চৌধুরী মোহাম্মদ কাজল | শুক্রবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
লাহোরের অভিজাত পরিবারে জন্ম। ক্রিকেট খেলাটা ছিল তার অত্যন্ত অপছন্দের একটি কাজ। সারাদিন অলসভাবে মাঠে দাড়িয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোন কাজ নেই। কিন্তু যার ভাগ্যে ছিল ক্রিকেট বিশ্বকাপের শিরোপা তিনি ক্রিকেট থেকে দূরে থাকেন কি করে। কালক্রমে ইমরান খান হয়ে ওঠেন ক্রিকেটার। শুরুর দিকে ছিলেন ব্যাটসম্যান। ওপেনার হিসেবে ক্লাব ক্রিকেটে খেলেছেন বেশ কিছুদিন। এতটাই হালকা পাতলা ছিলেন যে মনে হতো বাতাসের ধাক্কায় পড়ে যাবেন।
ইমরান পাকিস্তান দলে প্রথম ডাক পান ১৯৭১ সালে। ইংল্যান্ড সফরকারী দলে সুযোগ পেয়েছিলেন বোলার হিসেবে। তিনি এখনও বিশ্বাস করেন ১৯৭১ এর ইমরান খান কোন ভাবেই পাকিস্তান দলে স্থান পাওয়ার যোগ্য ছিলেন না। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিলেন। লাহোরের অভিজাত পরিবারে জন্ম। তার দুই কাজিন মাজিদ খান ও জাবেদ বার্কী ছিলেন পাকিস্তান দলের প্রভাবশালী খেলোয়াড়। তাই ইমরান খানের জন্য জাতীয় দলে জায়গা পাওয়াটা ছিল সময়ে ব্যাপার। তার এমনই পারফরমেন্স ছিল যে সেই সফরে একদিন তাকে নেটে বল করতে দেওয়া হয়। পাশে দাড়িয়ে প্র্যাকটিস দেখছিলেন কয়েকজন ইংরেজ দর্শক। তার বল গিয়ে আঘাত করে নেটের বাইরে দাড়িয়ে থাকা এক দর্শকের মাথায়। এরপর প্রচুর পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় এর ফলে পাকিস্তান ক্রিকেট দলে নিজেকে একজন অপরিহার্য খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
ইমরান শুধু নিজেকেই দলে প্রতিষ্ঠিত করেননি। তার নেতৃত্বে পাকিস্তান হয়ে ওঠে বিশ্বক্রিকেটে দুর্র্ধষ একটি দল। তার অধিনায়কত্বে পাকিস্তান প্রথম ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজ জেতে ১৯৮২ সালে। ছয় টেস্টের ওই সিরিজে তিনি ৪০ টি উইকেট নিয়েছিলেন। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল ও বদমেজাজী স্বভাবটা তখনও যায়নি। লাহোরে ভারতের একটি উইকেট পতনের পর কিছু দর্শক মাঠে ঢুকে পড়ে। একজন ইমরান খানের সাথে হ্যান্ডশেক করতে যায়। কিন্তু ইমরান তাকে লাথি মারেন। এরপর ঈশ্বর প্রদত্ত শাস্তি পেতে সময় লাগেনি। আঙ্গুলে ব্যথা পেয়ে পরবর্তী তিন বছর বোলিঙ করতে পারেননি। ইমরান ছিলেন তার সময়ে একজন সেরা ফাস্ট বোলার ও বিশ্বের চারজন অলরাউন্ডারের একজন। কিন্তু ক্যারিয়ারের সেরা সময়টাতে বোলিঙ করতে পারেননি। বিশ্বকাপ ১৯৮৩ তে অংশ নিয়েছিলেন শুধু একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে।
এরপর ইমরান খানের নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রথমবারের মত ভারতের মাটিতে ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজ জেতে ১৯৮৭ সালে। একই সফরে ভারতকে ওয়ান ডে সিরিজে পরাজিত করেন ৫-১ ব্যবধানে। এরপর আসতে থাকে একের পর এক সাফল্য। ভারত ও পাকিস্তান প্রথম যৌথভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন করে ১৯৮৭ সালে। সেবার অন্যতম ফেভারিট হওয়া সত্ত্বেও সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয়। এরপরই ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষনা দেন। কিন্তু জনগন তা মেনে নিতে পারেনি। ইমরানের প্রত্যাবর্তনের দাবীতে শুরু হয় গন আন্দোলন। কিন্তু ইমরান ছিলেন অনঢ়। শেষ পর্যন্ত রাস্ট্রপতির অনুরোধে সিদ্ধান্ত বদলাতে হয় তাকে। এরপর পাকিস্তান তার নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জেতে ১৯৯২ সালে। বিশ্বকাপ থেকে অর্জিত অর্থপুরস্কারের পুরোটাই দিয়ে দেন মায়ের নামে করা ক্যান্সার হাসপাতালে। পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠা করেন অত্যাধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল।
ক্রিকেট ছাড়ার পর পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ হয়ে যান। গঠন করেন রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। তখন অনেকেই ভেবেছিল দলটি হবে একটি ওয়ান ম্যান পার্টি। কিন্তু ইমরান পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইনু, মেনন বা জেনারেল ইব্রাহিম হয়ে থাকেননি। দ্রুতই দলটিকে তিনি একটি সার্বজনীন জাতীয় দলে পরিণত করতে সমর্থ হন। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ২০১৮ সালে। অভিযোগ ছিল তিনি সামরিক বাহিনীর সমর্থন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী হয়েই একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে কাজ শুরু করেন। রাস্ট্রীয় কৃচ্ছতা সাধানের ওপর জোড় দেন। তিনি একবার যুক্তরাস্ট্র সফরে এসে ওঠেছিলেন পাকিস্তানের রাস্ট্রদূতের বাড়ীতে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিনে আমেরিকা এসেছিলেন কয়েক’শ সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে, তখন ইমরান খান এসেছিলেন মাত্র ছয়জন সফরসঙ্গী নিয়ে। কিন্তু তার মত একজন রাজনীতিবিদকে পাকিস্তানের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ভাল লাগবে কেন। অচিরেই সেনাবাহিনীর সাথে বিরোধ বাধে। সেইসাথে জারদারী ও নওয়াজ শরীফদের কূটচালতো ছিলই। ইমরান ক্ষমতাচ্যূত হন ২০২২ সালে।
এক সময় ধারনা করা হয়েছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান হতে যাচ্ছেন মেয়াদ পূর্ণ করা প্রথম প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিতে আছে দুষ্ট্গ্রহ বলে পরিচিত সামরিক বাহিনী। দেশরক্ষার পরিবর্তে তারা দেশকে ধ্বংসই করে গেছে। সেনাবাহিনীর প্রভাবে মাত্র সাড়ে তিন বছরেই শেষ হয় তার শাসনামল। শুধু তাই নয় এরপর একের পর মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয় তাকে। তুচ্ছ সব মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয় ইমরানকে। শেখ হাসিনা যেমন একের পর এক মামলা দিয়ে খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠিয়েছেন, খালেদা জিয়া যেমন মামলা দিয়ে এরশাদকে জেলে রেখেছিলেন, ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলিও ছিল তেমনি ঠুনকো। শেষ পর্যন্ত কারাগারে থেকেই নির্বাচন করতে হয়। নির্বাচনের আগে নানাভাবে হয়রানী করা হয় পিটিআই প্রার্থীদের। কেড়ে নেওয়া হয় তাদের নির্বাচনী প্রতীক। পিটিআই প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে অদ্ভুত সব প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রমান করেছেন ইমরান খানের ক্যারিশমা শেষ হয়ে যায়নি এখনও। দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তার চেয়ে যোগ্য প্রার্থী পাকিস্তানে আর কেউ নেই। ইমরান হয়তো শতভাগ পারফেক্ট ছিলেন না। কিন্তু পাকিস্তানের ৭৭ বছরের ইতিহাসে তার চেয়ে সৎ আর কেউ ছিলেন না। তারপরও কথা আছে। এখনও বলা যায় না ইমরানের ভাগ্যে কি রয়েছে। সেনাবাহিনী এরপর কি পদক্ষেপ নেয়। ইমরানের প্রতিপক্ষ জারদারী ও নওয়াজ শরীফরা যে সেনাবাহিনীকে প্রভাবিত করে ক্ষমতায় আসতে চাইবে একথা বলাই বাহুল্য। পাকিস্তানের রাজনীতি কোনদিকে মোড় নেয় দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েকটা দিন। তবে একথা বলা যায় এবারের নির্বাচনে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সত্যের জয় হয়েছে পাকিস্তানে। এটাই বা কম কি।
Posted ৭:৩২ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh