ড. মাহবুব হাসান | বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০
শনিবারের দিনটা যে এমন ঝকঝকে রোদে ভরা থাকবে, সেটা আমি ভাবিনি। ঘুম ভাঙার পরই তা টের পেলাম। ৯:১০-এ ঘুম ভাঙলে আলোর ইশারা আমাকে নিয়ে গেলো তার উৎসে। আমার ভেতরে আনন্দ যেন উছলে উঠলো।
কিন্তু কিভাবে দিনটিকে ইউজফুল করা যায় ভাবছিলাম। আপাতত তো কাজ নেই আমার, তাই লেখাটাকেই প্রধান করেছি গত মার্চ থেকে। করোনা মহামারীর কারণে অফিস আমাকে বাসায় থাকতে নির্দেশ দেয়ায়, আমার জন্য সোহাগার মতো হলো। কিছু একটা লিখবো ভেবে হাত-মুখ ধয়ে এসে একগ্লাম পানি খেয়ে তৈরি হচ্ছি লেখার জন্য। ল্যাপটপও ওপেন করেছি। এর মধ্যে কাজী জহিরুল ইসলামের ফোন, ওস্তাদ, ঘুম ভাঙলো? বললাম, ভেঙেছে। তাহলে নাস্তা করে এগারোটায় হিলসাইডে চলে আসুন। আজকে হাডসন নদীর তীরের একটি পার্কে যাবো। আমি বললাম, সে তো কাল যাবো, আজ কেনো? কালকে বৃষ্টির সম্ভাবনা, তাই আজকেই। অগত্যা তৈরি হচ্ছি। আমির আজম ভাই বললেন কোথায় যান? নাস্তা করতে, হিলসাইডে। আমিও যাবো। কিন্তু হিলসাইডে যাওয়া হয় না। সামিয়া এসে বলে আঙ্কেল আম আর মুড়ি খান। শুনে মনে হলো, কেন পয়সা খরচ করে তৈলাক্ত পরোটা খাবো। আম-মুড়িই ভালো। এবং আমরা আম-মুড়ি খেলাম। আজম ভাই যাবেন না কোথাও, বাসায়ই রয়ে গেলেন। আমি ঘরোয়া রেস্তোরাঁয় ঢুকে দশ পরোটা আর দশ রুটির সাথে বুটের ডাল, মিক্স সবজির অর্ডার করলাম। সাড়ে দশটা বেজে গেলেও জহিরের দেখা মিললো এগারোটা তিরিশে। তারপর ছুটলাম আমাদের বন্ধুদের সংগ্রহের কাজ। তারপর হাডসন রিভারের উদ্দেশ্যে।
২.
আমি বেড়াতে খুব পছন্দ করি। কিন্তু রাব্বুল আলামিন সেই পছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে অর্থ-বিত্তের যোগান দিচ্ছেন না আমাকে। আগেও সেটা হয়নি। ফলে তেমন কোথাও যাওয়া ও দেখা হয়ে ওঠেনি আমার। এবছর বেড়ানো তো কোভিডের কারণে হয়নি। সামারে নিউইয়র্কের বসতিরা বেরিয়ে পড়ে আনন্দ উপভোগে। স্বল্পবসনা ললনাদের সুখের দিন নষ্ট করেছে কোভিড-১৯। তারপরও যতটা চোখে পড়ে তাদের উচ্ছল জীবন দেখে ভোগীর নেশা জাগে।
এখন তো, মানে সেপ্টেম্বরই হলো সামারের গোধূলিবেলা। তাই কি মানুষ এতোটা নাভিশ্বাসে ছুটছে। আমাদের এক ঘন্টার মতো ড্রাইভে অসংখ্য গাড়ির হন্যে হয়ে ছোটা দেখে আমার সে-রকমই মনে হলো। হাডসনের পারের ক্রোটন ল্যান্ডিং পয়েন্ট পার্কের আবিস্কারক কাজী ফৌজিয়া। তিনি আগেও এসেছেন এ-পার্কে। তিনিই কথা বলছিলেন চলতি পথে। আমরা শুনছিলাম। জহির খুব ভালো ড্রাইভ করেন। তিনিও বেশ ভালো বাসেন ড্রাইভ ও বিভিন্ন পার্কে ও রিসোর্টকেন্দ্রিক প্রাকৃতিক পরিবেশে সপরিবারে বেড়াতে। আজ আমরা আবারো তারই পরিবারের অংশিদার হয়েছি। একটা তথ্য দিয়ে রাখি, ২২ সেপ্টেম্বর আমি পরোনো কয়েকজন কলিগের সাথে যাচ্ছি নিয়াগারা ওয়াটার ফলসে, বেড়াতে। এবার নিয়ে আমার তৃতীয়বার দর্শণ হবে নিয়াগারা।
আমরা যখন হাডসন ক্রোটন পয়েন্ট পার্কে পৌছালাম তখন দুপুর একটা বেজে গেছে। একটি গাচেন ছায়ায় মাদুর বিছিয়ে আমরা নাস্তা সেরে নিলাম। হাডসন বেশ বাতাস দিচ্ছে। আমি গাছের ছায়া ছেড়ে এসে রোদে বসলাম।
নদীর বিশাল রূপ দেখে আমার মনে পড়লো হাডসন বে-তে কি আমরা এসেছি? নাকি সেটা আরো দূরে? হাডসন বে যে এ-দেশে নয়, সেটা গোগল ও উইকিপিডিয়া না জানালে আমরা একটা ভুল থেকে যেতো। ৩১৫ মাইল লম্বা এই হাডসন নদী নিউ ইয়র্কের আপস্টেটের আডিরনডাক মাউনটেইন থেকে উৎপন্ন হয়ে সোজা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে হাডসন ভেলির ভেতর দিয়ে নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যানহাটানের গাঁ-ঘেষে ও নিউ জার্সির মধ্য দিয়ে। ১৬০৯ সালে এ-নদী আবিস্কার করেন একজন ইংরেজ নাবিক হেনরী হাডসন।তিনি কাজ করতেন ডাস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে। পরে তিনি হাডসন বে-ও আবিস্কার করে নাম রাখেন নিজের নামে হাডসন বে। হাডসন বে কানাডায় , আমেরিকার সাথে তার কোনো সংযোগ নেই। জেনে আমি অবাক ও আনন্দিত হলাম। সারা জীবনে কতো যে ভুলকে শুদ্ধ করতে পারিনি, তার হিসাব কে রাখে?
সবার আগে হাঁটতে বেরুলাম আমি আর আনোয়ার হুসেইন মন্জু, পেছনে জহির আর তার দুই মেয়ে সারাফ জল আর নভো, তার পরে এলেন মুক্তি ও মনি ভাবী। ন্যারো স্পেসের এই পার্কটি কিন্তু দৈর্ঘে অনেক বড়। মনে হয় ৮০৪ মিটার। হাঁটার পথে বায়ে হাডসনের পারে ঢেউগুলো আছড়ে পারছে। সেই পাড়ে রক বোল্ডার দেয়া।ফেলে ঢেউগুলো এসে চুমু কায় রকি ঠোঁটে। আর ডান পাশে বিভিন্ন ক্যাকটাস আর বন্য ঝোপের লম্বা সারি। কোনো কোনো বন্য ঝোপে পেলাম ফুল। নাম জানি না, চিনতেও পারছি না সেই ফুলগুলো বাংলাদেশের কোন কোন ফুলের সাথে চেহারায় মেলে। একটিকে মনে হলো ভাট ফুল, একটি কলকিমুখো কলমি ফুলের মতো, কিন্তু নীল আর শাদায় রাঙানো না সেগুলো। একটা ঝোপের মধ্যে একাকি ফুল দেকতে পেলাম। আর একটি সুন্দর গাছের কাছে নিয়ে গেলো নভো। বললো, আঙ্কেল এই ফল খেতে বেশ মিষ্টি। দেখলাম লালচে বাদামি ছোটো আকারের সেই ফল। পেকে গেলে রং হয় ঘন-নীল, যা দেখতে কালো মনে হয়। নভো বললো এর নাম বীচপ্লাম। আমি বেশ কিচু বীচপ্লাম তুলে খেলাম। আর ছবি তুললাম তার। বীচপ্লামের পুরুষ্ট চুচা বা চামড়ার নিচে মিষ্টি মাংস আর তার নিচে বিচি। ফলের ত্বকে দাঁত লাগায় তিতা লাগলো। এতো ছোটো যে আমার দেশের পাংকিচুংকি মনে হলো। আবার মনে হলো এটি বংকুই গোটার মতো। বংকুই গোটার মাংস বেলে বেলে, কিন্তু এটা কিছুটা চেরির মতো স্বাদের।
আমরা যে গাছটির নিচে মাদুর পেতেছিলাম, ফিরে এসে দেখলাম তার ছায়া পুবদিকে হেলে গেছে। ফলে মাদুর এখন খোলা রোদের নিচে। আমাদের সাথে ছিলো আরবীয়ান কিংবা ক্যালিফোরনিয়ার খেজুর। সেগুলো রোদের তাপে বেশ গরম। খেতে বেশ লাগলো। আরেক দফা চায়ের আয়োজন হচ্ছে। দেখলাম ঘড়ির কাঁটা ৪টায় এসে গেছে।
আমরা ক্রোটন পার্কের ইয়ট আঙিনার দিকে, সেটা পুবে, হাঁটতে থাকলাম। পার্কের পাশেই ইয়ট ইয়ার্ড। সেখানে আমাদের কিছু করার নেই। সেই অংশ পেরিয়ে গেলেই আমরা পেলাম ল্যান্ডিং পার্কের আরেকটি অংশ। সেখানে ঢোকার মুখে দুই পুলিশ কর্তব্যরত। এখানে স্থানীয়রা ছাড়া অন্যদের ঢোকার অধিকার নেই। এখানকার স্থানীয় সবাই, ধারণা করি শ্বেতাঙ্গ। এদেশে শাদাদের জন্য প্রায় সব জায়গায়ই বিশেষ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা। কালো আর অন্য ইমিগ্রান্টদের জন্য আলাদা জায়গা। এই অমানবিক বৈষম্য, আমেরিকান হোয়াইটদের মানুষ থেকে ইতরের কাতারে নামিয়ে এনেছে। যে সব শাদা এ-দেশের সংবিধান রচনা করে মানবতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন, তারা জানতেন কিংবা জানতেন না যে পরবর্তী প্রজন্মগুলো সেই পথে হাঁটবে না। ১৭৮৬ থেকে ২০২০ হিসেবে তিনশ বছরের ব্যবধানও, এদেশের শাদাদের মনে তথাকথিত হোয়াইট সুপ্রেমেশির রোগ রয়ে গেছে, সেই রোগ থেকে তারা মুক্ত হতে পারেনি। এই দু:খ নিয়েই সেদিনের সেই আনন্দযজ্ঞ থেকে ফিরতে হলো আমাদের।
নদী পানি আর প্রকৃতিই জন্মদাতা এই সভ্যতার। সেই প্রায় ন্যাচারাল সেই সভ্যতাকে জ্বালাময় করে তুলেছে যান্ত্রিক সভ্যতার হিংস্র মনোস্কামনা। নিজেকে সুপ্রিম ভাবনার পেছনে কাজ করে এক বর্বর মনোস্তত্ত্ব, নিজের গায়ের রঙের বিবেচনায়, যা মূলত মিথ্যা। একদল হোয়াইট নৃ-বিজ্ঞানী তাদের গবেষণায় বলেছেন যে খাদ্যের সন্ধানে একদল আদি কালো মানুষ, আফ্রিকা থেকে ইউরোপে এসে পড়ে। এবং তারাই মাত্র ২৪ হাজার বছরের বিবর্তনের ফলে প্রথমে ফ্যাকাশে ও পরে ফ্লেসি বা রক্তাভ রঙ ধারণ করে। সেটা ঘটে আবহাওয়ার কারণে। আজকের হোয়াইটরা তাদেরই উত্তরাধিকার। তারা বলেছেন, মানুষ আদিতে কালোই ছিলো। পরবর্তীকালে আবহাওয়ার রসায়নে শাদা, পীত বা হলুদ, বাদামি হয়ে যায়। যারা আফ্রিকায় থেকে যায় তারা কালো রঙেই থাকে।
তাই রঙ নিয়ে মানুষ বিবেচনা নয়, মানবতাই মানুষের প্রথম সোপান, এটা শাদা রঙের মানুষদের বুঝতে হবে। সে সময় অনেক আগেই এসেছে। কিন্তু ট্রাম্পের মতো বর্ণবাদিদের কারণেই সেই রোগমুক্ত হচ্ছে না।
Posted ৮:৩০ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh