ড. মাহবুব হাসান : | বৃহস্পতিবার, ২৯ জুলাই ২০২১
বিএনপি’র মহাসচিব ও দফতর সম্পাদক এবং অধিকাংশ নেতাই মনে করেন সরকারের ‘মেগা ও ছোট ছোট প্রকল্পে ‘দুর্নীতি ও হরিলুট’ চলছে। গতকাল বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স এক সংবাদ সম্মেলন করে এই অভিযোগ করেছেন। তাঁর ভাষায় ‘দেশ এখন হরিলুটের স্বর্গরাজ্য’। গ্রামের প্রকল্পও যে সেই লুটের কবলে নিপতিত, আশ্রয়ণের ঘর নির্মাণেও তা দেখতে পেলাম। গরিব, দুস্থ ও ঘরহীন মানুষদের নাম তালিকায় তোলার জন্যও ‘টাকা’ নেওয়া হয়েছে। আবার যারা সেই ঘর নির্মাণ করেছে, তারাও প্রয়োজনীয় নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করেনি। প্রতিটি ঘরের জন্য ৪০ ব্যাগ সিমেন্টের বরাদ্দ দেওয়া হলেও নির্মাতারা ১০/১২ ব্যাগের বেশি ব্যবহার করেনি। এর বদলে ব্যবহার করেছে বালি এবং মাটি। বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই, এ কারণেই ধসে পড়েছে ঘরগুলো।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের ধসে পড়া ঘরগুলো পুনরায় নির্মাণ করে দেবে সরকার- এমন ঘোষণা এসেছে সরকারের তরফ থেকে। এটি সহজ সমাধানের পথ। কোনও অন্যায়-অবিচার হলেই সরকার এর দায়-দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নেয়। এটি ভালো দিক। কিন্তু এর পেছনে যে অসৎ, অন্যায় এবং লুটপাটের ঘটনা দায়ী, সে ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে কোনও আওয়াজ আমরা পাই না। তবে, ‘বিচার আমরা করবো’ এমন বাণী প্রায়শঃ ঘোষিত হয়, যা শুনে সাধারণ মানুষ মনে করেন, হ্যাঁ, সরকার তো সব ব্যাপারেই সজাগ, সচেতন।
বৃষ্টিতে ভেঙে পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর
অপরাধের বিচার হবেই। এই সোজা সত্যটায় যে গরল লুকিয়ে আছে, তার তলাটা আমরা দেখি না। ক্যাসিনো শিল্পের হোতারা রাজনৈতিক সদস্য হিসেবেই গড়ে তুলেছিলো ওই ব্যবসা। গত ১০/১১ বছরের ‘সুফল’ হিসেবেই তা বিত্ত-বৈভবে উথলে উঠেছিলো। ওই ১০ বছরেও সরকারের গোয়েন্দাদের চোখে পড়েনি যে, ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনো চলছে। যখন চোখে পড়েছে, তখন তাঁরা সেই রহস্য ভেদ করেছেন। এজন্য আমরা তাঁদের এবং সরকারকে বাহবা দিয়েছি। সমাজ ও উদীয়মান যুব সমাজকে ধংসের মুখে ঠেলে দিতে ক্যাসিনোর রাজনৈতিক নেতা ও সহযোগীদের প্রণোদনা থেকে ‘অন্তত’ বাঁচানোর জন্য সরকারকে আমরা ধন্যবাদ জানাতেই পারি। কিন্তু সেই শিল্পের হোতারা কি আইনের আওতায় আছে? নাকি তারা বিভিন্ন ফাঁক-ফোকরের ভেতর দিয়ে ফুরুৎ করে উড়ে গেছে? কোরোনা টেস্টের রিপোর্ট বিক্রেতা সেই ‘মহানায়ক’ কিংবা সামাজিক ব্যবসার মহানায়ক (!) কারাগারে বসে ডিভাইস ব্যবহার করে জাতিকে চমকে দেয়? আমরা শুনেছি, জেলখানার ভেতরে কিছু রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সন্ত্রাসী নিয়মিতই ব্যবহার করে আধুনিক সেলফোন। সেগুলো তারা বাইরে থেকেই পায় কিংবা কর্তব্যরত পুলিশের সেলফোনও ব্যবহার করে।
আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ঘর
এ রকম এবং আরও বহু-রকম অবৈধ ও বেআইনি কাজ চলছে সুদীর্ঘকাল ধরে। আমরা বলতে পারি, বে-আইনি কিন্তু আমার বা আপনার স্বার্থ রক্ষায় যদি সেই বে-আইনি কাজ করা হয়, তখন তাকে আমরা পজিটিভ চোখে দেখি। অন্যায়-অবৈধ হওয়ার পরও সেটাকে আমরা ন্যায় মনে করি। আমরা তখন মনে করি বা যুক্তি দেখিয়ে বলি, সেই আইন হচ্ছে জনগণের বিরুদ্ধে স্বার্থবাদী সরকারের। মনে রাখতে বলি, আমাদের দেশে প্রচলিত আইনের অধিকাংশই ব্রিটিশদের হাতে তৈরি।
সেই আইনই চলছে প্রায় শতাব্দীকাল ধরে। ওইসব আইনের ৭০/৮০ ভাগই ব্রিটিশদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্বার্থ রক্ষায় সৃজিত হয়েছিলো। সেই আইন স্বাধীন দেশে দেদারসে চলছে। কারণ, ক্ষমতাসীনদের মনে শাসন করার মানসটি রয়ে গেছে ব্রিটিশদের মতোই। এরা হচ্ছে স্বাধীন দেশের ‘স্থানীয় ব্রিটিশ শাসক’। ব্রিটিশ সরকারের সেক্রেটারি ‘মেকলে’ এক ভাষণে তাঁর ভারতীয় ইংরেজ সহকর্মীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘নেটিভদের কিছু মানুষকে শিক্ষিত করো। তারা দেখতে কালো হলেও তারা জ্ঞানে-গরিমায়, মননে-মানসে হয়ে উঠবে ‘ইংরেজ’। তারাই আমাদের স্বার্থ রক্ষা করবে। আজকে মেকলে’র সেই বাণীরই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি আমরা। আমরা মননে-মানসে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক, শিক্ষিত মানুষ। ক্ষমতায় কিংবা ক্ষমতার বাইরে থাকা সব ধরনের মানুষই মননে-মানসে ব্রিটিশদের মতোই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এবং দুর্নীতিপরায়ণ।
খারাপ কাজ যখন নিজের স্বার্থে ঘটে তখন তা জায়েজ, যখন তা অন্যের স্বার্থ রক্ষা করে তা না-জায়েজ বা অন্যায়-অপরাধ বলে মনে করাটা মানসিক দুর্নীতি। আমাদের সমাজের সব ক্ষেত্রেই এই অসংগতি বিদ্যমান। যার কারণে ‘ন্যায়’ প্রতিষ্ঠিত হয় না, হতে পারে না।
ডিজিটাল বিষয়ক একটি আইন করা হয়েছে স্বাধীন দেশে, যার প্যাটার্ন পতিত ব্রিটিশীয়, যা মানবাধিকার পরিপন্থীই কেবল নয়, সংবিধানেরও পরিপন্থী কিংবা সংবিধানে জনগণকে দেওয়া মানবাধিকারকে খর্ব করে। কিন্তু এটি আইনপ্রণেতারা মানবেন না। কারণ তাঁরা আইনটি করেছেন সরকারের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য। যারাই সরকারের যৌক্তিক সমালোচনা করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার জন্য। তাঁরা একবারও ভাবেন না, এই আইন বুমেরাং হতে পারে, যখন তাঁরা ক্ষমতার বাইরে যাবেন। কিংবা জনগণের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকারের বিরুদ্ধে প্রণীত হচ্ছে এটি। জনগণকে শত্রু জ্ঞান করা এবং বিরোধী রাজনীতিকদের দমনের মানসিকতা মূলতঃ আমাদের রাজনীতিক ও প্রশাসনিক জনশক্তির ব্রিটিশবাহিত মননের উত্তরাধিকারী।
এবার আসা যাক, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ধসে পড়ার ব্যাপারে। সরকার অবশ্যই ওইসব ধসে পড়া ঘর পুনরায় নির্মাণ করে গরিবদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু যারা ওই ঘরগুলো নির্মাণ করেছেন, সেই ঠিকাদার, ওই প্রকল্পের সংগে সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা এজন্য দায়ী। আমার ধারণা, প্রকল্পের সব কর্মকর্তার কাছে থেকে যেমন ওই টাকা ফেরৎ আনতে হবে, তেমনি ঠিকাদারকে যে টাকা দেওয়া হয়েছে, অপরাধের কারণে তার কাছে থেকে দ্বিগুণ অর্থ আদায় করতে হবে। এটা করা হলে ভবিষ্যতে এরা চুরি বা লুটপাট করতে আগ্রহী হবে না। এই প্রকল্পে দ্বিতীয় দফায় জনগণের অর্থ ব্যয় করাটা হবে খারাপ নিদর্শন।
যেসব গৃহহীন মানুষের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিলো, খুবই ভালো একটি মানসিকতাপ্রসূত উদ্যোগ বলে মনে করি। ওইসব গরিবের দিকে সরকার প্রধান যে কেবল দৃষ্টিপাতই করেননি, তাদের জন্য কিছু একটা করতে চেয়েছেন, তাঁর এই মানসিকতাকে অবশ্যই বাহবা দেবো। কারণ, প্রকল্পটি মানুষের প্রতি দরদ ও ভালোবাসারই প্রকাশ। কিন্তু তাকে নস্যাৎ করতে উঠে-পড়ে লেগেছে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ঠিকাদাররা। ওই দু’পক্ষ কোনোভাবেই সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির অনুকূলের মানুষ নয়। তারা লুটপাটকেই প্রধান কাজ বলে মনে করেছে। বিএনপি নেতা এমরান সালেহ প্রিন্স বা যে কোনো সচেতন মানুষই এটা মনে করবেন যে, মেগা ও ছোট, সব সেক্টরেই মাত্রাতিরিক্ত লুটপাট হচ্ছে। এর রাশ টেনে ধরা জরুরি।
Posted ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৯ জুলাই ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh