরাও পুলিশকে সেই কাজেই ব্যবহার করছেন দলীয় রাজনৈতিক কাজে।
আমরা নিত্যই দেখি পুলিশ সরকারের নির্দেশে প্রতিবাদী জনতার ওপর বিনা উস্কানিতে ঝাপিয়ে পড়ে চিতার মতো ক্ষিপ্রতায়। প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের দমনে তারা নৃশংসতম আচরণ করে থাকে। সরকারের সেবক আজ পুলিশ। আর জনগণের জন্য তারা ত্রাস ও সরকারের রাজনৈতিক লাঠিয়াল বাহিনী। পুলিশের এই সাংগঠনিক চরিত্রের পরিবর্তন ছাড়া ‘জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী সেবক হয়ে উঠতে পারবে না পুলিশ সংগঠনটি। এর শিক্ষা কারিকুলাম ও প্রশিক্ষণাদির উপকরণেও যোগ করতে হবে হিউম্যান রাইটসের সব বিষয় আশয়।
উদাহরণ হিসেবে একটি বিদেশি পুলিশের কথা লিখবো।
প্রথমত চেকপোস্টে মেজর রাশেদকে গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে নেমে আসতে বলা হলে তিনি তাই করেন। তিনি নেমে আসার পর পরই তাকে গুলি করে এসআই লিয়াকত। পর পর দুটি। একটু পরে আরেকটি। লিয়াকত অকুস্থল থেকে প্রদীপকে ফোনে এই ঘটনা জানায়। প্রদীপ এসে আরো দুটি গুলিতে রাশেদের মৃত্যু নিশ্চিত করে। এই বর্ণনা প্রত্যক্ষদর্শীদের। এটা সন্ধ্যারাতের ঘটনা। এবং চেকপোস্টের আশে পাশেই অনেক মানুষ থাকে, নানা কারণে। তারাই টিভি মিডিয়ায় এ-কথাগুলো বলেছে। সেখানকার এক ইউপি চেয়ারম্যানেও সে কথাই বলেছেন, দেখলাম ৭১ টিভির একাত্তর জার্নালের আলোচনায়। এই আলোচনায়ই জানলাম যশোরের এসপি ও তার অধীনস্থ অফিসারদের ফেসবুক একাউন্ট থেকে শিপ্রার ব্যক্তিগত ছবি প্রকাশ করেছে। আর এই ঘটনাকে ধর্ষণের সাথে তুলনা করেছেন একজন আইনজীবী। বলেছেন এটা ‘ডিজিট্যাল বা ভার্চুয়াল রেপ’। তিনি এর মধ্যেই শিপ্রার অধিকার নিয়ে মামলা দায়ের করেছেন।
আমি ফেসবুকে একটুকরো লেখা পড়লাম একজন আইনভঙ্গকারীকে ধরবার জন্য পুলিশের ধৈরয প্রসঙ্গে। লোকটি মিশরীয়। তার ভাষায় সে ২০১০ সালে ভিসা নিয়ে ইতালিতে এসেছে। সে এর মধ্যেই বেশ কিছু অপকর্ম করেছে এবং ধরা পরে জেলেও গেছে। বেরিয়ে সে আবারো অপরাধে জড়ায়। সে একজন সিকিউরিটির লোককে জিম্মি করে নিলে তাকে থামানো ও ধরার জন্য পুলিশ আসে। সে সিকিউরিটির গান নিজের দখলে নিয়ে নেয়। অনেক পুলিশই তার চারপাশে ৮/১০ ফিটের মধ্যে। পুলিশ ইচ্ছে করলেই গুলি করতে পারে, তাকে ধরাশায়ী করতে। কিন্তু তারা তাকে সারেন্ডার করতে বলে। অনেকক্ষণ পর খুব কাছে থাকা একজন পুলিশ তাকে ঝাপটে ধরে ফেলে। এভাবেই অপরাধীকে পাকড়াও করে ইতালিয়ান পুলিশ। ইতালিয়ান পুলিশ তার পায়ে গুলি করে ধরতে পারতো সহজেই। তার বুকে গুলি চালাতে পারতো আরো সহজে। কারণ জিম্মি লোকটি নিচু হয়ে বসেছিলো, আর অপরাধী তার পাশে দাঁড়িয়ে লোকটার শার্টের কলার ধরে রেখেছিলো। এই বর্ণনা ভিডিও ক্লিপ দেখে লিখেছি।
আর আমাদের পুলিশ হলে কি এই ধৈরয দেখাতে পারতো। মানুষের জীবন যে অপরাধের চেয়েও সহস্র-লক্ষ গুণ বড়, সেটা বোঝার মতো জ্ঞান কি আমাদের নেই? আমরা কি এতোটাই বর্বর জাতি?
ক্রসফায়ারে তারা কতো নিরিহ মানুষকে যে মেরেছে, তার লেখাজোকা নেই। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লোকদের হত্যার নীল নকশা অনুযায়ী তারা গুম, আর নিখোঁজ করেছে। এই সব পুলিশি অপরাধের কোনো বিচার হয় না। কারণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের লাঠিয়াল বলেই সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো বিচারিক অ্যাকশনে যান না। তার স্বার্থই প্রধান। জনগণের টাকায় লালিতপালিত পুলিশ তাদের সেবা দেবার পরিবর্তে যম হয়ে উঠেছে যেন। জনগণ এটা চায় না। তারা চায় মানবিক এক পুলিশ সংগঠন, যারা প্রকৃত অর্থেই সেবা দেবে।
মানবিক পুলিশ ছাড়া বাংলাদেশের মানু্ষরে দুর্দশার অবসান হবে না।
Posted ৮:৩৭ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh