মাহমুদুর রহমান মানিক | রবিবার, ২১ জুন ২০২০
বিশ্বের মূল চালিকাশক্তি বাণিজ্য। বাণিজ্য প্রতিটি দেশকে নিয়ে যাচ্ছে উন্নতির শিখরে। গত কয়েক দশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বড়ো জায়গা দখল করে আছে চীন এবং চীন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি। ২০১৯ সালে দেশটির নমিনাল জিডিপির পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই সুবৃহৎ অর্থনীতি থেকে বলার অপেক্ষা রাখে না দেশটি সমৃদ্ধির কোন স্তরে অবস্থান করছে। কিন্তু চীনের বাণিজ্য এরিয়ার কাছাকাছি হয়েও বাংলাদেশ চীনের বৃহৎ অর্থনীতি থেকে বিশেষ সুবিধা এত দিন খুব বেশি আদায় করতে পারেনি। পক্ষান্তরে রপ্তানি জটিলতায় বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের তৃতীয় বৃহত্তম বাজার। আমাদের দেশের গার্মেন্টস কারখানার প্রায় ৬০ শতাংশ সুতা ও কাপড় এবং ওষুধশিল্পের ৯০ শতাংশ কাঁচামালসহ ইলেকট্রনিকস পণ্য আসে চীন থেকে। অন্যদিকে রপ্তানিযোগ্য অনেক পণ্য নিয়ে বাংলাদেশ চীনের বাজারে প্রবেশে ব্যর্থ ছিল, কিন্তু সম্প্রতি নতুন করে ৫ হাজার ১৬১টি পণ্যের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা বাংলাদেশের সেই আক্ষেপ ঘোচাতে পারে।
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড এগ্রিমেন্টের (এপিটিএ) আওতায় বাংলাদেশ ও মৌরিতানিয়া চীনে পণ্য রপ্তানিতে ৬০ শতাংশ ট্যারিফ লাইন সুবিধা পাচ্ছিল। ২০১৫ সালের জানুয়ারির আগে যেসব দেশ চীনের সঙ্গে পণ্য বিনিময় চুক্তি করেছিল সেসব দেশ ৯৭ শতাংশ এবং জানুয়ারির পরে স্বাক্ষর করেছিল সেই দেশগুলোও ৯৫ শতাংশ পণ্যে ট্যারিফ সুবিধা ভোগ করছিল; অথচ বাংলাদেশ এই সুবিধার বাইরে ছিল। বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ জুন চীনের স্টেট কাউন্সিলর ট্যারিফ কমিশন বাংলাদেশকে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুযোগ করে দিয়েছে, তা বাংলাদেশ তথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বড়ো সফলতা। দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে চীনের বাজার ধরার এটিকে প্রথম সোপন হিসেবেই বিবেচনা করা চলে। বাংলাদেশ আগামী ১ জুলাই থেকেই চীনের বাজারে হাজির হতে পারবে নতুন ৫ হাজার ১৬১টি পণ্যসহ সর্বমোট ৮ হাজার ২৫৬টি পণ্যের বিশাল সমাহার নিয়ে।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বছরের পর পর বছর ধরে চলে আসছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০০ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ১৭ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার, শুধু চীনের সঙ্গেই ছিল ১১ হাজার ১১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও প্রায় সমপরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি লক্ষ করা যায়। এই বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির অন্যতম কারণ ছিল রপ্তানিযোগ্য অনেক পণ্য চীনের বাজারে অতিরিক্ত শুল্কের জন্য প্রবেশ করতে না পারা। এখন মোট ৮ হাজার ২৫৬টি পণ্য শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুবিধা চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্যও ইতিবাচক হবে।
চীন প্রতি বছর প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ মূল্যের পণ্য বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে, কিন্তু বাংলাদেশ এই বৃহৎ বাজারে পূর্বে রপ্তানি করত মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ কোটি ডলার। চীনের বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং পাট ও পাটজাত পণ্যের বড়ো একটি বাজার রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে উপযুক্ত বাজারের অভাবে এসব শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এখন চীনা ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট ও রপ্তানি করে চীনের বাজার ধরতে পারলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত দেশি শ্রমিক-মালিক একদিকে বেঁচে যাবেন, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হবে মোটা দাগের বৈদেশিক মুদ্রা। পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।
গত ১০ বছরে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশসহ মোট ৩৩টি দেশকে ৬০ শতাংশ ট্যারিফ লাইন দিয়ে আসছিল চীন। কিন্তু বর্তমানের ৯৭ শতাংশ পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারলে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বহুবিধ উপকার ভোগ করবে। এখন দেখার বিষয়, পূর্বের ৩৫ শতাংশ মূল্য সংযোজনের সঙ্গে বর্তমানে আরো ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন করে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা এই সুবিধা কতটা কাজে লাগাতে পারেন। মুক্ত বাণিজ্যে আরো আশার বাণী হলো ভুটান, নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে চুক্তির কার্যক্রম প্রায় শেষের দিকে। অর্থাৎ এসব দেশের সঙ্গেও খুব শিগিগর শুরু হবে শুল্কমুক্ত আমদানি-রপ্তানি। এছাড়া থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার জোটের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরে বাংলাদেশের তরফ থেকে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে।
লেখক :শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Posted ৫:২৪ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২১ জুন ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh