সেতারা কবির সেতু | বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১
মধ্যপ্রাচ্যের আরব উপদ্বীপের ছোট্ট একটি দেশ জর্দান। এটি একটি রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও ভৌগলিক অবস্থান জর্দানকে বিশ্বে বৃহৎ গুরুত্ব এনে দিয়েছে। জর্ডানের দক্ষিণে সৌদি আরব, উত্তরে সিরিয়া, উত্তর-পূর্বে ইরাক এবং পশ্চিম দিকে অবস্থিত ফিলিস্তিন ও ইসরাইল। ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিনের মতো এতগুলো ভয়াবহ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইলের সাথে সীমান্ত থাকার পরও দর্ডানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অন্যান্য দেশের মতো জটিল না। জর্দানেই রয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোর সবচেয়ে বেশি শরণার্থী শিবির। বিশ্বে জর্দানের গুরুত্ব শুধু ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকেই নয়, বরং এর সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একে পৃথিবীর বুকে অনন্য করেছে।
ইতিহাসপ্রেমী এবং রোমাঞ্চপ্রিয় পর্যটকের জন্য জর্দান এক দারুণ দেশ। কারণ জর্ডানেই রয়েছে পৃথিবীর নতুন সপ্তাশ্চর্যের একটি পেত্রা নগরী, রয়েছে মৃত সাগর আর সোনালী-লাল মরুভূমির ঐন্দ্রজালিক সৌন্দর্য। প্রাচীন ও পবিত্র ভূমিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জর্ডান রাষ্ট্রটি বিশ্ব সভ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ স্হান দখল করে আছে। বর্তমান যে আরব বিশ্ব, তার প্রতিষ্ঠার মূলে আছে দুটি রাজবংশ – সৌদ রাজবংশ এবং হাশেমী রাজবংশ। সৌদ রাজবংশ সম্পর্কে তো সবাই জানে, কিন্তু সৌদরা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হাশেমী রাজবংশ ছিল সৌদদের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান “সৌদি আরব” তো বটেই, সিরিয়া, থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত সমগ্র আরব ভূমিই হাশেমীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল।
হাশেমী রাজবংশের নামটা এসেছে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্র-পিতামহ “হাশেম”-এর নাম অনুসারে, যেহেতু তারা তার বংশধর। এই হাশেমী রাজবংশ ১৯২১ সাল থেকে জর্ডান শাসন করে আসছে। তবে বর্তমানে যে হাশেমী “রাজবংশ”, তার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ধরা হয় শেরিফ হুসেইন বিন আলিকে। তিনি হচ্ছেন বর্তমান জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহর দাদার দাদা। তিনি ছিলেন অটোমান খিলাফতের অধীনস্থ, সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত। কিন্তু অটোমানরা যখন দুর্বল হয়ে আসতে থাকে, তখন ব্রিটিশদের প্রলোভনে পড়ে তিনি সমগ্র আরব ভূমির বাদশাহ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। অটোমান শাসনামলের শেষের দিকে তরুণ তুর্কিদের বিপ্লবের পর থেকে আরবদের সাথে তুর্কিদের মধ্য দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সে সময় অটোমানদেরকে পরাজিত করার লক্ষ্যে ব্রিটিশরা আরবদেরকে জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে। তারা হুসেইনকে প্রতিশ্রুতি দেয়, অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করলে যুদ্ধ শেষে সমগ্র আরব ভূমির নিয়ন্ত্রণ আরবদের হাতে তথা হুসেইনের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
এই প্রলোভনে পা দিয়ে হুসেইন আরব বিদ্রোহের ডাক দেন। কিন্তু যুদ্ধের পর যখন ভাগ-বাটোয়ারার সময় হয়, তখন হুসেইন দেখতে পান, ব্রিটিশরা শুধু তার সাথেই গোপন চুক্তি করেনি। তারা একই সাথে ফরাসি ও ইসরায়েলের সাথেও চুক্তি করেছে। তাই, হুসেইনের পুত্র আবদুল্লাহ ট্রান্স-জর্ডানে গিয়ে স্থানীয়দের সমর্থন লাভ করেন এবং সেখানে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হয়, আব্দুল্লাহ তখন ইসরায়েলিদের সাথে গোপনে সমঝোতা করেন। তিনি জেরুজালেমসহ জর্ডান নদীর পূর্ব প্রান্তের বিশাল ভূমি নিজের অধীনে পাওয়ার বিনিময়ে বাকি অংশে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা মেনে নেন। চার বছর পর ক্ষুব্ধ এক ফিলিস্তিনি আল-আকসা মসজিদে আব্দুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করে।
আব্দুল্লাহর মৃত্যুর পর প্রথমে রাজা হন তার পুত্র, এবং হুসেইনের বাবা, তালাল। কিন্তু তিনি ছিলেন মানসিকভাবে অসুস্থ। ফলে কয়েক বছর পর, ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার দিন তাকে সরিয়ে হুসেইন বিন তালালকে ক্ষমতায় বসানো হয়। হুসেইন পরবর্তী ৪৮ বছর জর্ডানের রাজত্ব করেন। ১৯৯৯ সালে তার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় বসেন তার পুত্র আব্দুল্লাহ, জর্ডানের বর্তমান বাদশাহ।
আবদুল্লাহর ক্ষমতা গ্রহণের পর জর্ডানের অর্থনীতির উন্নয়ন হয়েছে। এসময় বিদেশি বিনিয়োগ, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব বৃদ্ধি, আকাবায় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে কৃতিত্ব দেয়া হয়। তিনি কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তৃতীয় এবং আরব দেশসমূহের জন্য প্রথম মুক্তবাণিজ্য চুক্তি। ১৯৯৯ সালের ৭ জানুয়ারি আবদুল্লাহ জর্ডানের বাদশাহ হওয়ার পর তার সৎভাই হামজা বিন হুসাইন যুবরাজ নিযুক্ত হয়েছিলেন। ২০০৪ সালের ২৮ নভেম্বর হামজাকে যুবরাজ পদ থেকে অপসারণ করা হয়। এসময় কোনো নতুন যুবরাজের নাম ঘোষণা করা হয়নি। ২০০৯ সালের ২ জুলাই আবদুল্লাহর পুত্র হুসাইন বিন আবদুল্লাহ যুবরাজ নিযুক্ত হন।
যুবরাজের পদ থেকে অপসারণ করার কারনে বাদশাহর প্রতি সুপ্ত একটি ক্ষোপ ছিল হামজা বিন হুসাইনের। এপ্রিলের শুরুতেই বাদশাহকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে জর্ডানে অভ্যুত্থান চালানো হয়। আর এই অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে সবার আঙুল ওঠে হামজা বিন হুসাইনের দিকে। সাবেক যুবরাজ হামজা বিন হুসাইনকে গৃহবন্দী করা হয় । সেই সাথে এই ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে দেশটির শীর্ষ স্হানীয় কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। তার মধ্যে সাবেক অর্থমন্ত্রীও আছে।
জর্ডানের সামরিক বাহিনী প্রিন্স হামজাহকে গৃহবন্দি করে রাখার বিষয়টি প্রথমে অস্বীকার করে । তবে সেনাবাহিনী পরে জানায়, দেশের ‘নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা’ নষ্ট করার কাজে ব্যবহার করা হতে পারে এমন পদক্ষেপ বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে হামজাহকে। অবশ্য প্রিন্স হামজাহ বিন হুসেইন ৪ এপ্রিল এক ভিডিও বার্তায় বলেন, কোনো ধরনের অন্যায় তিনি করেন নি। তার দাবি, অভ্যুত্থানের যে ষড়যন্ত্র হয়েছে তিনি কোনো ভাবেই এর অংশ ছিলেন না। তিনি আরোও বলেন, বাদশাহ আবদুল্লাহর প্রতি আনুগত্য থাকবো এবং সকল ধরনের সহযোগিতা করবো।
জর্ডানের অভ্যুত্থানের সাথে বিদেশি শক্তিও জড়িত আছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মোহাম্মদ বিন সালমানকে গোটা মধ্য প্রাচ্যের খল নায়ক হিসেবে দেখা। সালমানের এই অভ্যুত্থানের পিছনে হাত রয়েছে কারণ ইসলামের পবিত্র মসজিদ হিসেবে পরিচিত মসজিদুল আকসার সম্মানিত খাদেম হিসেবে জর্ডানের হাশেমী বংশ নিযুক্ত রয়েছে। মোহাম্মদ বিন সালমান ইসরায়েলের সাথে এক হয়ে মসজিদুল আকসার অভিভাবকত্ব হাশেমীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চায়। আবার সাবেক যুবরাজ হামজাকে গৃহবন্দী করার পর, পরই মোহাম্মদ বিন সালমান নিজেকে সমালোচনার বাহিরে রাখতে বাদশাহ আবদুল্লাহর প্রতি সমর্থন জানায়।
এবার ইসরায়েলের কথা বলি, শতাব্দীর সেরা চুক্তি নিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে জর্ডানের বাদশাহর সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা যায় সাম্প্রতিক সময়ে। এই চুক্তিতে ফিলিস্তিন কতৃপক্ষকে যেমন বাহিরে রাখা হয় তেমনি জর্ডানকেও কোন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এতে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ অসন্তুষ্ট হোন।
জর্ডানের ভ্যাকসিনের ঘাটতি ইসরায়েলের সাথে উত্তেজনার আর একটি কারন। জর্ডান ইসরায়েলের প্রতিবেশী দেশ হয়েও যখন ভ্যাকসিনের জন্য হাহাকার করছে তখন ইসরায়েল গুয়াতেমালার মতো দূরের দেশগুলোতে ভ্যাকসিন পাঠাচ্ছে। ১৯৯৪ সালে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন শান্তি চুক্তি হলে পশ্চিম তীর ও গাজা নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আর ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারনে পশ্চিম তীরের মালিকানা পরিত্যাগ করে জর্ডান। এখন ইসরায়েল পশ্চিম তীরকে তাদের অংশ করতে চাচ্ছে। আর ফিলিস্তিনকে জর্ডানের দিকে ঠেলে দিয়ে সেই দেশকে ফিলিস্তিন বানানোর প্রস্তাব দিচ্ছে। যদিও ট্রাম্পের শতাব্দীর সেরা চুক্তির সম্পূর্ণ অংশ প্রকাশ করা হয়নি। তবে এ চুক্তির অপ্রকাশিত অংশ এমনই বলে জানা গেছে। আর এই প্রস্তাব কোন ভাবেই জর্ডানের বাদশাহর পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
যেহেতু বর্তমান সময়ে সৌদি আরব, ইসরায়েলের মিত্র দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। তাই বন্ধু দেশের সাথে যুক্ত হয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত জর্ডানের বিপক্ষে অবস্থান করছে। যদিও এই অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, লেবানন, কাতার, তুরস্ক, ইরাক এবং আরব লীগ বাদশাহ আব্দুল্লাহর প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছেন। তারপরও সার্বিক পরিস্হিতি বিশ্লেষনে মনে হচ্ছে জর্ডানের সেনা অভ্যিত্থানের বিষয়টি শুধুমাত্র ক্ষমতা পরিবর্তনের প্রচেষ্ঠা নয়। এর সাথে যুক্ত আছে ইসরাইলের সীমানা বৃদ্ধি। তাই জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ এই অভ্যুত্থানকে গুরুত্বের সাথে পর্যালোচনা করছেন। এখন দেখার বিষয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ জর্ডানের ভবিষ্যত পরিনতি কি?
Posted ১১:৪৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh