ড.মাহবুব হাসান | বৃহস্পতিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০
গত রোববারে, নিউ ইয়র্ক মহানগরের বাসিন্দারা বেড়াতে বেরিয়ে পড়েছিলো বলেই মনে হলো। সকালে হিলসাইড অ্যাভিনিউতে যাওয়ার পথে ক্যাপ্টেন টিলি পার্কে ঢুকে আমি তো অবাক। এই সকাল সাড়ে নয়টায় এতো মানুষ কেন? এই পার্কে আমি প্রতিদিনই হাঁটতে আসি। এখানকার গুজ পন্ডের চারদিকে হেঁটে নিজের স্বাস্থ্য রক্ষার কাজটা করতে আসেন অনেক মানুষ। তাই বিকেলটা অনেক ভিড়াক্রান্ত থাকে টিলি পার্ক। কিন্তু আজকে এলিপন্ড পার্কে যাওয়ার প্রোগ্রাম করেছেন বন্ধুরা। উদ্যোগটা জহিরের হলেও আমারও সহযোগ ছিলো। মঞ্জু ভাই তার স্বভাবসুলভ মুচকি হাসির সাথে সায় জানালে আমরা ঠিক করি এলিপন্ডে যাবো সকাল ১১টায়। সেখানে দুপুর পর্যন্ত থেকে ফিরে আসবো। মাঝে আমাদের নাশতাটাও প্রকৃতির ওই সাজানো বাগানে বসে খেয়ে আসবো।
১১টার দিকে গিয়ে দেখি ওই পার্কে ঢোকার পথের দুই দিকেই অগণন গাড়ি পার্ক করা। তার মানে পার্কের পার্কিং লট ভরে গেছে। রোববার উপভোগকারীদের দখলে চলে গেছে পার্ক। এখন কোথাও জায়গা পাবো কিনা, তা নিয়ে চিন্তিত হচ্ছিলাম আমরা। পার্কিং এলাকায় ধীরে ধীরে এগুচ্ছিলাম আমরা। এবং হঠাৎ করেই একটি গাড়ি চলে যাওয়ায় আমরা পার্কিং পেয়ে গেলাম। ফেরদৌস নাজমী ভাইও পেলেন সহজেই। কিন্তু এখনো আসেননি ফজলুর রহমান ভাই। তিনি পরে এসে যোগ দেবেন। আমরা একটি জায়গায় আমাদের বসার ব্যবস্থা করে নিলাম। তারপর চার দিকে তাকানোর ফুরসত পেলাম।
অনেক শিশু, কিশোর, তাদের বাবা-মা ভাইবোনসহ অনেক মানুষের সমাগম পার্কে। এটি একটি মাত্র স্পট, এ-রকম আরো কয়েকটা স্পট আছে এই পার্কে জানালেন মুক্তি জহির। অনেকের খেলাধুলা করছে ফুটবল নিয়ে, কিছু যুবক ভলিবল খেলছে, শিশুরা সাইকেল চালাচ্ছে। বারবিকিউ হচ্ছে। সবই আলাদা আলাদা স্পটে। সবই উপভোগ্য। আমার খুব ভালো লাগছে।
কেন পার্কে এতো মানুষের সমাগম, এ-নিয়ে আমরা কথা বললাম। রাজিয়া নাজমী বললেন, সামার তো শেষ হয়ে এলো বলে। তাই এতো ভিড়। নিউ ইয়র্কের বসতিরা সামার খুব উপভোগ করে থাকে। বাঙালিদের অনেকেই বোরবার হলেই সী-শোরে চাতালে বা বীচে যায় মাছ ধরতে। এই সময়টায় বিখ্যাত সব সী-বীচেই ‘জাইল্যা’দের (যার ঝাকিজাল আছে তিনিই জ্যাইলা) সমাগম হয়। আসলে তারা সৌখিন মানুষ। কেউ ব্যবসা করেন, কেউবা জব করেন। তাজা মাছের স্বাদ নিতেই দেশ থেকে জাল এনেছেন। আমি যে বাসায় থাকি, সেই শেখ ফরিদও সময় করতে পারলেই মাছ ধরতে যান বন্ধুদের সাথে। এটা কেবলই সামারের মজা বা আনন্দের উৎস। সেই আনন্দের সবচেয়ে বড় উৎস হলো বিভিন্ন পার্কে, অভিবাসী মেক্সিক্যান, এশিয়ানদের ভিড় লেগেই আছে। কেবল তারাই নয়, শাদা চামড়ার আমেরিকানরাও যান। গত রোববারেও এলিপন্ডে বেশ কিছু শাদা লোকের দেখা পেলাম যখন বিশাল বিশাল ওক আর বার্চের ভেতর দিয়ে কাচা ট্রেইল ধরে হাঁটছিলাম,তখন। বনের ভেতর দিয়ে এই সব ট্রেইল যে কতো বড় ও কতো বিচিত্র বাঁক ও মোড় নিয়ে আমাদের এক ঘন্টা হজম করে ফেললো, তা আমরা বুঝতেও পারিনি। তাও তো আমরা একটি মাত্র স্পট থেকে ওই পথে হাঁটছিলাম। কাজী ফৌজিয়া, মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন এবং গণমানুষের রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে তরতরিয়ে কথা বলছিলেন বাংলা ইংরেজিতে, হাঁটতে হাঁটতে। শুনতে ও বুঝতে বেশ লাগছিলো।
তিনি হাঁটতেও যে ওস্তাদ সেটা বোঝা গেলো আজ। ফজলু ভাই ট্রেইলের দীঘল-পাগল ওকের নান্দনিক শোভা ভোগ করতে করতে তার সেলফোনে তুলছিলেন ছবি। সুযোগ বুঝে, আমিও তুললাম গোটা কয়েক। নিউ ইয়র্কে যে কতো পার্ক আছে তা আমার জানা নেই। তবে বাইরে থেকে এই মহানগরকে বোঝা যায় না যে কেবল ম্যানহাটান, মানে স্কাইস্ত্র্যাপারে ঠাসা কোনো মহানগরী নয়, বনজঙ্গল আর গাছ-গাছালিতে ঠাসা এক অরণ্যময় মহানগর, এটি। সেটা আমি ব্রুকলিনে থাকতেও দেখেছি। ব্রঙ্কেও দেখেছি গাছের সমারোহ। নাসরিন চৌধুরীর বাড়ির কাছেই চিড়িয়াখানা আর পার্কের সমারোহ, বলেছিলো সে। কিন্তু সেই চিড়িয়াদের দেখা হয়ে ওঠেনি আজো। ম্যানহাটানের মধ্যিখানে বিশাল একটি পার্ক আছে, সেন্ট্রাল পার্ক। সেই পার্কের মধ্যিখানে বিশাল জ্যাকুলিন ওনাসিস পন্ড, পার্কের ভেতরের একটি হৃদভূমি। সাজানো-গোছানো সেই পার্কে যাওয়ার এবং সময় কাটানোর বেশ কিছু অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। আমি পুরো নিউ ইয়র্ক মহানগর না দেখলেও এটা বলতে পারি এ-মহানগর পার্কের মহানগর। ঢাকা মহানগরকে যেমন আমরা মসজিদের জন্য মসজিদের শহর বলি, তেমনি পৃথিবীর রাজধানীকেও বলা যেতে পারে পার্কের শহর। গাছপালাকে রেখে,পাহাড়-টিলাকে পরিকল্পিত বাড়ির সহযোগী করে বা তাকে অটুট রেখে বাড়ি ঘর-রাস্তাঘাট বানাবার যে নৈসর্গিক নগর প্ল্যানার আছে পৃথিবীতে সেটা নিউ ইয়র্ক না দেখলে বুঝতাম না। আমি লস এঞ্জেলেস শহরেও ছিলাম বা সে-শহরও দেখেছি, সেটাও প্ল্যানড মহানগর, কিন্তু নিউ ইয়র্কের মতো প্রেমময় নয়। প্রাকৃতিক পন্ড, বন ও জঙ্গলের শোভাকে বসবাসের সাথে মিলিয়ে হাইওয়ে, সার্ভিস রোডসহ এক একটি আবাসন এলাকার সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলাটাই প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টিশীল কাজ বলে আমার মনে হয়েছে।
প্রতিটি পার্কে রেস্টরুম আছে। নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা স্পেসের ব্যবস্থা করে সব রকম আধুনিক যান্ত্রিক সুবিধা দিয়ে সেবা দেবার যে চিন্তা ও প্রেরণা তারা অনুভব করেছেন, তার পেছনে কাজ করেছে নগর পরিকল্পকদের ‘সাংস্কৃতিক ও মানবতাবোধ বা মানুষকে সম্মান জানানোর অনুপুঙ্খ অনুভূতি। এটা ভেতর থেকে না এলে, সহজে অ্যাডাপ্ট করা যায় না।
এই মহানগরী তুলনামূলকভাবে অনেকটাই নোংর এই অভিযোগ অনেকেই করেন। কিন্তু আমার চোখে এটুকুই যদি আমরা ঢাকার জন্য করতে পারতাম, মানে ঢাকার অধিবাসীদের, নাগরিক চেতনায় প্রশিক্ষিত করতে পারতাম, রাস্তাঘাটগুলোকে নাগরিক অধিকারের মতো সমান স্তরে পৌছে দিতে পারতাম, যদি নগর ব্যবস্থাপকরা ‘মানুষ’ হতেন, মানে সাংস্কৃতিক ও শিক্ষিত ও দায়িত্ব-কর্তব্যবোধে উন্নত হতেন,, তাহলে ঢাকা বসবাসের উপযোগী থাকতো। আজকে শুনছি, ঢাকায় নাকি অনেক ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে, ইট-পাথরের উন্নয়নের পাশে যে বন-জঙ্গল আর ছোটো বড় শ-খানেক পার্কের প্রয়োজন আছে, তা বোধহয় নগর পরিকল্পকগণ ভাবলেও বাস্তবায়নকারীর লোভের চিতায় তা নি:শেষ হয়ে যায় বা যাচ্ছে। এখনো সব সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি বলেই আমার বিশ্বাস। বিদ্যমান পার্কগুলোতে খেলাধুলার সরঞ্জামের চেয়েও বেশি প্রয়োজন নানাজাতের গাছের সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশ। এই প্রাকৃতিক পরিবেশ মহাগরের ফুসফুস,তার অক্সিজেনের ভান্ডার। অক্সিজেন-শূন্য একটি শহরকে মৃত বলে ঘোষণা করা যায়।
ঢাকার বাতাসের কোয়ালিটি পৃথিবীর নিকৃষ্টতম স্তরের। এর বহু কারণের মধ্যে গাছপালাহীনতা, যা মূলত অবসর যাপন ও আনন্দবর্ধনের পার্কের অভাব। অবসর বিনোদনের পাশাপাশি ওই সব পার্ক বাসিন্দাদের ফুসফুসকে দেবে টাটকা অক্সিজেন, নি:শ্বস নেবার মহাষৌধ। রূপে ও গুণে বলে যে কথাটা চালু আছে আমাদের, মহানগরের রূপের উন্নতির সাথে সাথে গুণের (পার্ক বা বাগান-সংস্কৃতি) উন্নতি করতে হবে। নাহলে ওই ঝা-ঝকঝক ইলেকট্রিক্যাল আলো দিয়ে কোনো উন্নতিকেই চিত্রিত করা যাবে না।
Posted ১২:১৫ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh