সেতারা কবির সেতু | বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন ২০২১
আমি যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখন আমার বাবা মারা যান। আমার ছোট একটি বোন আছে। মা খুব কষ্ট করে আমাদের বড় করছিলেন। বাবা তেমন কিছু রেখে যাননি। বাবার সম্পদ বলতে শুধুমাত্র একটি মাটির ঘর রয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার ছয় মাস হতে না হতেই চাচা, ফুফুরা আমাদের কাছ থেকে সেই ঘরটিও কেড়ে নেয়। আমার আজও মনে আছে সেদিন আমার মাকে তারা খুব মেরেছিলো। মায়ের কপাল ফেটে রক্ত পড়ছিলো। আমি চিৎকার করে কাঁদছিলাম। দৌড়ে গিয়ে চাচার পা ধরে বলেছিলাম, মাকে আর মারবেন না। আল্লাহর দোহাই লাগে, আমাদের ছেড়ে দিন আমরা চলে যাবো। কিন্তু চাচা আমার কথা শোনেননি।
আমাকে লাথি মেরে ফেলে দেই। আমার মুখটা দেওয়ালের সাথে লাগে। সামনের দাঁতটা ভেঙে যায়। ছোট বোনটা ভয়ে কাঁপতে থাকে। সকল ঘটনা দাদীর সামনেই ঘটে। দাদী নীরব থাকে কোন প্রতিবাদ করে না। দূর সম্পর্কের এক দাদা দৌড়ে এসে চাচা, ফুফুদের হাত থেকে মাকে বাঁচায়। দাদা তাদেরকে বলে তোমাদের কি এতোটুকু দয়া, মায়া নেই। তোমরা বউটাকে কিভাবে মেরেছো? ছোট বাচ্চাটার গায়েও হাত তুলেছ। এতো পাষাণ তোমরা। অথচ তোমাদের ভাই তোমাদের জন্য কতো কিছু করেছে। তার প্রতিদান তোমরা এভাবে দিচ্ছ!
দাদীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ভাবী আপনার সামনে এতো অত্যাচার হচ্ছে আর আপনি কিছু বলছেন না। কিভাবে পারছেন নীরব থাকতে। বড় চাচা উঁচু গলায় দাদাকে বললেন, চাচা এটা আমাদের পরিবারের বিষয়। আপনি এখানে কথা বলবেন না। আপনি বাড়িতে যান। দাদা মাকে শুধু বললো, বউমা বাঁচতে চাইলে ছেলেমেয়ে দুটিকে নিয়ে বাবার বাড়ি যাও। তাছাড়া এরা তোমাকে বাঁচতে দিবে না। সেদিন সন্ধ্যায় মা আমাকে আর রিতুকে সাথে নিয়ে নানার বাড়ি আসে।
নানা, নানীর একমাত্র সন্তান আমার মা। বড্ড আদরের মেয়ে আমার মা। তারা মাকে এভাবে দেখে খুব কষ্ট পেল। নানী আমাদের জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। নানা চোখের পানি মুছতে, মুছতে বললো, আমি কতো আদরে আমার মেয়েটাকে বড় করেছি। তার গায়ে কখনো ফুলের টোকা লাগতে দেয়নি। আর আজ…..। নানা আর কথা বলতে পারছে না। গলাটা ভারী হয়ে আসছে। শুধু বললো, আমি যতোদিন বেঁচে আছি বুক দিয়ে আগলে রাখবো তোদের। তোর আর ওখানে যাওয়ার দরকার নেয়।
নানার বাড়িতে ভালোই চলছিল আমাদের দিন। কিন্তু দুঃখ যাদের সাথী তারা কি আর বেশিদিন ভালো থাকতে পারে। আমার মায়ের এই অবস্থা সহ্য করতে পারলো না নানী। একদিন ফজরের নামাজে সেজদা অবস্থায় নানী মারা গেল। নানী মারা যাবার এক বছর পর নানাও চলে গেল ওপারে। আমরা আবার অবিভাবক শূন্য হলাম। কিছুদিন পর নানার ভাইয়ের ছেলেরা অর্থাৎ আমার মামারা আমাদের সাথে খারাপ আচরণ করা শুরু করলো। তাদের সবার দৃষ্টি নানার বসত বাড়ি ও জমি। আমি তখন ৫ম শ্রেণিতে পড়ি। মা সবার সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে পারছিলো না। গরীবের দুঃখ কেউ বুঝে না। অসহায়ের পাশে কেউ আসে না। মামারা একদিন জোড় করে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমি আর মা প্রতিবাদ করাতে আমাদের খুব মারধর করে। আমার মাথায় খুব মারে ছোট মামা। তখন থেকে আমার মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হয়। গ্রামে অনেক বিচার, সালিশ হয়। সবাই আমাদের থাকতে বলে নানার বাড়িতে। কিন্তু মামাদের অত্যাচারে আমরা সেখানেও টিকতে পারিনা।
আমাদের দুই জনকে নিয়ে মা কোথায় যাবে ভেবে পায় না। মাথার উপর দিগন্ত আকাশ যেন আমাদের ছাদ আর জমিন আমাদের বিছানা। কিন্তু এভাবে তো জীবন চলে না। মা গ্রামের এক ধনী ব্যক্তির বাড়িতে আমাকে কাজে দিলো। থাকা, খাওয়া সেখানেই। আমার শুধু একটাই চাওয়া ছিলো। সব কাজ শেষ করার পর আমাকে একটু পড়ার সুযোগ দিতে হবে। মা, ছোট বোন রিতুকে নিয়ে অন্য এক বাড়িতে কাজ নিলেন। মা আর রিতু ওখানেই থাকে। মা মাঝে, মাঝে আমাকে দেখতে আসতো। আমার খুব ইচ্ছে হতো মাযের সাথে যাওয়ার।
কিন্তু কিছু বলতে পারতাম না। মা আমার চোখ দেখে বুঝতে পারতো। প্রত্যেক বার চলে যাওয়ার সময় আমাকে আদর করে বলতো, একদিন আমাদের সব কষ্টের শেষ হবে। আমরা সবাই একসাথে থাকবো। আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী। তিনি আমাদের প্রতি এতো নির্দয় হবেন না। আঁচল দিয়ে চোখ মুঝতে, মুঝতে মা চলে যায়। রিতু আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকে। সে কিছুতেই আমাকে ছেড়ে যেতে চায়না। মা মিতুকে জোড় করে টেনে নিয়ে দ্রুত পায়ে চলতে থাকে। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। মা পিছনে ফিরে তাকায় না। আমি চোখ মুছতে, মুছতে ঘরে যায়।
সেদিন আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাজ করছি। বাড়ির সব কাজ শেষ করে গরুগুলোকে খাবার দিলাম। দিনের মধ্যে কাজ শেষ করলাম। কারন সন্ধ্যায় আমাকে পড়তে বসতে হবে। পরের দিন আমার পরীক্ষা। আমি সন্ধ্যায় পড়তে বসেছি। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ একজন আমাকে খুব জোরে পিঠে লাঠি দিয়ে মারলো। আমি পিছনে ফিরে তাকাতেই আমার চুলগুলো ধরে বললো, তোকে কি পড়াশোনা করার জন্য এনেছি ফকিন্নির বাচ্চা। তিন বেলা খাবার পাচ্ছিস তো গায়ে লাগছে না।
আমি বললাম খালু আমিতো সব কাজ শেষ করেছি। উনি আমাকে কোন কথা বলার সুযোগ দিলেন না। কালকেই তোর মাকে খবর দিবো। তোকে এসে নিয়ে যাক। ছোট লোকের ফুটানি কতো! পেটে ভাত জোটেনা আবার পড়াশোনা শিখে জজ, ব্যরিস্টার হতে চায়। পরের দিন মা আসলো। মা আমার কাছ থেকে কিছু না শুনেই আমাকে মারলো আর বললো, যার থাকার কোন জায়গা নেয়, তিনবেলা খাবারের কোন নিশ্চয়তা নেয় তার জন্য পড়াশোনা বিলাসিতা। আমার খুব কষ্ট হলো এটা ভেবে যে মা আমাকে বুঝলো না।
আমাকে কড়া ভাবে শাসন করা হলো আমি যেন আর বই, খাতা হাতে না নেই। সেদিন আকাশে কালো মেঘ ছিলো। মনে হচ্ছিল একটু পড়েই অঝোরে বৃষ্টি নামবে। মেঘ ডাকছে সবাই চলে গেল আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি আমাকে সমবেদনা জানাতে এসেছে। আমার সাথে বিশাল আকাশও যেন কাঁদছে। ব্যাথাতুর হৃদয় নিয়ে বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি চিৎকার করে বলছি হে আল্লাহ, তোমার এই দুনিয়াতে মানুষগুলো কেন এতো নির্দয়। কিছু মানুষ কি দুঃখ পাবার জন্যই পৃথিবীতে আসে। তারপর একদিন দুঃখকে সাথী করে এই পৃথিবী থেকে চলে যায়।
হঠাৎ খুব জোরে বিদ্যুৎ চমকালো। মনে হলো আমার হৃদয়ের সুপ্ত শক্তিটা জাগ্রত হলো। আমি আর ঐ বাড়িতে ফিরলাম না। বৃষ্টির মধ্যেই চলে এলাম বাজারে। একটি হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ ধরে। হঠাৎ হোটেল থেকে একজন লোক আমাকে ডাকলেন। তিনি আমার সব কথা শুনে তার হোটেলে আমাকে কাজ দিলেন। সেই সাথে পড়াশোনার সুযোগ দিলেন। হোটেলে কাজ করি সেই সাথে যখন সুযোগ পাই পড়াশোনা করি। একদিন আমার খোঁজে মা এই হোটেলে আসলেন। আমি মাকে জানিয়ে দিলাম আমি পড়াশোনা করবো। এখানে আমি বেশ ভালো আছি। মা আমাকে সাথে নিয়ে যেতে চাইলেন। আমি রাজি না হওয়াতে মা একটু কষ্ট পেলেন।
আমি এস.এস.পাশ করলাম। তখন গ্রেড ছিলো না। ছিল ডিভিশন। আমি লেটার নিয়ে ফাস্ট ডিভিশন পাওয়ায় স্কুলের শিক্ষকরাই আমার কলেজে ভর্তির ব্যবস্হা করলেন। যেদিন রেজাল্ট হলো, সেদিন মাকে জানাতে গেলাম সেদিন মা খুব খুশি হলেন। সেই সাথে একথা বললেন, আর পড়তে হবে না বাবা। আমরা গরীব মানুষ। তোর বোন বড় হচ্ছে। তাকে বিয়ে দিতে হবে। তুই বড় ভাই তোর দায়িত্ব অনেক। আমি মায়ের সাথে একমত হতে পারলাম না। আমি মাকে বললাম, আমি পড়াশোনা শেষ করবো। মা কোন উত্তর দিলোনা।
আমি চলে এলাম। কলেজের একজন শিক্ষক আমার আর্থিক অবস্থার কথা শুনে আমার কলেজের বেতন মওকুফ করলেন এবং আমার জন্য একটি টিউশনির ব্যবস্হা করলেন। আমি এইচ, এস, সি পাশ করলাম। সেই শিক্ষকের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলাম। আমার কলেজের শিক্ষক আমাকে দুটি টিউশনির ব্যবস্হা করে দিলেন। হলে উঠলাম। টিউশনি করে নিজে চলি কিছু টাকা মাকে পাঠাই। অনার্স শেষ করলাম। তার আগের থেকেই চাকুরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। মাস্টার্সের পর, পরই ভালো একটি সরকারি চাকুরীতে জয়েন করলাম।
আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালোই চলছে সবকিছু। একদিন একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলো। ফোনের ওপাশ থেকে বললো, বাবা আমি পি. জি হাসপাতালে ভর্তি আছি। তোমাকে একটু দেখতে চাই। ফোন দিয়েছিলেন আমার সেই খালু। যার বাড়িতে আমি কাজে ছিলাম। আমি ফলমূল নিয়ে উনাকে দেখতে গেলাম। উনি আমার হাত দুটি ধরে বললো, বাবা আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি উনাকে বললাম খালু আমি কিছু মনে রাখিনি। আপনার যে কোন সমস্যা হলেই আপনি আমাকে বলবেন। শেষের দিকে উনি অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছিলেন না। আমার সামর্থ্য অনুযায়ী আমি উনাকে সাহায্য করলাম।
গ্রামে আমি একটা জায়গা কিনেছি। সেখানে ছোট্ট করে একটা বাড়ি করেছি। মা আর ছোট বোন সেই বাড়িতে থাকে। যদিও ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে। আমি তাদের আমার কাছে এনে রেখেছি। ঈদের ছুটিতে একদিন বাড়ি গেলাম। ছোট চাচা দাদাীকে নিয়ে আমার কাছে এসেছে। দাদী চোখে দেখতে পায়না ভালোমত। দাদী আমার হাত ধরে কান্নাকাটি করে বলে তার চোখ অপারেশন করলে সে দেখতে পাবে। মা কিছু একটা বলতে চাইলো, আমি মাকে নিষেধ করলাম। দাদীর চোখ অপারেশন করালাম। দাদী এখন দেখতে পায়। মাঝে, মাঝেই চাচারা ফোন করে বলে তারা খুব সমস্যায় আছে। যতোটুকু পারি সাহায্য করি।
যই মামারা অন্যায়ভাবে নানার বাড়ি থেকে আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছিলো। তারা আজ প্রায় আমাদের বাড়ি আসে। মা কেন তাদের বাড়ি বেড়াতে যায় না এটা নিয়ে তাদের খুব অভিযোগ। আমি বাড়ি গেলেই আমাকে দাওয়াত দেয়। খুব জোড় করে তাদের বাড়ি যাওয়ার জন্য। মামাদের এখন তেমন কিছু নেই। সম্পত্তির বেশির ভাগ বিক্রি করেছে। এখন মামারা মাঠে কাজ করে। আমার সাথে দেখা হলেই বলে সংসার চালানো খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে। জীবন যেন নাটকের চেয়েও অনেক বেশি নাটকীয়। কখন কার কি হয় কেউ বলতে পারে না। আজ যে রাজা কাল সে ফকিরও হতে পারে। যেই মানুষটার আজ কিছু নেই, গরীব বলে সবাই যাকে অবহেলা করছে একদিন হয়তো সেই মানুষটাই আপনার কাজে আসবে। তাই মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার না করি। গরীব, দুঃখীকে অবহেলা না করি। আপনি আজ অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ কেড়ে নিলেন। কিন্তু, আল্লাহ আপনার খুব প্রিয় কিছু কেড়ে নিলেন। আপনি সুখী হতে পারবেন তো তাতে। তাই আসুন, হিংসা, লোভ, অহংকার দমন করে একে অপরের পাশে থাকি। ধনী, গরীবের মধ্যকার বৈষম্য দূর করে সমাজে সম্প্রীতির সাথে বসবাস করি।
Posted ১২:০৫ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh