কাজী জহিরুল ইসলাম : | বৃহস্পতিবার, ২২ আগস্ট ২০২৪
১২ বছরে এক যুগ হয়, ১২ দিনে কিছুই হয় না। আজ ২০ আগস্ট, নতুন অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের বয়স মাত্র ১২ দিন। এরই মধ্যে অনেকে এই সরকারের কাজের মূল্যায়ন করতে বসে গেছেন। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, মর্নিং শোজ দ্য ডে, ১২ দিনকে যদি আমরা মর্নিং ধরি তাহলে একটা মূল্যায়ন অবশ্য করা যায়। কতটা সক্ষম এই সরকার তা আন্দাজ করা যায়। সকালটা কী রৌদ্রকরোজ্জ্বল, না-কী মেঘে ঢাকা? এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলা যায়।
একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়েছে এদেশের বিপ্লবী ছাত্র-জনতা। তারা জাতিকে এই স্বপ্ন দেখিয়েছে যে, একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা হবে, যেখানে আর কোনো দিন পতিত স্বৈরাচারের মতো দানব সরকার ক্ষমতা দখল করবে না, মানুষ নিরাপদে, নিশ্চিন্তে একটি স্বাধীন মাতৃভূমিতে বসবাস করতে পারবে, রাস্তায় বুক ফুলিয়ে নিরাপদে মধ্যরাতে হাঁটতে পারবে, তার যা বলতে ইচ্ছা করে তা সে নির্দ্বিধায় বলতে পারবে, রাষ্ট্রের কাছ থেকে ঘুষ ছাড়া, প্রতিবন্ধকতা ছাড়া, সেবা পাবে।
ভোট দিতে পারবে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারবে। তো এইরকম একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে কি এই সরকার পারবে? সরকার প্রধান এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এরই মধ্যে বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কী হবে সে-বিষয়ে, বাংলাদেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখে কথা বলেছেন, তারা সমমর্যাদার বন্ধুত্বপূর্ণ বিদেশনীতির আলোকে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। এটি আশাব্যঞ্জক। স্বৈরাচারী সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা যেন রক্ষিত না হয় এই বিষয়ে তাদের শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে হবে এবং আশা করা যাচ্ছে তারা তা পারবেন।
শিক্ষা উপদেষ্টা সর্বনেশে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পাল্টে দিয়ে গৌরবজনক এবং মেধাবিকাশমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারবেন বলেই মনে হচ্ছে। সেই সঙ্গে দরকার হবে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অধিক ব্যবহারিক, তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করা। বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা, মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা, বাংলা এবং ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি করতে হবে। স্বাস্থ্য উপদেষ্টার তেমন কোনো বক্তব্য বা কর্মচাঞ্চল্য এখনও পর্যন্ত চোখে না পড়লেও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কর্মতৎপরতার কারণে এই সেক্টরে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে।
সেদিন দেখলাম স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক, আমার বন্ধু, ডাক্তার আহমেদুল কবীর ৯০ দিনের একটি টাইমলাইন ঘোষণা করেছেন, তিনি বলেছেন, কাউন্ড ডাউন শুরু হয়ে গেছে, ৯০ দিনের মধ্যেই দৃশ্যমান পরিবর্তন দেশের মানুষ দেখতে পাবে। আমি এই পরামর্শটি দিতে চাই, বেসরকারী হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় একটি গ্রহণযোগ্য নীতিমালার মধ্যে আনতে হবে, আমার বন্ধুটির নিজেরও একটি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে।
সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং চিকিৎসার ও সেবার মান এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে যাতে দেশের ক্ষমতাবান মানুষেরা, যেমন, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, সচিব সকলেই দেশে এবং সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন, যদি না বিশেষ কোনো কারণে বাইরের চিকিৎসা রিকমেন্ড করা হয়। তবে আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে পৃথিবীর যে কোনো চিকিৎসকের সমমানের চিকিৎসা বাংলাদেশে পাওয়া সম্ভব, আমাদের সেই মানের চিকিৎসক আছে, দরকার শুধু সেই মানের চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ডাক্তারদের সততা। আর একটি কাজ করতে হবে, দেশে চিকিৎসা বীমা চালু করতে হবে যাতে মানুষ হঠাৎ জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে সর্বশান্ত হয়ে না পড়েন। ছাত্রনেতারা, স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে যৌথভাবে ঘোষণা দিয়েছেন, বিপ্লবে আহতদের বিনামূল্যে পূর্ণ চিকিৎসা করা হবে। এই চিকিৎসা দিতে বাধ্য থাকবে বেসরকারি হাসপাতালগুলোও। এই প্রতিশ্রুতির যেন ব্যত্যয় না ঘটে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুরুতেই একটি ধাক্কা খেয়েছে। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত সাহেব বুঝে বা না বুঝে একবার ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলেন, তার পরও আমি তাকে পছন্দই করি। লক্ষ করে দেখেছি বিভিন্ন সময়ে নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি সত্য উচ্চারণের চেষ্টা করেছেন। জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান রয়েছে, এটিকে দেশের কল্যাণে কাজে লাগাবার এখন উপযুক্ত সময়। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছিলেন সেটিকে আক্ষরিক অর্থে না নিয়ে টেকনিক হিসেবে নেওয়া যেত।
আবার অন্যদিকে তার এই বক্তব্যের নিন্দা করে ছাত্র-জনতা তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে সরিয়ে দিয়েছেন, এই চাপটাকেও আমি ইতিবাচকভাবে দেখি। এই চাপ অব্যাহত রাখতে হবে যাতে আমাদেরই মনোনীত সরকার কোনোভাবেই ভুল না করে, বিপ্লবের উদ্দেশ্য ও আদর্শের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ একটি পদক্ষেপও গ্রহণ না করে। এখন যাকে স্বরাষ্ট্রের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তিনিও সেনাবাহিনীর লোক, আশা করছি তিনি শক্ত হাতেই এই মন্ত্রণালয়ের হাল ধরবেন। বিডিআর মিউটিনির প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তিনি, আশা করি এবার এর একটা সুষ্ঠু বিচার দেশবাসী দেখবে এবং ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তার পরিবার সুবিচার পাবে। সেদিনের হত্যাযজ্ঞে আমিও বেশ ক’জন প্রিয় বন্ধুকে হারিয়েছি, কর্ণেল এনশাদ, কর্নেল আজমসহ আমার কয়েকজন প্রিয় মানুষ সেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। স্বরাষ্ট্র খুব স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয়, এর দায়িত্বে যিনিই থাকবেন তাকে কথা বলার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ, আসিফ নজরুল, যদিও তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো পরিচয় ঘটেনি। তিনি বাংলাদেশে ২৬ লক্ষ ভারতীয় নাগরিক চাকরি করে বলে জানিয়েছেন, এখন দেশবাসী তার এই কথার সত্যতা দেখতে চায়। আইন, বিচার ও সংসদ মন্ত্রণালয়ের কাঁধে এখন সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব। সংবিধানের বাইরে গিয়ে সব কিছু আইনসম্মতভাবে করার চ্যালেঞ্জ তিনি কীভাবে মোকাবেলা করবেন তা দেখার জন্য প্রতীক্ষায় আছি আমরা সবাই। এই জটিল কাজটি সহজ করে তোলার জন্য আমি তাকে একটি মন্ত্র মাঝে মাঝেই পাঠ করতে বলবো, মন্ত্রটি হচ্ছে, “মানুষের জন্য আইন, আইনের জন্য মানুষ নয়”। আপনাদের সরকার অসাংবিধানিক সরকার নয়, কারণ এই সরকার গণমানুষের মনোনীত সরকার। গণমানুষের নির্বাচিত সরকার আসে ভোটের মাধ্যমে আর গণমানুষের মনোনীত সরকার আসে বিপ্লবের মাধ্যমে, দুটোই বৈধ। এই বৈধতা যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে গণমানুষের আকাঙ্খা নয়, সংস্কার করতে হবে সংবিধান। অর্থাৎ গণমানুষের আকাঙ্খার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রচনা করতে হবে নতুন সংবিধান। এটিই এই মুহূর্তে আসিফ নজরুলের প্রধান কাজ। সেই সঙ্গে বিপ্লবী জনতার প্রত্যাশা অনুযায়ী দানবীয় স্বৈরশাসক ও তার সকল দোসরের, দানব হয়ে উঠতে যারা সহযোগিতা করেছে সেইসব সহযোগিদের, বিচারের আওতার আনার কাজটি অব্যাহতভাবে করে যেতে হবে।
আর্থিক খাতে ধ্বস নামিয়ে দিয়েছে হাসিনার সরকার। এই খাতকে গভীর গিতিখাত থেকে টেনে তুলে আনার কাজে লেগে গেছেন অর্থ উপদেষ্টা। এই সরকারে তিনজন বরেণ্য অর্থনীতিবিদ আছেন, কাজেই তাদের কর্মদক্ষতা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাবে এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আপনারা বিজ্ঞ। বিজ্ঞদের একটা বড়ো সমস্যা হলো তারা পপুলার অ্যাকশনে যান না। আমার পরামর্শ হচ্ছে জাতির পালস বুঝে মাঝে মাঝে পপুলার কাজ কী করছেন তা জানাবেন। যেমন পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব হ্যাকিং বন্ধ করার জন্য কী করেছেন, বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা জনগণের আমানত কতটা সুরক্ষিত, এইসব বিষয়ে মাঝে মাঝে কথা বলবেন।
এবার বলি দুই তরুণ উপদেষ্টার কথা। আমি মনে করি এই সরকারের চালিকা শক্তি তোমরা দুজন। ড. ইউনূসের প্রজ্ঞা এবং তোমাদের তারুণ্য, এ-এক অসাধারণ কম্বিনেশন। গত ১২ দিনে আমি তোমাদের ফেশিয়াল এক্সপ্রেশনগুলো পড়ছিলাম। এখনও পর্যন্ত তোমরা একটিও ভুল কথা বলোনি। তোমাদের মুখভঙ্গি দেখলে মনে হয়, অনভিজ্ঞতা আড়াল করার জন্য তোমরা সব সময় মুখটা গম্ভীর করে রাখো। তোমরা যে অনভিজ্ঞ এটা জেনেই দেশবাসী তোমাদের ওই চেয়ারে বসিয়েছে। তোমাদের শক্তি হচ্ছে স্বপ্ন এবং সততা। তোমরাই এই জাতিকে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছ, রাষ্ট্র সংস্কারের পথ দেখিয়েছ। এবং আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি তোমরা তা বাস্তবায়ন করতে পারবে।
তোমরা তোমাদের স্বাভাবিক হাসিখুশি মুখটাই আমাদের দেখাও, সব সময় স্বতঃস্ফূর্ত থাকো এবং তোমাদের অনভিজ্ঞতার কথা খোলামেলা বলো। কাজ করতে করতে শেখো এবং শিখতে শিখতে জাতিকে তোমাদের শ্রেষ্ঠটা দাও। ক্ষমতা নয় তোমরা পেয়েছ জাতির গুরুদায়িত্ব, এই সত্য পুরো সরকার ব্যবস্থাকে বোঝাবার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত মানুষ তোমরা দুজন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের এই তারুণ্যকে দারুণ ভালোবাসি। শেষ করবার আগে আর একটি কথা বলি, অতি দ্রুত শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করুন, আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করুন। তাদের যথাযথ ক্ষতিপুরণ দেবার নীতিমাতা তৈরি করুন। এই খাতে টাকার অভাব হবে না, দরকার হলে দেশবাসীর কাছে আমরা স্বতঃস্ফূর্ত অনুদান চাইব।
ডালাস, টেক্সাস। ২০ আগস্ট ২০২৪
Posted ১:২৪ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২২ আগস্ট ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh