কাজী জহিরুল ইসলাম : | বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট ২০২৪
নানান কারণেই এখন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বেশ শীতল। সরকারী পর্যায়ে “শীতল” শব্দটি যথার্থ হলেও গণমানুষের আবেগকে যদি বিবেচনায় নিই তাহলে বলবো সম্পর্কটি একটি মৃতদেহে পরিণত হয়েছে এবং সেই দেহকে দাফন করার কাজ সম্পন্ন করেছে ভারত, তা করেছে বেশ কিছু নদীর বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতির ব্যপক অবনতি ঘটিয়ে। ইংরেজিতে হয়ত সম্পর্কের এইরকম অবস্থাকেই বলে, দ্য লাস্ট নেইল ইন দ্য কফিন।
কফিনের এই কাঠামো ভেঙে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কি আবার কখনো উঠে দাঁড়াবে? কোন সে ওঝা যিনি ফুঁ দিয়ে জীবিত করবেন এই লাশ? বাংলাদেশের মানুষ ভারতকে কেন পছন্দ করে না তার হাজারটা কারণ বলা যায়, বাংলাদেশ এখন যে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করছে এই সময়টাতে অন্য আলোচনায় না গিয়ে নদীর পানি ও বন্যা/খরা নিয়েই কিছু কথা বলি। মানুষ কৃত্রিমভাবে পুকুর, দিঘি, লেইক বানাতে পারে কিন্তু নদী বা সমুদ্র বানাতে পারে না। নদী বা সমুদ্র প্রকৃতির এক অনিন্দ্য সৃষ্টি।
একটি পাহাড়ি ঝর্ণা কী অসাধারণ ছন্দে নাচতে নাচতে সমুদ্রে গিয়ে নামে, এই ছন্দে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা অন্যায়। নদীর জন্ম পর্বতে, তখন এর নাম হয় ঝর্ণা, এই ঝর্ণাধারা সমতলে নেমে এসে হয়ে যায় নদী এবং সমতলে প্রবাহিত হতে হতে মৃত্যুর জন্য সে খোঁজে উত্তাল সমুদ্রের এক সুবিশাল বুক। পাহাড় থেকে সমুদ্র এই দীর্ঘ পথে নদী প্রবাহিত হবে তার আপন গতিতে, আপন মহিমায়, আপন ছন্দে, কেউ তাকে বাঁধা দেবে না। মানুষ যেমন মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না, তাই মানুষকে হত্যা করারও কোনো অধিকার তার নেই। ঠিক তেমনি মানুষ নদী সৃষ্টি করতে পারে না, কাজেই কোন অধিকারে সে নদীর গতিপথ বদলাবে, বাঁধা দেবে? এই কথাগুলো কবিসুলভ আবেগে ভরা মনে হলেও আন্তর্জাতিক আইনও কিন্তু নানান ফ্রেমওয়ার্কের মধ্য দিয়ে এই কথাটিই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে।
১৯৬৬ সালের আগস্ট মাসে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে আন্তর্জাতিক আইন সংস্থার এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার ও বন্টন নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন পাশ হয়। নদীর উৎপত্তি যে দেশের পর্বতে সেই দেশ তার ইচ্ছেমত নদীর গতিপথ বদলে দিতে পারবে না, ইচ্ছে মত বাঁধ নির্মাণ করতে পারবে না। মূল নদী এবং তার সকল শাখানদী যেসব দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সেসব দেশ যেন নদীর পানি যথাযথভাবে পায় তা সংশ্লিষ্ট দেশগুলো পারস্পরিক সমঝোতা বা আলাপ-আলোচনা ভিত্তিতে, প্রয়োজন হলে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সাক্ষরের ভিত্তিতে, ঠিক করে নেবে। অর্থাৎ পাহাড় আমার, ঝর্ণা আমার সুতরাং নদীও আমার, মালিকানার এই ধারণা এখানে চলবে না। নদীর গতিপথে কোনো ধরণের বাঁধ নির্মাণ করতে গেলে, গতিপথ বদলে দিতে চাইলে, ভাটির দেশের সম্মতি নিয়ে তা করতে হবে। ভারত থেকে ৫৪টি নদী বাংলাদেশে নেমে এসেছে, বাস্তবতা হচ্ছে এই ৫৪টি নদীর পানি ভারত তার ইচ্ছামত ব্যবহার করে। যেখানে খুশি বাঁধ নির্মাণ করে, যখন ইচ্ছা বাঁধ খুলে দেয়, যখন ইচ্ছা বাঁধ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে বাংলাদেশে কখনো খরা কখনো বন্যা হয়। প্রায়শই বাংলাদেশের খরা এবং বন্যা প্রকৃতির স্বাভাবিক কারণ ছাপিয়ে ভারতের স্বচ্ছাচারিতার ফল হয়ে ওঠে।
যদি প্রতিটি নদী আপন স্বভাবে তার স্বাভাবিক গতিতে ভারতের পাহাড়-পর্বত থেকে বাংলাদেশে নেমে আসত এবং বাংলাদেশের সমতল চুম্বন করে গিয়ে নামত বঙ্গোপসাগরে তাহলেও মাঝে মধ্যে, যে বছর অধিক বৃষ্টিপাত হত সে বছর বন্যা হত এবং যে বছর কম বৃষ্টিপাত হত সে বছর খরা হত। কিন্তু সেই খরা বা বন্যা মোকাবেলায় মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যেত এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রশাসন সেইসব বন্যা এবং খরা মোকাবেলার জন্য আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত। নানান রকম বাঁধ দিয়ে, কখনো পানি ছেড়ে, কখনো পানি আটকে দিয়ে, প্রকৃতির সেই নিয়ন্ত্রণ এখন যেহেতু ভারত তার হাতে নিয়ে রেখেছে, তাই বাংলাদেশ আগে থেকে বুঝতেই পারে না কোন বছর কতটুকু বন্যা হবে, কোন বছর কতটুকু খরা হবে। ভারত হয়ে গেছে আমাদের ভূ-প্রকৃতির নিয়ন্ত্রক।
১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এই মর্মে একটি প্রস্তাব পাশ করে, কোনো রাষ্ট্র তার এখতয়ারের বাইরে এমন কিছু করবে না যা অন্য রাষ্টের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। ভারত জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্র এবং দক্ষিণ এশিয়ার একটি বৃহৎ রাষ্ট্র। তাদের অনেক কর্মকাণ্ডের প্রভাবই প্রতিবেশি দেশের ওপর পড়ে। কাজেই জাতিসংঘের এই বিল অনুযায়ী নদীতে বাঁধ দেবার মত কাজগুলো তাদেরকে অনেক বুঝে-শুনে, আলাপ-আলোচনা করেই করতে হত। কিন্তু এসব বিষয়ে ভারত কখনোই বাংলাদেশের স্বার্থকে বিবেচনায় না নিয়ে একটি মন্দ প্রতিবেশি হয়ে উঠেছে।
১৯৭২ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে জাতিসংঘের একটি সম্মেলন হয়, যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল মানব পরিবেশ [ঐঁসধহ ঊহারৎড়হসবহঃ]। সেই সম্মেলনে এই প্রস্তাব পাশ হয়, কোনো দেশ এমন কোনো কাজ করবে না যা অন্য দেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভারতের ফারাক্কাসহ সকল বাঁধ বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের একটি অন্যতম প্রধান কারণ।
বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে যারা সরকার গঠন করেছেন তারা কোনো না কোনোভাবে ভারত তোষণ করেছেন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। কারণ সামরিক, অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক সকল দিক থেকেই ভারত বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ও সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই বদ্ধমূল দারণা কাজ করে, ভারত চাইলেই বাংলাদেশের সরকার বদলে দিতে পারে, যাকে ইচ্ছা তাকে সরকারে বসাতে পারে। কিন্তু ২০২৪ এর জুলাই বিপ্লব এই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে।
ভারত তাদের প্রিয় ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে রক্ষা করতে পারেনি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠিত হয়েছে সেই সরকার বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করে। এই সরকার ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক সমমর্যাদার পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাস করে এবং তা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এখন সময় হয়েছে দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা শুরু করার। আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ অনুমোদিত সনদের আলোকে আন্তর্জাতিক নদীগুলোর গতি-প্রবাহ, বাঁধ ইত্যাদি নতুন করে বিবেচনা করার। যদি ভারত সমমর্যাদার ভিত্তিতে এইসব আলোচনায় বসতে না চায় এবং একরোখা নীতি অবলম্বন করে তাহলে সরকারের উচিত হবে আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে ভারতের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে কথা বলা এবং প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ দাবী করে মামলা করা।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৬ আগস্ট ২০২৪
Posted ১২:১০ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh