মোসাদ্দেক চৌধুরী আবেদ | বৃহস্পতিবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২০
কাজের জায়গায় বন্ধুরাই আমার সব। ওরাই আমার জীবন। ওদের জন্যই বোধহয় বেঁচে আছি এখনো। ওরা না থাকলে এতদিনে বাঁচতাম না আমি। ওদের জন্য সর্বদা আমার প্রাণ ছুঁয়ে যায়। ওরা কতোনা আমার আপন। কাজে গিয়ে ওদের হাসিমাখা মুখ খানা দেখে আনন্দে মন প্রাণ ভরে যায়। ওদের নির্ভরতা আমাকে কাঁদায়। ওদেরকে দেখলে মনে হয় না বিদেশের মাটিতে মুখ থুবড়ে পরে আছি আমি। মনে হয় ওরাই যেন আমার প্রানের স্পন্দন। ওদের জন্যেই আমার শিরা উপশিরা গুলো সতেজ আছে এখনো। ওদেরকে দেখলেই আমার শত ক্লান্তি কষ্ট নিমিশেই দূর হয়ে যায়। মনে হয় ওরাই আমার সারা জীবনের সাথি। ওদের কাছ থেকে মন আমার যেতে চায়না কিছুতেই। ওরা আমার খোঁজ খবর রাখে আমার উদাসীনতার জন্যে। বিদেশের মাটিতে আমার এমন বন্ধু কোথায় পাই। এসব বন্ধুদের সাথে কথা বলে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। আমরা পারস্পারিক ঠাট্টা মস্করা খুবই উপভোগ করি সব সময়। মাহবুব মিটি মিটি হেসে এসব ঠাট্টা খুবই উপভোগ করেন। এভাবে একদিনও বঞ্চিত হইনি তাঁদের ভালবাসায়।
সেদিন কাজের মধ্যে দাঁতের ব্যথা উঠে যায়। আমেরিকান বান্ধবী লিডিয়া ভ্যালরি কোথা থেকে আইস্ক্রীম এনে দিলেন। আমার ব্যথা নিবারন করার চেষ্টা করলেন। আমি অভিভূত হলাম বিদেশী বন্ধুটির এ ব্যবহারে। অর্থ দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম কয়েকবার- নিলোনা। এমনি ভাবেই ওদের ভালোবাসার কাছে আমি হেরে যাই। ঋণী হয়ে থাকি সব সময়।
শুধু তুলির কাছেই হেরে যাই। ও খুব ভালো মেয়ে। আই এম প্রাউড অফ হার। ও এত ম্যাচুউরড এত উন্নত ভাবিনি আগে। অনেক ধৈর্য ধরে অন্যের কথা শুনা তাঁর একটি বিশেষ গুণ। ওর এই স্বভাব উদারতা আমাকে মুগ্ধ করে। আই এডমায়ার হার। সুন্দর সেই, যার সুন্দর মন আছে। সৌন্দর্যের জন্য সুন্দর মনের দরকার হয়। প্রথম প্রথম তার সাথে সম্পর্ক সুখের ছিলোনা আমার। সেই আবার আমার সুখ চায় শুনে ভাল লাগলো। বন্ধু পারভেজ খাওয়ার কালে আমার হাত ধরে টেনে আনেন। খাবার তুলে দেন অনেক মমতায়। তা একবার দুবার নয় সব সময়। তার প্রাণ খোলা হাসি আমার অন্তর ছুঁয়ে যায়। পারভেজ-পপিকে দেখেছি খুব অল্পতেই খুশি হয়ে যায়। আমাকে দেখলে এই দম্পতির মুখে হাসি লেগে থাকে সব সময়। ওদেরকে দেখলে আমার কত না ভালো লাগে। পারভেজের মুখে স্ত্রী পপির উচ্চছিত প্রশংসা কত না শুনেছি কাজের ক্ষেত্রে।
কি ভাবতে না ভাবতেই বন্ধু শামসুল আলমের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। আমাকে জড়িয়ে ধরেন পরম মমতায়। ট্রেন স্টেশনে না জানি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন আমার আশায়। এমন মায়াজালে বন্ধুরা আমরা মিশে আছি ভালোবাসার মায়ায়। কাজে আসা যাওয়ার পথে তাদের সাথে প্রতিদিনই আমার দেখা হয়। আমার দিন শুরু হয় তাদের অনুপ্রেরণায়। এরাই আমার মাটির শিকড়। এদেরকে ছেড়ে আমি কোথায় যাই। আমরা প্রাণ ভরে অনেক গল্প করি। ফেলে আসা দেশের গল্প, জীবনের গল্প, পরিবারের গল্প। এদিক থেকে বন্ধু মাহবুবের কথাই শুনতে ভাল লাগে। সাহিত্য থাকে তার কথা বার্তায়। এভাবেই আমরা আগামীর স্বপ্ন দেখি। বেঁচে থাকি সুন্দর আলোকিত আরেকটি সকালের অপেক্ষায়। এক সময় আমরা যার যার থেকে বিদায় নিয়ে হাটতে থাকি যার যার নীড়ের ঠিকানায়।
প্রথম প্রথম আমেরিকায় আসার পর পথঘাট চিনতাম না। এরাই আমার চলার পথের সাথি ছিল সেসময়। কাজের পর মন চায় এক সাথে যাবার। মন কিছুতেই চাইছিলো না ইসমতকে ফেলে যাই। সেই অপরাধে আমার অফিসে যত কৈফিয়ত দিতে হয়। কিন্তু সেতো বুঝলোনা কিছুই। এভাবেই আমদের দিন আসে দিন যায়। তবে কথা থেকে যায়। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আপদে বিপদে সবাই সবাইকে প্রটেক্ট করে রাখবো এটাই চাই।
নিজের শিকড় থেকে সরে গেলে মানুষ বদলে যায়। বিদেশের মাটিতে সেই শিকড়ের মানুষ গুলোকে কাছে পেয়েছি বলেই আমি একটুও বদলে যাইনি আর। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা কখনো বদলায় না। আমি হয়ত তাদেরই দলে। যদি একটু ভালোবাসা ফেরত দিতে পারি। সেই চেষ্টাই করে চলি। শিকড়ের আনন্দটাই আলাদা। তোমাদের মত মানুষ গুলো আছে বলেই আমার সময়টা কেটে যায়। তোমরা ভালো থেকো বন্ধু। নিজের শিকড় থেকে চলে গেলে মানুষ একা হয়ে যায়। পৃথিবীতে কিন্তু একা থাকা যায় না। ওরা সবাই আমার আপন, সবাই ইম্পরট্যান্ট। আসলে আমার ভালো থাকাটা নির্ভর করে তোমাদের কারনে। কাজের ক্ষেত্রে এটা আমার এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি। এদের সাথেই আমার প্রবাস জীবনের বিশেষ একটা সময় কেটে গেছে। এরাই আমাকে সাহস দিয়ে শীতের রাত্রিটা কাটিয়ে দিয়েছে।
আমি মানুষটা বড় দুঃখী। আমার অনেক কষ্ট আছে মনে। কি পেলাম এ জীবনে। এ সমস্ত জানিয়ে আমার আর কি হবে। সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রাখি আর ওভাবেই ওভারকাম করে চলি। সব কিছুই ভাসিয়ে দিয়েছি মনের আগুনে। থাক, কথাটা আমার মনে হয়না বলার দরকার আছে। এ পৃথিবীতে একটা সময় এসে আমরা সবাই একা। একা এসেছি আবার একাই যেতে হবে। মাঝে মাঝে ভাবি এ সংসার থেকে বেড়ুনো দরকার। আর পারিনা। বছরের পর বছর কত দিন স্ত্রীর একটু স্পর্শ, একটু ছোয়াও আমি পাই না। নিদ্রাহীন কাটে আমার রাত। বুকের ভিতর চাপা ব্যাথা নিয়ে শুয়ে থাকি রাত-বিরাত। রাগ কষ্ট সব কিছুই আমি এ সংসারে জলাঞ্জলি দিলাম। সব সুখ একটা মানুষের জীবনে হয় না। তাই এসব বলে সবার মন ভারাক্রান্ত করতে চাই না। তারপরেও সেইতো আমার শেষ জীবনের সাথী। তুমিই আমার জীবনের সরলরেখা। আমার জীবনের শেষ অবলম্বন। শুধুমাত্র শেষ ভরসা। কি করে আমি তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখি। এত কিছুর বিনিময়েও সুখ বলে আমার আর রইলোনা কিছুই। জীবন আমার শেষ। জীবন বলতে আমার আর থাকলোনা কিছুই। প্রায় সময়ই মনটা আমার আনমোনা হয়ে যায়। কি ভাবি তাও জানিনা। আমার কি ইচ্ছা করে না নতুন জীবন নিয়ে বাঁচতে। পারি কি তাই! পারি তো না। জীবন থেকে সময় এভাবেই চলে যায়।
হায় খোদা কি করলে আমায়। অন্ধকারে হাতরাতে হবে সারাটা জীবন। নিজেকে ক্ষত বিক্ষত করে দিলাম। আর কত সামলাবো আমি। আমার তো সব কিছুই শেষ, আর কিছু বাকি নেই আমার। কতটা কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি আমি। খোদা একটা সহ্য শক্তি দাও আমায়।
মানুষের দুর্ভাগ্য কিভাবে ভর করে কেউ জানে না। সেদিন দেশ থেকে বন্ধু জালালের বউ ও ছেলের ফোন আসে। জালাল মারা গেছেন। পূবালী ব্যাংকের ডিজিএম ছিলেন। সান্তনা দেবার জন্য কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি। বুকের ভিতরে তীব্র কষ্টের বেগ চাপা দিচ্ছে, যেন সব আলো নিভে গেছে। কলমের কালি আলো খুঁজে পায়না। ওদের বুকের হাহাকার ফুটে উঠেছে আমার হৃদয়ে। ওরা যেন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। জীবনের আলো নিভে গেছে জালালের। শেষবারের মতো দেখে এসেছিলাম ঠিক আট বছর আগে। জগতে রক্তের সম্পর্কের চেয়ে আত্মার সম্পর্ক কোন অংশে কম নয়। তার আত্মা শান্তি পাক প্রভুর কাছে কায়মনো বাক্যে প্রার্থনা করি।
সাথে সাথে আমার বড় বোন বুলবুল আপার মুখ খানা মনে কোনে ভেসে উঠেছে। বড় বোন মায়ের মতন। তাঁর শরীরে মায়ের ঘ্রাণ খুঁজে পাই। তাঁকে দেখিনা বহু বছর হয়। না জানি কেমন আছে সে এখন। তুমি আমাদের জীবনে বটবৃক্ষের মত। আমরা সকলে মিলে তোমার হাসি মুখখানা দেখতে চাই।
আমার এ পৃথিবী অল্প কিছু মানুষ নিয়ে। তাঁর কিছু হলে কিভাবে বাচবো আমি এ পৃথিবীতে। আমার কাছে তাঁর দাম আমার জীবনের চেয়েও বেশি। করোনা মহামারিকালে মায়াবী পৃথিবী মায়া ছেড়ে চলে গেছে, এই বোনটিই আমার পৃথিবী। মা-বাবা হারা পৃথিবী মোদের। গাড়িতে উদাস মনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মন চাইলেও বোনটিকে স্পর্শ করতে পারিনা আমি। এই বোনটি আমাদের আগলে রেখেছে মায়ের মতন। তাঁর বাঁধনে আমরা বড় হয়েছি। তাঁর ঋণ শোধ করতে পারবোনা কোন দিন। বিদেশে বন্ধুদের সান্যিধ্য পেয়ে সব কিছুই ভুলে যাই। এরাই একান্ত আপনজন কাছের হয়ে উঠেছে আমার। আমেরিকায় যখন এসেছি কি কঠিন জীবন। বাঙ্গালীদের রাজধানী খ্যাত জ্যাক্সন হাইটসের একটু কাছে উডসাইডের সাবওয়ের ধারে ৬১ স্ট্রিটে ৩৯ এভিনিউর একটি এপার্ট্মেন্টে বসবাস শুরু করি। টানা আট বছর থাকার সুবাদে সেখানকার দোকানপাট অলিগলি মানুষজন একান্ত আপনজন হয়ে উঠেছে। হাট-বাজার সব কিছু ওখান থেকেই চলে। ওরা কত সহজেই আমাকে নির্মল আনন্দ দিতে পারে।
বিশুদ্ধ বাতাসে হাটতে হাটতে ক্লান্ত শরীরে জ্যাক্সন হাইটসের বাঙালী রেস্টুরেন্টে বসে পরি। আমেরিকায় এসে বাঙ্গালীদের দেখে মনটা সতেজ হয়ে উঠেছে। চা খেতে খেতে বাঙ্গালী ভরা রাস্তায় হো হো করে মনের ফুর্তিতে হেসে উঠি। দেশের সেই ছোলা মুড়ি, পিয়াজু, কখনো কাবাব অথবা জিলাপি। মনের মধ্যে যেন অন্য একটা পৃথিবীর হাতছানি। এত বড় জায়গায় আমাদের কোন বিরোধ নেই। সবাই সবার আপন। বাঙ্গালীরা আমরা কেউ পিছিয়ে থাকবো না আর। সবাই আমরা এগিয়ে যাব নতুন জীবন গড়ার। আমরা যেন একে অন্যের আপন হয়ে থাকি সব সময়। মিলে মিশে থা্ক।ি সামনে চলার অনুপ্রেরনা জোগাই। তা দেখে একে অন্যে অনুপ্রাণিত হই।
আমার অন্য বন্ধুরা সিদ্দিকি, শিউলি, মোস্ট, হোসনা, নজরুল, পারুল, হামিদ, সাইদ আর মাসুমা। তারা আমার কাছের বন্ধু। এদেরকে ভেবেই আমি আমার জীবনের তরি ভাসিয়ে দেই।
কোথায় আমার মান্না, কত বছর হয় দেখিনা। এ বোনটির আওয়াজ যেন এখনো আমার হৃদয়ের দরজায় আঘাত লাগে। কোথায় আমার সোনার ভাই আজম। খুঁজে ফিরি, পাইনা তাঁকে! সে কি হারিয়ে গেলো অবশেষ। কোথায় আমার ছোট বেলার বন্ধুরা, কিভাবে হারিয়ে গেল তারা। আজকাল তাঁদের আর দেখিনা। কোথায় আমার জিয়া, নুর নবি, বেলায়েত আর আলি মামুদ। এমন বন্ধুদের আমি কিভাবে হারাই। এ মানুষগুলোকে ছেড়ে আমি কোথায় যাই। নিজের মানুষগুলোকে নিয়েই যেন থাকতে পারি সব সময়। যদিও একথা সত্যি যে পশ্চিমের ব্যতিব্যস্ত বিশ্বে এই সম্পর্কের নিবিড়তা ক্রমশই শিথিল হয়ে উঠেছে। লক্ষ্য করছি যে সম্পর্কগুলো এক সময় ঘনিষ্ঠ ছিল, সে সম্পর্কের বাধন ঢিলে হয়ে পরছে আস্তে আস্তে। সম্পর্কের নিবিড়তা ঠিক আগের মত দেখিনা। আন্তরিকতা কমে যাচ্ছে বলে মন আমার আপ্লুত করে বারে বারে।
প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। এখন পর্যন্ত বিশ্বে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪ কোটি ৬০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এই সময়ে বিশ্বে করোনায় মারা গেছে ১২ লাখ ১০০০ মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৯৪ লাখ ৫ হাজার মানুষ। দেশটিতে করোনায় মারা গেছেন ২ লাখ ৯৫ হাজার জন। করোনা মহামারী কালে আমেরিকার আগামীদিনের অর্থনীতির চেহারা কেমন হবে। আমেরিকার অর্থনীতির সামনে রয়েছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সমুহের অন্যতম মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের চাকরী হারানোর কথা। লেবার মার্কেটকে শক্তিশালী করা ছাড়া টেকশই অর্থনীতির ধারনা অবান্তর।
এম্বুলেন্সের শব্দে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায়। সাইরেনের শব্দে মন আমার মোচর দিয়ে উঠে। করোনার ভয়াল থাবা কার সংসারে থাবা দিচ্ছে। পরিচিতজন, আপনজনরা সুস্থ আছে কিনা। বুকের ভিতরে তীব্র কাপন শুরু হতে থাকে। বাড়ির সীমানা পেরিয়ে রুহুল আমিন ভুইয়ার বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াই। বাড়িটি আমার অনেক দিনের চেনা। কিন্তু গিয়ে দেখি আগের মত না। বাড়ির দরজা, জানালা সব বন্ধ। কারো মুখে আগের মত হাসি আর নেই। সবার মনে এক অজানা আতংক। সবার মুখে এক গভীর মেঘের ছায়া। চুপচাপ আকাশের দিকে তাকাই। কি করি, কোথায় যাই।
Posted ৯:৫০ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh