শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

লিভিং ঈগল সাইফুল আজম চলে গেলেন

মোসাদ্দেক চৌধুরী আবেদ   |   বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন ২০২১

লিভিং ঈগল সাইফুল আজম চলে গেলেন

লিভিং ঈগল গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজমের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী জুন মাসে। চারটি ভিন্ন দেশের বিমান বাহিনীর হয়ে নেতৃত্বে দিয়েছেন। তিনটি ভিন্ন দেশের সামরিক সম্মাননা পেয়েছেন। একক ব্যক্তি হিসেবে আকাশ পথের যুদ্ধের ইতিহাসে সর্বউচ্চ সংখ্যক ইজরাইলি বিমান ভূপাতিত করেছেন তিনি। দুই পরাশক্তি ইজরাইল ও ভারতের বিরুদ্ধে আকাশ পথে লড়ে যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। জানলে অবাক হবেন যার কথা বলছি, আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে, কে এই সেই ব্যক্তি? তিনি হচ্ছেন একজন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অফিসার, এই বীর সেনানির নাম গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজম। ১৯৬৫ সালে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাইফুল আজম পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ১৭ নম্বর স্কোয়াড্রনে যোগ দেন। ভারতের বিমান বাহিনীর অফিসার মায়াদেবের বিমানটি তিনিই ভূপাতিত করেন। এই যুদ্ধে কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ সাইফুল আজমকে পাকিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সমাননা সিতারাই জুরাত-এ-ভূষিত করা হয় তখন। সাইফুল আজম যিনি বাংলাদেশ, পাকিস্তান, জর্ডান ও ইরাকের বিমানবাহিনীর বৈমানিকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বৈমানিক হিসেবে অসামান্য অবদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহিনী তাঁকে বিশ্বের ২২ জন ‘লিভিং ঈগলস’ এর একজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। লড়াকু এই আকাশ যোদ্ধা ১৪ই জুন ২০২০ দুপুর দেড়টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) আইসিইউ-তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। প্যালেস্টাইন, জর্ডান, ইরাকের মানুষেরা আজও ভুলে যায়নি এই বীরকে। প্যালেস্টাইনিরা তাঁর স্মরণে তাঁর ছবি হাতে নিয়ে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে মার্চ পাস্ট করেছেন। বারবার তাঁর ছবিতে চুমু খেয়েছেন। তারা অকৃতজ্ঞ না এখনো তাঁকে তারা সম্মানের সাথে মনে রেখেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে অনন্য সব অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে সাইফুল আজমকে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহিনী বিশ্বের ২২ জন ‘লিভিং ঈগলস’ এর একজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ।

সাইফুল আজমের জন্ম ১৯৪১ সালে পাবনা জেলায়। বাবার কর্মসূত্রে তাঁর শৈশবের কিছু সময় কেটেছিল কলকাতায়। ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় তাঁর পরিবার ফিরে আসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। শিক্ষালাভের জন্য ১৪ বছর বয়সে সাইফুল আজমকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয়। ১৯৫৮ সালে তিনি ভর্তি হন পাকিস্তান এয়ার ফোর্স ক্যাডেট কলেজে। দু’ বছর পর ১৯৬০ সালে তিনি পাইলট অফিসার হয়ে শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ওই বছরই জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে সাইফুল আজম যোগ দেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে। সাইফুল আজমের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ হয় মার্কিন সেনাদের প্রশিক্ষণ বিমান ‘সেসনা টি-৩৭’ বিমান দিয়ে । এরপর তিনি প্রশিক্ষণ নিতে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার লুক এয়ারফোর্স বেইসে। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬৩ সালে দেশে ফিরে সাইফুল আজম যোগ দেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ঢাকার কেন্দ্রে। পরে তিনি প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান করাচির মৌরিপুরের বিমান ঘাঁটিতে। এখানেই সাইফুল আজম ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের প্রশিক্ষক। ১৯৬৫ সালে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাইফুল আজম পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ১৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের হয়ে যোগ দেন। এই যুদ্ধে কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সাইফুল আজমকে পাকিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা ‘সিতারা-ই-জুরাত’ এ ভূষিত করা হয়। ১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসে জর্ডানের বিমানবাহিনী ‘রয়্যাল জর্ডানিয়ান এয়ার ফোর্স’-এ পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে যান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম। সেখানে তিনি জর্ডানের বিমানবাহিনীতে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন।


একক ব্যক্তি হিসেবে আকাশপথের যুদ্ধের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত করার রেকর্ডটিও তাঁর। এই কৃতিত্বের পুরস্কার স্বরূপ জর্ডান থেকে সাইফুল আজমকে ‘হুসাম-ই-ইস্তিকলাল’ সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। তাঁর কল্যানেই ইজরাইলের পর পর চারটি যুদ্ধ বিমান যুদ্ধ থেমে যায়। পাকিস্তানে ফেরার পর ১৯৬৯ সালে ‘শেনিয়াং এফ-৬’ জঙ্গি বিমানের ফ্লাইট কমান্ডার হন সাইফুল আজম । এরপর পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ‘ফাইটার লিডারস স্কুল’ এর ফ্লাইট কমান্ডারের দায়িত্ব নেন তিনি। ১৯৭১ সালে সাইফুল আজম মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের শুরুতেই তাঁর ওপর পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে সাময়িকভাবে উড্ডয়নে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান যখন পাকিস্তানের বিমানটি হাইজ্যাক করেন সাইফুল আজম মতিউর রহমানের প্রশিক্ষক ছিলেন। সেই কারনে সাইফুল আজমের ফাঁসি হয়ে যেতে পারতো। তাঁকে অনেক ইন্টারোগেশন করা হয় সে সময়। কিন্তু তিনি বেঁচে গেলেন বীরের মর্যাদা পেয়েছেন বলে।

স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে আসেন সাইফুল আজম। ১৯৭৭ সালে তিনি উইং কমান্ডার পদে উন্নীত হন। তাকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঢাকা ঘাঁটির অধিনায়ক করা হয়। বিমানবাহিনীতে ডিরেক্টর অব ফ্লাইট সেফটি ও ডিরেক্টর অব অপারেশনসের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। অবশেষে ১৯৭৯ সালে গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নেন তিনি। অবসরের পর সাইফুল আজম ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ এবং ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দুবার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। ১৯৯১-৯৬ সালে পাবনা-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাইফুল আজম। এ বীর সেনা চলে গেলেন একেবারেই নীরবে। জাতি জানে না কিছুই তিনি কে? ফেসবুকের কল্যাণে দেশবাসী প্রবাসীরা জানতে পেরেছেন তিনি কে ছিলেন। ফেসবুকের মাধ্যমে বিশ্বের মানুষেরা জেনেছেন তিনি যে মারা গেছেন। তার সম্মানে প্যালেস্টাইন জুড়ে মার্চ পাস্ট হয়েছে। ফিলিস্তিনিরা তাঁর ছবি ধরে চুমু খেয়েছেন। বিশ্বের অনেক দেশ তাকে নিয়ে আলোচনা করেছেন তাঁকে সম্মাননা জানিয়েছেন। বাংলাদেশের মিশনগুলো জানেনা সাইফুল আজম কে ছিলেন। অথচ আমরা পারলাম না এই বীর সেনানীকে শেষ সম্মানটুকুও জানাতে। আমরা কতটা নিচু মনের। হায়রে বাংলাদেশ। জাতির দুর্ভাগ্য কি এমন বীর সেনা কে মূল্যায়ন করলো না জাতি। এই দুঃখ নিয়ে তিনি চলে গেলেন।


আহা! কি করলাম আমরা জাতি হিসেবে। জাতি তার জন্য কিছুই করলো না দেখে অবশেষে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী সাইফুল আজমকে বুকে টেনে নিলেন। গার্ড অফ অনার দিয়ে যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান জানিয়ে তাকে চিরদিনের জন্য বিদায় জানালেন। এ জন্য বাংলাদেশ বিমান বাহিনী কে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা জানাই। জাতি তাকে সম্মান জানাতে পারেনি তাতে কি হয়েছে, সারাবিশ্বে সাইফুল আজমের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। কত অকৃতজ্ঞ জাতি আমরা, মানুষ হিসেবে মানুষের যে দাম দেই না তার প্রমান আবারও পাওয়া গেছে। এমন ঘৃণ্য আচরণ দুঃখজনক। আমাদের দেশের মানুষের এমন আচরণ পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায় কিনা তা জানা নেই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সোনার ছেলে নাসিম এর জন্য সংসদে কাঁদলেন, সাইফুল আজম সোনার ছেলে না হোক রুপার ছেলে ভেবেও না হয় একটু চোখের জল ফেলতেন। দেশের মানুষ আপনাকে হৃদয়ে স্থান করে রাখার সুযোগ করে দিতেন। কেন প্রমাণ করতে চান আপনি যে আওয়ামী লীগের। দয়া করে একটু দেখান না দেখি আপনি দেশের সবার। আমরা একটু শান্তির নিশ্বাস ফেলে একটু ভরসা নিতে পারি।


বিএনপি ক্ষমতায় ছিল কই তারা কি করলো। তারাও তো পারতেন। পারলো না কেন? জ্ঞানের অভাব, তারাও বোধহয় জানতেন না তিনি কে ছিলেন। এমন বীরকে মূল্য দিতে কার্পণ্য কত! কেন আপনারা পারলেন না জাতির বীরের সম্মান জানাতে। যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, জর্ডান তাকে সম্মানের পর সম্মান জানালেন। যুক্তরাষ্ট্র লিভিং ঈগল উপাধিতে ভূষিত করলেন। নিজের দেশের এই বীর সন্তানকে আপনারা কি দিলেন। মনের অভাব যোগ্যতার অভাব। কেন পারলেন না এই মানুষটিকে দুটি সিনিয়রিটি দিয়ে সম্মানটুকু জানাতে। তাঁর মৃত্যুর পর আপনাদের একটু আলোচনাও শুনলাম না।

এটাকে কি রাজনীতি বলে। আপনারা তো নিজের দলের লোকদেরই খোঁজ নেন না তারা কি আছে না মরেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুরোধ আপনাকে, লিভিং ঈগল সাইফুল আজম কোনো দলের নয় তিনি রাষ্ট্রের সম্পত্তি। এই বীরকে যথাযোগ্য বীরের মর্যাদা দিন। ইতিহাস সৃষ্টি করুন। জাতির কাছে এর মূল্য পাবেন। আদর্শের প্রতীক হয়ে দাঁড়ান। জীবিত কালে যাকে মূল্য দিল না কেউ মরনের পরে হলেও তাঁর সমাধি রচনা করে জাতিকে সম্মানিত করে ইতিহাস সৃষ্টি করুন। আপনার সম্মান বেড়ে যাবে বহুগুণে। দেশ-বিদেশের সম্মানিত অতিথিরা এসে দেখে যাক এ জাতি বীরের মর্যাদা দিতে জানে। যে জাতি বীরের মর্যাদা দিতে জানে সে জাতি মরে না কখনো। আপনার মাধ্যমে সাইফুল আজমের সমাধিতে ফুলে ফুলে ভরে উঠুক। দেশ জাতি সম্মানিত হোক বিশ্ব দরবারে। আমরা প্রবাসীরাও আসবো তার সমাধিতে ফুল হাতে নিয়ে। আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা নীরবে অনেক কাজ করে একদিন চলে যান। তাঁদের অবদান অস্বীকার করলে সমাজের জাতির ক্ষত হয়। অনেকে আর ভালো কাজে উৎসাহ পায় না। তাই অতীতের কৃতী মানুষদের স্মরণ করা আমাদের কর্তব্য সমাজের রাষ্ট্রের ও প্রজন্মের স্বার্থেই।

আমরা লিভিং ঈগল সাইফুল আজমকে স্মরণ করতে পারলাম না, তাকে জানলাম না। এতে তাঁর কোন ক্ষতি হয়নি, ক্ষতি হয়েছে আমাদের। দেশ জাতি বঞ্চিত হলো এ থেকে। সত্যিকারের একজন বীর সেনানিকে জাতি মূল্যায়ন করতে পারলো না। এ সমস্ত বীর দেশপ্রেমিক মানুষকে মূল্যায়ন না করলে জাতি উঠবে কি ভাবে। জাতিতে জাগাতে হলে অনুপ্রেরণার দরকার হয়। এদেরকে দেখেই তো মানুষ অনুপ্রাণিত হয়। জাতি শ্রেষ্ঠ হয়। দেশে তো এমনিতেই চোর ডাকাতে ভরে গেছে। দেশের কৃতী সন্তানদের সামনে আনতে হয় দেশের স্বার্থেই। জাতি দেখছে সবাই তো চোর ডাকাত ভালো মানুষ কই। এমন কৃতি সন্তানদের জাতির সামনে উৎভাসিত করতে হয় দেশের প্রয়োজনেই। তা না হলে দেশে ভালো মানুষ সৃষ্টি হবে কিভাবে। এ সমস্ত বীর কৃতি সন্তানদের নিয়ে একটি বড় ধরনের মিউজিয়াম থাকা দরকার। ভিডিও থাকা দরকার, বই পুস্তক থাকা দরকার। আমাদের প্রজন্মরা পড়ে তা থেকে জ্ঞান অর্জন করবে। জীবনকে গড়ে তুলবে মানুষ হিসেবে। জাতি গঠনে এরা দেশের জন্য অপরিসীম এরা অতুলনীয়। এরা দেশের জন্য গর্বের। নতুন প্রজম্ন এদের সম্বন্ধে জানা দরকার। তারা যাতে অনুপ্রাণিত হতে পারে তা দেখে। তবেই না এ জাতি উন্নত হবে।

সন্দেহ নেই, কোভিড-১৯ এর মধ্যে আমরা আতঙ্কে উৎকন্ঠিত হয়ে পড়েছি। আমাদের সবার জীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে। জানিনা কি অনিবার্য পরিণতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের চিকিৎসক, নার্স স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ ভাইয়েরা এই দুর্বিষহ সময়ে তাঁরা আমাদের টিকে থাকতে সাহায্য করেছেন। তাঁদেরকে আমরা সালাম জানাই। অনেক ডাক্তার, নার্স-করোনা রুগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে নিজেরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। এই বীরদের আমরা কিভাবে ভুলি; লোক দেখানো করতালির মধ্য দিয়েই কি আমাদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখতে পারি। না কোন রাষ্ট্রের আরো দায়িত্ব থাকা দরকার আছে। অন্যের জীবন রক্ষায় ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে এই মহামারিতে অনেক ডাক্তার নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী নিজের জীবন দিয়েছেন। তাদেরকে নিয়ে এখনই একটি মিউজিয়াম থাকা দরকার। এই ত্যাগী বীরদের স্মরণে রাখতে এটিই হতে পারে একটি উৎকৃষ্ট উপহার। তা হলেই তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবেনা আর। ঐ মিউজিয়ামে সাহসী বীরদের গল্প লেখা থাকবে। তবেই না জাতীর চরম বিপদের দিনে সত্যিকারের বীরেরা দাড়িয়ে উঠবে। জাতির দূর্দিনে যাঁরা প্রাণ দিতে এগিয়ে আসেন তাঁদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় জাতির প্রয়োজনে। এরাই জাতির শ্রেষ্ঠ উপহার। তাঁদের আত্মত্যাগ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। যা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বের। এরাই হয়ে ওঠবে এক একটি অনুপ্রেরণার নাম। ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণা জাগাবে। এমন আত্মত্যাগ শুধু আশাই দেখায় না উজ্জল ভবিষ্যতের স্বপ্নও দেখায়। এই বীরেরা আমাদের গৌরবের, সম্মানের। এদের আত্মত্যাগ ভবিষ্যতে ভালো মানুষ হতে সাহায্য করবে। তাদের আত্মত্যাগ বাংলাদেশে তরুণদের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে। এ জন্যেই বীরদের বাঁচিয়ে রাখতে মিউজিয়ামের দরকার হয়ে পড়ে। বিশ্ব ঘুরলে তাই দেখা যায়। তারা ত্যাগি মানুষদের ভুলে না কখনো। তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে আজীবনের জন্য। নজিরবিহীন অন্ধকারের এমন সময় গুলোতেই ওই বীরদের প্রয়োজন হয়। তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া আত্মবিশ্বাসে ভর করে আমরা সামনে এগিয়ে যাওয়ার উদ্দীপনা পাই। সেই বীরদের উদ্দেশ্যে মিউজিয়াম আমরা কবে দেখতে পাব।

সাইফুল আজম চারটি দেশের বৈমানিক হিসেব কাজ করেন। পাকিস্তান, বাংলাদেশ জর্ডান ও ইরাক। আরব নিউজ বিশ্ব সেরা ডগ ফাইটার এই বৈমানিকের সমন্ধে জানতে চান তাঁর স্ত্রী নিশাত আরার কাছ থেকে। শুনুন তাহলে নিশাত আরার গল্পের কাহিনী। ১৯৬৭ সালে আরব ইসরাঈল যুদ্ধ হওয়ার তিন মাস আগে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পরপরই আজমের ডাক পরে আরব ইসরাঈল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার। স্বামীকে একা ছাড়লেন না তিনি। স্ত্রী নিশাত আরাও স্বামীর সাথে জর্ডান চলে যান। মরলে স্বামীর সাথে এক সাথেই মরবেন। তখন আরব ইসরাঈল যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে প্রচন্ড ভাবে। ইসরাঈল জেরুজালেমের পুরাতন সিটি ও জর্ডানের কিছু অংশ দখল করে নেয়। সাইফুল আজম জর্ডান এয়ার ফোর্সের ফাইটার পাইলট হিসেবে যোগ দেন সেখানে। ধনীর দুলালী মেয়ে নিশাত বাবার প্রাসাদ ছেড়ে প্রিয় স্বামীর সাথে জর্ডান ইরাকে এক বিভিসিকাময় জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। প্রতি মহুর্তেই আতঙ্ক। ইসরাঈলি বিমানের বোম্বিং থেকে বাঁচার জন্য স্থান হয় জর্ডানের মাফরাক বেইজের বাংঙ্কারে। প্রতি মুহুর্ত প্রতি ঘন্টা মৃত্যুর। এর ভিতরেই আজম কাজ করেন। প্রতি মুহুর্তে যে কারোর জন্য মৃত্যু অপেক্ষা করছে।

একদিন আজম বিষন্ন মনে বাংঙ্কারে ফিরে আসেন। স্ত্রীকে বলেন, জর্ডান এয়ার ফোর্সের মেজর ফিরাজ ইসরাঈলি বিমান বাহিনীর হামলায় মারা গেছেন। ফিরাজ তার অত্যান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহকারী ছিলেন। দু:খে মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে আজমের। পরের দিন গুলোর ইতিহাস। আজমের মনে কষ্ট। তিনি এর প্রতিশোধ নিবেন। চলে যান ইরাকি এয়ার বেইজে। জর্ডান ও ইরাকি বিমান বাহিনীর পাইলট হিসেবে সাইফুল আজম আকাশ পথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। একে একে ইসরাঈলের চারটি যুদ্ধ জেট বিমান ভুপাতিত করে ফিরাজ হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে বিশ্বের যুদ্ধের ইতিহাসে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করেন। আরব ইসরাঈল যুদ্ধের মোর ঘুরিয়ে দেন সাইফুল আজম। হয়ে উঠেন জর্ডান, ইরাক ও প্যালেসটাইনিদের সত্যিকারের খাটি ও ত্যাগী বন্ধু। ঐ দেশগুলো তাকে খাটি বীরের মর্যাদা দিয়ে নিজের দেশের সর্বোচ্চ খেতাবে ভূষিত করেন। আরব ইসরাঈলি যুদ্ধের এক বছর পর এই দম্পতির ঘরে প্রথম পুত্র সন্তান জন্ম হয়। সাইফুল আজম বন্ধুর স্মৃতি ও ভালোবাসাকে স্মরণ করে নিজের সন্তানের নাম রেখেছেন ফিরাজ। এই নামের মাধ্যমে মেজর ফিরাজকে মনে রেখেছেন তিনি। সাইফুল আজমের অনিল ও অনিতা নামে দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে। এসব লেখা আরব নিউজের। বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসার এক বীরের গল্প শুনানোর জন্য বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। নিশাত আরা তার স্বামীকে পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ বীর হিসেবে বুকে ধারন করে রেখেছেন। গর্ব করেন পুত্র ফিরাজ, অনিলা আর অনিতা তাঁদের পিতা হিসেবে।

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের ইতিহাসে ভারতের মায়াদেবের যুদ্ধ বিামনটি সাইফুল আজমই ভূপাতিত করেছেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বৈমানিক হয়ে। এ জন্যে পাকিস্তান বিমান বাহিনী সাইফুল আজমকে বীরের মর্যাদা দিয়ে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করেছে। পাকিস্তানের আকাশের শ্রেষ্ঠ তারা হিসাবে আজমকে সম্মানের আসনে রেখেছেন আজো। এই বীর সেনানিকে আমরা ভুলি কি করে। আরব নিউজ ও পাকিস্তান জর্ডান, ইরাক ও প্যালেসটাইন এর বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলো লিভিং ইগল সাইফুল আজমের উপর বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করেছে।

তার মৃত্যুতে পাকিস্তান বিমান বাহিনী প্রধান মোজাহিদ আনোয়ার খান ও পাকিস্তান সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান এবং জর্ডানের প্রিন্স হাসান বিন আলাল শোক বার্তা পাঠিয়েছেন আজমের স্ত্রী নিশাত আরার কাছে। তার পরিবারকে ফোন দিয়ে সমবেদনা জানিয়েছেন এইসব বড় মাপের মানুষ গুলো। উনাদের তুলোনা হয় না। এতে তারাও সম্মানিত হয়েছেন। শোক বার্তায় তাঁরা জানান, লিভিং ঈগল সাইফুল আজম আকাশ পথের যোদ্ধা হিসেবে তিনি জাতির গর্বের। তিনি আমাদেরও গর্বের। আমরা তাকে শ্রদ্ধা ভরে গর্বের সাথে মনে রেখেছি আজো। প্যালেসটাইনি জনগণ মার্চ পাষ্ট করেছেন বাংলাদেশের পতাকা ও সাইফুল আজমের ছবি হাতে নিয়ে। তাঁরা বারবার চুমু খেয়েছেন তাঁর ছবি হাতে নিয়ে। আমার ভগ্নিপতি গ্রুপ ক্যাপ্টেন বজলুর রহমানও ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ জন। তিনিও ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে সে সময়। এক সাথে কাজও করেছেন বাংলাদেশে। সাইফুল আজমের মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাঁর বন্ধু বজলুর রহমানও মারা যান। তাঁর স্ত্রীও মারা যান কয়েক মাস আগে। গুলশান ডিওএইচএস বিমান বাহিনী অফিসারদের ভবন গুলো গ্রুপ ক্যাপ্টেন বজলুর রহমানের হাতেই এলোটমেন্ট হয়েছে। তিনি যশোর এয়ারবেইজ, চিটাগং এয়ার বেইজের প্রধান ছিলেন। বিমান বাহিনীর সদর দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে তাঁর অবদান অনেক। মানুষ মাত্রই মরনশীল। মানুষ মারা যাবে এটিই সত্যি। মানুষের কীর্তি মানুষকে বড় করে তুলে সম্মানের আসনে রাখে আজীবনের। বৈমানিক লিভিং ঈগল সাইফুল আজম এতগুলো দেশের এতগুলো জাতির গর্বের প্রতিক। এমন মানুষ পৃথিবীতে কয়জন। এমন মানুষ প্রিয় বাংলাদেশের। উই স্যালুট দ্যাম উইথ অনার।

advertisement

Posted ১২:০৭ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন ২০২১

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

গল্প : দুই বোন
গল্প : দুই বোন

(6246 বার পঠিত)

মানব পাচার কেন
মানব পাচার কেন

(1148 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.