কাজী জহিরুল ইসলাম : | বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫
আজকের, ২০২৫ সালের, বিজয় দিবস খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেন তাৎপর্যপূর্ণ তা বলার আগে আমাদের খুব ভালো করে বুঝতে হবে ১৯৭১ সালে এদেশের ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিকসহ সকল মেহনতী মানুষ কেন নিজের জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। কেন এটি একটি জনযুদ্ধ হয়ে উঠেছিল।
শুধু কি পাকিস্তান থেকে ভেঙে বাংলাদেশ নামক এক টুকরো ভূখণ্ড পাওয়ার জন্য? মোটেও নয়। কে চায় একটি বড়ো বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছোট্ট একটি ঘরে বসবাস করতে, যদি না সৎ মায়ের অত্যাচারে বড়ো ঘরে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে ওঠে?
হ্যাঁ, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ অনুভব করেছিল তারা নিখিল পাকিস্তানের অধিবাসী হতে পারছে না, সৎ মায়ের সংসারে বেড়ে ওঠার যে বিড়ম্বনা, যে বৈষম্য, তারা সেই বৈষম্যের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এটি আরো নিশ্চিত হয় ১৯৭০ এর নির্বাচনে। যখন বাঙালিদের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নিখিল পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নির্বাচিত হয় কিন্তু যারা নিজেদের পাকিস্তানের মালিক ভাবত সেই পশ্চিম পাকিস্তানিরা কিছুতেই নির্বাচিত দলকে সরকার গঠন করতে দিচ্ছিল না। মূলত তখনই ভেতরে ভেতরে এদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তারা আর সৎ মায়ের সংসারে থাকবে না।
মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল দুটি আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে। প্রথমত, এদেশের মানুষ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছে; এবং দ্বিতীয়ত, সেই রাষ্ট্রে নাগরিকদের মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকবে না এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছে।
দেশ স্বাধীন হবার পর প্রথম বিজয় দিবসে, ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বরে, জনতার প্রত্যাশার পারদ এতো উঁচুতে ওঠে যায় যে তারা তাদের প্রাণের দল, মুক্তিযুদ্ধের দল, আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে। কিন্তু সেই দলের নেতারা অতি সামান্য লোভও সংবরণ করতে পারেনি, যে দুয়েকটি আসনে ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের প্রার্থীর বিজয়ের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল সেখানে ক্ষমতাসীন দল ভোট ডাকাতি করে নিজেদের প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসনে জয়লাভ করে, ৫ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী, একজন সিরাজুল আলম খানের জাসদ থেকে এবং একজন আতাউর রহমানের জাতীয় লীগ থেকে জয়লাভ করে। মওলানা ভাসানীর ন্যাপসহ আরো ১১টি দল নির্বাচনে অংশ নিয়ে কোনো আসনেই জয়লাভ করতে পারেনি। শেখ মুজিবের আসনে কাউকে নির্বাচন করতে দেয়া হয়নি যাতে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাশ করতে পারেন। যেন তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাটাই একটা বেয়াদবি, তাই আগ্রহী প্রার্থীদের ভয় দেখিয়ে বসিয়ে দেয়া হয়। বৈষম্যের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে অর্জিত স্বাধীন দেশে শুরু হয় নতুন বৈষম্য। পূর্ব পাকিস্তানের বাইশ কোটিপতি পরিবার থেকে কোটিপতি পরিবারের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। শেখ মুজিব ক্রমশ হয়ে ওঠেন এই দেশের মালিক। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড়ো যে আকাঙ্ক্ষা, গণতন্ত্র, তাকে পুরোপুরি কবর দিয়ে নিজেকে আজীবনের জন্য রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন।
চুয়াত্তর সালের দুর্ভিক্ষে যখন মানুষ একে অন্যের বমি চেটে খায়, কলাগাছ চিবিয়ে খায়, কাপড় না পেয়ে বাসন্তীরা ছেঁড়া জাল পরিধান করে তখন শেখ মুজিব বড়ো বড়ো কৈ মাছ ছাড়া ভাত খেতে পারেন না, দুই ছেলেকে বিয়ে দেন পুত্রবধুদের মাথায় সোনার তাজ পরিয়ে। তিনি আসলে কোনো ধরণের রাখঢাক করে বৈষম্য করেননি। প্রকাশ্যেই দেশবাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এদেশে দুটি শ্রেণি আছে, একটি দেশের মালিক শ্রেণি, অন্যটি দেশের প্রজা শ্রেণি। সেই মালিকদের মালিক হলেন শেখ মুজিব। সেনাবাহিনী ভেঙে তিনি তৈরি করেন নিজের একান্ত অনুগত রক্ষীবাহিনী।
পঁচাত্তরের আগষ্ট হত্যাকাণ্ড অবধারিত ছিল যদিও, তবুও এইরকম হত্যাকাণ্ড অনকাঙ্খিত। বাংলাদেশে শুরু হয় হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা বদলের এক নির্মম সংস্কৃতি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ সালে আরো একটি সামরিক ক্যু হয়, নিহত হন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। যদিও এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ প্রেসিডেন্ট জিয়া শেখ মুজিবের বন্ধ করে দেওয়া গণতন্ত্রের দরোজা সকলের জন্য খুলে দিয়েছিলেন। পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান আকাঙ্খা, বহুদলীয় গণতন্ত্র। সেই দরোজা কতটুকু তিনি খুলেছেন তা পরখ করার জন্য অন্তত একটি/দুটি সাধারণ নির্বাচনে অন্যান্য দলগুলোর অংশগ্রহণ করা উচিত ছিল।
এরপর আরো এক উর্দি পরা শাসক আসে। তিনি অগণতান্ত্রিক উপায়ে দেশ শাসন করেন আট বছর। ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হয়। বিদ্যমান সকল রাজনৈতিক দল মিলে ঠিক করে আর নয় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের খেলা, এখন থেকে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। শুরু হলো গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের যাত্রা। প্রকৃতপক্ষে যে গণতন্ত্রের জন্য এদেশের বহু মানুষ ১৯৭১ সালে প্রাণ দিয়েছে সেই গণতন্ত্রের শুভ সূচনা হয় স্বাধীনতার ২০ বছর পরে, ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই। কিন্তু বৈষম্য তখনো বিদ্যমান। পারিবারিক উত্তরাধিকারের রাজনীতি একটি বড়ো বৈষম্য হিসেবে দানা বাঁধতে থাকে। প্রধান দুটি দলের শীর্ষ পদে দুই পরিবারের বাইরে কারো যাওয়ার সব পথ রুদ্ধ হতে থাকে। শুধু তাই নয়, যে দুজন ব্যক্তি রাজতান্ত্রিক কায়দায় উত্তরাধিকারসূত্রে দল দুটির প্রধান হয়েছেন তারা যেন অলিখিতভাবে আজীবনের জন্যই এই পদে আসীন হয়েছেন।
২০০৬ সাল পর্যন্ত নানান চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে এক ধরণের গণতন্ত্র বিকশিত হলো বটে কিন্তু যখন যে দল ক্ষমতায় যায় তারাই দেশের সম্পদ লুটেপুটে খায়, অন্যদের জেল, জুলুম, অত্যাচার নিগ্রহের মধ্যে রাখে। একটি অস্বাভাবিক হলেও দেশের জন্য কল্যাণকর তত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থেকে নিজেদের এক্সিট প্লান নিশ্চিত করার জন্য একটি কৌশলী নির্বাচন করে এবং আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়। ফলে শিশু গণতন্ত্র হামাগুড়ি দিতে দিতেই হোচট খায়, উঠে আর দাঁড়াতে পারলো না। শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মত ক্ষমতাসীন হয়ে পিতার রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেন। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে মূলত তিনি স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেন।
তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা সব ভেঙে দিয়ে নিজের শাড়ির আচলে সবাইকে বেঁধে ফেলেন। তিনি এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তন করেন, এদেশের একমাত্র মালিক তিনি, তার অঙ্গুলিহেলন ছাড়া এখানে কিছুই ঘটবে না। প্রশাসনকে সীমাহীন দুর্নীতি করার সুযোগ দেন যাতে প্রশাসনের সবাই তার অনুগত থাকে। ব্যবসায়ীদের ব্যাংক লুটের সুযোগ দেন যাতে নিজেদের অপকর্মের নিরাপত্তা হিসেবে তারা তাকে ক্ষমতায় রাখে।
মুক্তিযুদ্ধের যে মূল চেতনা, মূল আকাঙ্খা তা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় শেখ হাসিনা। কিন্তু এদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একদল তরুণ জেগে উঠে। তারা প্রথমে কোটা সংস্কার, পরে নয় দফা এবং শেষে এক দফার আন্দোলন গড়ে তোলে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে। সারা দেশের মানুষ তাদের “বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন” এর ব্যানারের নিচে এসে দাঁড়ায়। তারা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের কথা বলে, তারা গণতন্ত্রের কথা বলে, দেশের ১৮ কোটি মানুষের ডিএনএ জেগে ওঠে, আজ থেকে ৫৩ বছর আগে এই দুটি দাবীকে সামনে রেখেই তো জীবন দিয়েছিল এদেশের মানুষ।
৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্ট তাদের চূড়ান্ত বিজয় হয়। গত ১৬ মাস ধরে নোবেল বিজয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার অক্লান্ত পরিশ্রম করছে মুক্তিযুদ্ধের সেই আকাঙ্ক্ষা, “গণতন্ত্র এবং বৈষম্যহীন সমাজ” বাস্তবায়নের জন্য। কিন্তু যে বৈষম্যযুক্ত, পরিবারতান্ত্রিক অবকাঠামো তৈরি হয়েছে এই দীর্ঘ সময় ধরে, যা ধারণ করে বেড়ে উঠেছে, ফুলে ফেঁপে বড়ো হয়েছে এদেশের রাজনৈতিক দলগুলো, দলের নেতারা, তারা কি খুব সহজেই তা হতে দেবে? দফায় দফায় আলোচনা, যুক্তিতর্ক দিয়েও তাদেরকে পুরোপুরি রাজী করানো যায়নি একটি টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ, একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথ নির্ধারণ করার কাজে ঐকমত্য সৃষ্টি করার জন্য। তারপরেও অসংখ্য নোট অব ডিসেন্টসহ একটি জুলাই সনদ আমরা হাতে পেয়েছি। এবং তা পেয়েছি এই তো সেদিন, ২০২৫ এর বিজয় দিবসের কিছুদিন আগে। এটি মন্দের ভালো, এই সনদ অনুযায়ীও যদি আমরা আগামীর বাংলাদেশ পরিচালনা করতে পারি তাহলেও আবার ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ, অন্তত গণতন্ত্র থেকে ছিটকে যাওয়া রাস্তায় আবার উঠে দাঁড়াতে পারবে।
তাই আমি মনে করি আজকের বিজয় দিবস খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্ব দেশবাসীকে বুঝতে হবে এবং ভবিষ্যতের শাসকেরা যেন এই সনদ থেকে একটুও বিচ্যুত না হয় সেজন্য তাদেরকে অব্যাহত চাপের মধ্যে রাখতে হবে, প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিতে হবে এর জন্য দুই দফায় এদেশের বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৫ ডিসেম্বর ২০২৫
Posted ১২:২১ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh