ডা. ওয়াজেদ এ খান | বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট ২০২২
ইতিহাসের বাঁক ঘুরার দিন পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। যেদিন বাংলাদেশের স্থপতি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয় সপরিবারে। একই সময় হত্যা করা হয় তার ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে। সেনাবাহিনীর কতিপয় সদস্য নেতৃত্ব দেন নৃশংস এ হত্যাকান্ডে। কিন্তু তাদের এ অভ্যুত্থান জায়েজ করে নেয় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী। প্রকাশ্য সমর্থন জানায় পুলিশ, বিডিআর, এমনকি রক্ষীবাহিনী। দেশে জারি করা হয় সামরিক আইন। বঙ্গবন্ধু সরকারের বাণিজ্য ও বৈদেশিক বাণিজ্য মন্ত্রী খন্দকার মুশতাক অধিষ্ঠিত হন নূতন প্রেসিডেন্ট হিসেবে। আওয়ামী লীগেরই বি-টিম নিয়ে তিনি গঠন করেন নূতন মন্ত্রী সভা। এসবই ঘটনাবহুল ইতিহাস। এ নিয়ে রাজনৈতিক কোন বিশ্লেষন বা কোন মন্তব্য করতে চাইনা। সেদিন কোথায় এবং কেমন ছিলাম স্মৃতির পাতা থেকে শুধু সেটুকুই তর্পণ করতে চাই। একই স্রোতে বার বার সাঁতার কাটা যায় না ঠিক। তবে স্মৃতি রোমন্থন করা যায় বারবার, আজীবন। পঁচাত্তরের ঘটনা বহুল এ সময়টায় আমি ছিলাম ঢাকা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা কলেজ। নানা কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর একসময় ছাত্র রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিলো এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে মেধাবী ছাত্রদের জন্য তখনও অবারিত ছিলো ঢাকা কলেজ। আমি থাকতাম দক্ষিণ ছাত্রাবাসের ১০১ নম্বর কক্ষে। আমার রুমমেট ছিলো আমিনুল হক খান। প্রাইমারীতে আমার সহপাঠি ছিলো আমিনুল। বর্তমানে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ। আমরা দু’জনই ছিলাম ঢাকা কলেজ রোভার স্কাউট সদস্য। আমাদের অপর রুমমেট ছিলেন সাভারের তৎকালীন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আনোয়ার জং এর ছোট ভাই গিয়াস উদ্দিন। অমায়িক স্বভাবের গিয়াসউদ্দিন ছিলেন সম্পূর্ণ রাজনীতি মুক্ত। বর্তমানে তিনি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
সে সময়টায় দক্ষিণ ছাত্রাবাসের সুপারিনটেনডেন্ট বা তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রকীব ফজলী। ঢাকা কলেজের আরবী বিভাগীয় প্রধান। যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের প্রথম ব্যাচের গোল্ড মেডেলিস্ট। জন্মস্থান ব্রাহ্মনবাড়িয়ার টান ছিলো তার কথাবার্তায়। শিক্ষকতার পাশাপাশি এলিফেন্ট রোডে হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করতেন তিনি। ছাত্রাবাসে তত্ত্বাবধায়কের বাসা ছিলো আমাদের ১০১ নম্বর কক্ষ সংলগ্ন। তাই স্বভাবতই: রকীব স্যার এবং তার পরিবারের সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো অত্যন্ত নিবিড়। এছাড়া রাজনীতির বাইরে থেকেও স্কাউট হিসেবে দক্ষিণ ছাত্রাবাসের ব্যবস্থাপনায় বড় ধরণের একটি পরিবর্তন আনার পেছনে আমরা রকিব স্যার ও তৎকালীন অধ্যক্ষ খুরশীদ আলম চৌধুরীর সাথে কাজ করেছিলাম। রকীব স্যার আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ডাকতেন খানের ব্যাটা বলে। পনের আগষ্ট সকালে রকীব স্যারের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। ‘খানের ব্যাটা উঠ’ বলে তিনি কড়া নাড়ছিলেন দরোজার। হন্তদন্ত হয়ে দরোজা খুললাম। তখনই তিনি সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার দুঃসংবাদটি দিলেন। কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লাম। আমি তখন এক ব্যান্ডের ছোট একটি ফিলিপস রেডিও শুনতাম। রেডিওটি অন করলাম। ঘটনার সত্যতা মিললো। অন্যদিন ভোরে উঠতাম ফজরের নামাজ পড়তে। আগের রাতে বিলম্বে ঘুমুতে যাওয়ার কারণে সেদিন সময় মতো উঠতে পারিনি। এর আগে বেশ ক’দিন থেকেই ঢাকা শহরে চাউর হয়ে যায় রাজনৈতিক অঙ্গণে ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে এমন খবর। কথা ছিলো ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। সেখানে তাকে সংবর্ধিত করা হবে। এজন্য লাল গালিচা বিছানো হয় টিএসসি চত্বরে। আমরা কতিপয় বন্ধু মিলে ১৪ আগষ্ট সন্ধ্যায় টিএসসি এলাকায় ঘুরতে যাই। রাত প্রায় ১০টার দিকে বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁপে উঠে গোটা এলাকা। আমরা নীলক্ষেত-নিউ মার্কেট হয়ে দৌড়ে ছাত্রাবাসে ফিরি। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে এ নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত আলোচনা চলে নিজেদের মাঝে।
পনের আগষ্ট সকাল থেকেই সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের সংবাদ প্রচার হতে থাকে রেডিওতে। পৌনে ন’টার দিকে ঘোষণা আসে মেজর ডালিমের কন্ঠে। সকাল ৯টার পর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন নুতন প্রেসিডেন্ট মুশতাক। ভাষণে তিনি সময় নেন পাঁচ মিনিটেরও কম। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে কলেজের সামনে মীরপুর রাস্তায় যাই। রাস্তা প্রায় জনশূন্য। দু’একটি ট্যাঙ্ক চলতে দেখলাম। ফিরে এলাম ছাত্রাবাসে। এসময়টায় দক্ষিণ ছাত্রাবাসের ব্যবস্থাপনা সেক্রেটারীর দায়িত্ব ছিলো আমার উপর। তখন এ দায়িত্ব পালন করা ছিলো খুবই কঠিন। বলাবাহুল্য ঢাকা কলেজ সেসময় পরিচিত ছিলো ছাত্রলীগের ঘাঁটি হিসেবে। শেখ কামালও একসময় ছাত্র ছিলেন ঢাকা কলেজের। অনেক শিক্ষকের সাথে তার ছিলো সুসম্পর্ক। প্রায়ই তিনি ঢাকা কলেজে আসতেন। চেষ্টা করতেন ছাত্রলীগের বিবাদমান গ্রুপকে সামাল দিতে। তারপরও ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগ ছিলো দুর্দমনীয়। প্রতিটি ছাত্রাবাসের ডজন খানেক রুম ছিলো ছাত্রলীগ ক্যাডারদের দখলে। বিনামূল্যে তারা খাবার ভক্ষণ করতো সারা বছর। হেন কোন অপরাধ কর্ম নেই যা তাদের দ্বারা সংঘটিত হতো না। এছাড়া ছাত্রলীগের প্রতিদ্বন্দ্বি দু’গ্রুপের মধ্যে প্রকাশ্য মারামারি ঘটনা ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক। দক্ষিণ ছাত্রাবাসের প্রধান ফটকের উপরে দোতলায় কম করে হলেও ১০টি কক্ষ ছিলো অছাত্র সহ ছাত্রলীগ ক্যাডারদের দখলে। সালাহ, রেবা মুরাদদের মতো দুধর্ষ ক্যাডাররা থাকতো দোতলায়। কলেজের আশেপাশের নিউমার্কেট এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতো। শুধু তাই নয় পচাত্তুরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত তারা দক্ষিণ ছাত্রাবাসের ৩০০ বোর্ডারের বিপরীতে দুই হাজার রেশন কার্ডের মালামাল রেশন শপেই বিক্রি করে পুরো টাকা হাতিয়ে নিতো। সাধারণ ছাত্ররা ছিলো তাদের হাতে জিম্মি। ফলে অতিশয় নিম্নমানের খাবারের জন্য তাদেরকে প্রতিদিন ৯ টাকা করে গুণতে হতো। ছাত্রাবাসের ব্যবস্থাপনায় তাদের আমলেই কৌশলগত পরিবর্তনের পর অনেক উন্নত মানের দু’বেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হয় মাত্র সাড়ে ৪ টাকায়।
পনের আগষ্ট ভোরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের খবরে ছাত্রাবাস ছেড়ে পালিয়ে যায় ছাত্রলীগের ক্যাডার সহ অন্যান্য নেতারা। তখন দক্ষিণ ছাত্রাবাসের প্রধান বাবুর্চি ছিলেন ওয়ালিউল্লাহ ওরফে অলি মিয়া। বিক্রমপুরের এ বাবুর্চি ছিলেন খুবই দক্ষ। আমরা তাকে অলি ভাই বলে ডাকতাম। তখন নিয়ম ছিলো যারা দু’বেলা বা একবেলা খাবে তাদেরকে আগের রাতে টিকিট কিনতে হতো। হোস্টেল বয় আঃ বারেক টিকেট বিক্রি করতো প্রতিরাতে। পালাক্রমে বাজার করতে হতো ছাত্রদেরকে। নিয়ম মাফিক বারেক ১৪ আগষ্ট রাতে সাড়ে চার টাকা করে ২৬৫ জনের কাছে খাবার টিকিট বিক্রি করে টাকা জমা দিয়েছিলো। বাবুর্চি এবং বারেককে ডাকলাম সকাল ৯টার পর। তারা জানালেন অনেক ছাত্রলীগ নেতা পালিয়েছে। প্রত্যেক রুমে গিয়ে খবর নিতে বললাম কারা হোস্টেল ছেড়েছে জানার জন্য। সেদিন সালাহ, রেবা, মুরাদ গং ছাড়াও প্রায় ৫০জন পালিয়ে যায় হোস্টেল ছেড়ে। বিষয়টি রকীব স্যারকে জানালাম। তিনি সেদিন আমাকেই বাজারে যেতে বললেন। অলি ভাইকে নিয়ে নিউমার্কেট কাঁচা বাজারে গেলাম। চারিদিকে অজানা আতংক। আবার একশ্রেনীর মানুষের মাঝে উচ্ছ্বাসও ছিলো। বাজারে মানুষের ততোটা ভীড় নেই। মালামালের প্রাচুর্য্যতা নেই অন্যদিনের মতো। ছাত্রাবাসে ফিরলাম বাজার করে। এসবের ফাঁকে ফাঁকে রেডিও শুনছি উৎকন্ঠা নিয়ে। চারিদিকে গুজবের ছড়াছড়ি। সেদিন ছিলো শুক্রবার।
দুপুরের নামাজ পড়লাম পাশের টিচার্স ট্রেনিং কলেজ মসজিদে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিহতদের লাশ দেখার ভীড় জমেছে এমন খবরে দুপুরের খাবারের পর কয়েক বন্ধু মিলে মীরপুর রোড ধরে ঢাকা মেডিকেলের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে নীলক্ষেত থেকে ফিরে এলাম।
কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না বঙ্গবন্ধুর মতো এতো বড় মাপের একজন নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। তাকে অনেকবার অনেক কাছ থেকে দেখেছি। চুয়াত্তর ও পঁচাত্তরের মহান একুশে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। দেখেছি বাংলা একাডেমীতে। সর্বশেষ পচাত্তুরের ১৭ মার্চ তার জন্মদিনের উৎসবে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় অংশ নেয়ার সুযোগ হয়েছিলো। ঢাকা কলেজে পড়াশুনার সময় ৭৪-৭৫ সালে আমি সপ্তাহে দু’দিন বসতাম ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকার মতিঝিল অফিসে। একই ভবন থেকে তখন প্রকাশিত হতো বাংলাদেশ টাইমস ও সিনেমা পত্রিকা। বাংলার বাণীর ‘শাপলা কুড়ির আসর” তখন ছিলো ছোটদের সাহিত্য পাতা। এ আসরের প্রেসিডেন্ট ছিলেন সাংবাদিক বিমান ভট্টাচার্য ও সেক্রেটারি ছিলেন ক্রীড়া সাংবাদিক সেলিম নজরুল হক। আমি ছিলাম অফিস সেক্রেটারি। সিনেমা পত্রিকার জন্যও কিছু কাজ করতে হতো আমাকে। ‘৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের উৎসবে অংশ নিতে পারিনি। সেবার আগে থেকেই সবাই বলে রেখেছিলো। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ‘৭৫ সালে শাপলা কুড়ির আসরের আমরা সবাই ৩২ নম্বরের বাসায় গিয়েছিলাম। শেখ ফজলুল হক মনি’র পত্রিকা বাংলার বাণী। এজন্য আমাদের ছিলো বাড়তি সমাদর। আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে ৩২ নম্বর দিয়ে ঢুকে মীরপুর রোডের দিকের প্রধান ফটক দিয়ে বের হয়ে যাই। সেদিন বঙ্গবন্ধু নিজে সবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। সবাইকে দেয়া হয় একটি করে খাবার প্যাকেট।
পঁচাত্তরের আগস্টে দেশে চুয়াত্তরের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের রেশ ছিলো। দ্রব্যমূল্য ছিলো আকাশ ছোঁয়া। জাসদের গণবাহিনী ও সর্বহারাদের সাথে নিয়মিত সংঘাত ছিলো রক্ষী বাহিনীর। আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ছিলো সর্বত্র। বাকশাল চালুর চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছিলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। সবকিছু মিলিয়ে অস্থির সময় পাড় করছিলো গোটা দেশ ও জাতি। আর এসব থেকে পরিত্রাণের স্বাভাবিক পথও খোলা ছিলো। কিন্তু সে পথ না মাড়িয়ে তারা বেছে নিলো নির্মম হত্যাকান্ড। পরিবারের সদস্য সহ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিষয়টি ছিলো অপ্রত্যাশিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য মহান এ নেতার হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সেদিন রাস্তায় নামেনি তার দলের নেতা কর্মীরা। উপরন্তু বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী সভার ১৬জন সদস্য শপথ নেয় মুশতাকের মন্ত্রী পরিষদে। সামরিক আইন জারি করা হলেও নূতন মন্ত্রীসভায় কোন সামরিক অফিসার ছিলেন না। উপরাষ্ট্রপতিও বহাল ছিলেন স্বপদে। বিকেলে প্রেসিডেন্ট মোশতাক ও পরে মন্ত্রীরা শপথ নেন। রাত সাড়ে ১০টার সংবাদে গুরুত্ব সহকারে এসব প্রচার করা হয় রেডিওতে। সন্ধ্যা নামতেই কারফিউতে জনশূণ্য রাজপথ। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম কখন বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামবে, গড়ে তুলবে প্রতিরোধ। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটলো না। মধ্যরাতের পর আমরা ঘুমুতে যাই। দাপুটে ছাত্রলীগ নেতারা ১৫ আগষ্ট ভোরে সেই যে পালালো তারা আর কখনোই ফিরেনি ঢাকা কলেজ চত্বরে।
Posted ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh