কাজী জহিরুল ইসলাম : | বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫
তিন শূন্যের পৃথিবী গড়ার কথা ড. ইউনূস বলছেন বহুদিন ধরেই। পৃথিবীর সব বড়ো বড়ো অ্যাক্টিভিস্ট, রাষ্ট্রনায়ক, খেলোয়াড়, বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ সকলেই তার “তিন শূন্যের” ধারণাকে পছন্দ করেছেন, স্বাগত জানিয়েছেন। পৃথিবীর সেরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তিনি তিন শূন্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কী আছে এই তিন শূন্যের বয়ানে, এই বিষয়ে অন্যত্র লিখেছি, এখানেও খুব সংক্ষেপে একটু বলি। প্রথম শূন্যটি হচ্ছে – পৃথিবীতে কোনো কর্মক্ষম মানুষ বেকার থাকবে না।
অর্থাৎ বেকারত্ব শূন্য পৃথিবী। দ্বিতীয় শূন্যটি হচ্ছে – পৃথিবীতে কোনো মাত্রাতিরিক্ত সম্পদের মালিক থাকবে না। অর্থাৎ মিলিয়নিয়ার/বিলিয়নিয়ার ক্লাবগুলো ভেঙে দিতে হবে। গুটি কয়েক মানুষের হাতে পুঞ্জিভূত সম্পদ, এটিকে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। আমি খুব অবাক হই দেখে, এই কথা এতো জোরেশোরে বলার পরেও ধনতান্ত্রিক দেশ আমেরিকা, যে দেশে প্রচুর বিলিয়নিয়ারের বাস, এবং যে দেশের কয়েকজন মানুষ পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক সম্পদের মালিক, তারাও কোন সম্মোহনী শক্তির যাদুবলে তাকে এতো ভালোবাসেন, শুধু ভালোই বাসেন না, তাদের দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননায়ও তাকে ভূষিত করেন। তৃতীয় শূন্যটি হলো – পৃথিবী কার্বন এমিশন মুক্ত হবে। অর্থাৎ পৃথিবীর বাতাস হবে দূষণমুক্ত, নির্মল, শুদ্ধ। এটাও কী সম্ভব! ভাবলেই চোখ চড়কগাছে ওঠে আমাদের।
পরের দুটো থাক, আপাতত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রথম শূন্যটিকে প্রতিস্থাপন করি। অর্থাৎ আমরা একটু চোখ বন্ধ করে দেখার চেষ্টা করি বেকারত্ব মুক্ত একটি বাংলাদেশ। কেমন হবে সেই বাংলাদেশ? ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত, এবং সম্ভবত অপরাধমুক্তও। আহা এমন যদি হতো। হবে কি? হ্যাঁ, হবে। কি করে সম্ভব? সেই কথাও তিনিই, ড. ইউনূস বলেছেন। আমরা চাকরির জন্য কারো কাছে যাবো না। আমার কাজ আমি নিজেই তৈরি করবো। অন্যকে আমি চাকরি দেব। আমি হবো একজন উদ্যোক্তা। দেশের কর্মক্ষম মানুষের দশ শতাংশও যদি সফল উদ্যোক্তা হতে পারে তাহলেই তো বেকারত্বকে শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব। একজন উদ্যোক্তা কাজ দেবেন দশজনকে, ব্যাস হয়ে গেল শতভাগ মানূষের কর্মসংস্থান।
কীভাবে তরুণ প্রজন্ম উদ্যোক্তা হয়ে উঠবে? উদ্যোক্তা হবার একটি অভ্যাস এবং দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হবে। আমেরিকার কোনো তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় চাকরির স্বপ্ন দেখে না। সবাই পড়াশোনা শেষ করে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার স্বপ্ন দেখে। আমার নিজের ছেলেই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বড়ো চাকরির অফার ফিরিয়ে দিয়ে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে এবং সফলও হয়েছে। এজন্য সে তার পরিবার বা বন্ধু এমন কী ব্যাংকের কাছ থেকেও কোনো পুঁজি নেয়নি। এখন ওর প্রতিষ্ঠানেই অনেকে কাজ করে।
বাংলাদেশেও প্রচুর দৃষ্টান্ত আছে। তবে এখনো দেশের কর্মক্ষম তরুণ প্রজন্মের একটি বড়ো অংশ চাকরির মুখাপেক্ষী। তাদেরকে আমরা কীভাবে উদ্যোক্তা বানাতে পারি, এই বিষয়ে একটি ধারণার কথা বলি। এসএসসি এবং এইচএসসি এই দুই পরীক্ষার পরে যে ৩/৪ মাস করে ফ্রি সময় থাকে, এই সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে। আমরা এসএসসি পরীক্ষাটা মার্চ মাস থেকে টেনে জানুয়ারি মাসেও নিয়ে আসতে পারি, তাহলে কলেজে ভর্তি হবার আগে আরো একটু বেশি সময় পাওয়া যাবে। এই সময়ে তাদেরকে ৩ মাসের একটি প্রশিক্ষণ দিতে পারি। মূল কাজটি করবে যুব মন্ত্রণালয়, সহযোগিতায় থাকবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তারা সেনাবাহিনীর কাছ থেকে ডিসিপ্লিন শিখবে, সুন্দর করে কথা বলা শিখবে, ইংরেজি শিখবে, একজন উন্নত বিশ্বনাগরিকের এটিকেট, ম্যানার শিখবে। সেই সঙ্গে একজন উদ্যোক্তা হবার নানান কৌশল শিখবে যুব মন্ত্রনালয় কর্তৃক আয়োজিত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার মাধ্যমে।
যুব মন্ত্রণালয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল উদ্যোক্তাদের রিসোর্স পার্সন হিসেবে নিয়ে আসবে, তাদের সফলতার, স্ট্রাগলের গল্প প্রশিক্ষনার্থীদের শোনাবেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আইনানুগ দিক শেখানো হবে, কম্পিউটারের বিভিন্ন সফটওয়্যারে কাজ করা, পণ্যের বিপনন, হিসাব রক্ষণ, আয়কর প্রদান, কম্পিউটার চালানো ইত্যাদির ওপরও সিলেবাস থাকবে। তিন মাসের একটি নিবিড় আবাসিক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে তারা উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার অনেক কিছুই শিখে ফেলবে। গণস্বাস্থ্যের কর্মীদের মতো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয় কাজ, শাক-শব্জির চাষ ইত্যাদি কাজও তারা করবে। তিনমাসের এই প্রশিক্ষণ অবৈতনিক হবে না। তারা একটি প্রশিক্ষণ ভাতা পাবে। যাদের পরিবারের সামর্থ আছে তারা কলেজে ভর্তি হবে, যাদের সামর্থ নেই তারা সেই টাকাটা দিয়ে একটি ছোটো ব্যবসা শুরু করবে। কেউ চাইলে পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন ব্যবসাও শুরু করতে পারে।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে তাদেরকে দ্বিতীয় ধাপের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। একইভাবে প্রশিক্ষণ শেষে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, কেউ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে কাজ শুরু করবে, কেউ দুটোই করবে। পড়াশোনা পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবার পরে তাদের অধিকাংশই চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরবে না। নিজেরাই উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এভাবে একটি জাতির তরুণ প্রজন্মকে চাকরির মুখাপেক্ষী হওয়া থেকে রেহাই দিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার রাস্তা দেখানো যেতে পারে এবং এর মধ্য দিয়ে বেকারত্বকে শূন্যে নামিয়ে আনা যেতে পারে।
Posted ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh