কাজী জহিরুল ইসলাম : | বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪
চেয়ার থেকে মন্দ লোকটিকে তুলে দিয়ে একজন ভালো লোককে চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। এটা সংস্কার নয়। তাহলে কোনো একদিন একজন মন্দ লোক এসে সুযোগ বুঝে চেয়ারে বসে পড়বে, তখন আবার একটা দানব তৈরি হবে, আবার একটা ফ্যাসিস্ট তৈরি হবে। সংস্কার হলো চেয়ারটাকে এমনভাবে পুনর্র্নিমাণ করা যাতে মন্দ লোকেরা নতুন চেয়ারটিতে বসতেই না পারে।প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থার বদলে সংখ্যানুপাতিক ভোটের প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন ব্যবস্থা হলে কেমন হয়?
এই বিতর্ক উঠেছে। আনুপাতিক ভোটের নির্বাচন ব্যবস্থা অনুসরণ করে পৃথিবীর ৯৯টি দেশ। এটিকেই সবচেয়ে আধুনিক এবং কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মনে করা হয়। বিজ্ঞজনেরা নানান পরামর্শ দিচ্ছেন। কম্যুনিস্ট পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কিছু ইসলামিক দল, জাতীয় পার্টি এই পদ্ধতির পক্ষে। যতদূর জানি বিএনপি এই পদ্ধতির পক্ষে না। এই পদ্ধতিতে ছোটো দলগুলো বেশি লাভবান হবে, মোট গৃহীত ভোটের ৫১% ভোট না পেলে কোনো দল এককভাবে সরকার গঠন করতে পারবে না, তাই এই ব্যবস্থা বিএনপির পছন্দ না হবারই কথা।
অন্যদিকে এই মুহূর্তে প্রচলিত ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে যেতেও পারে, অনেকে মনে করছেন হয়ত ১০/১২টা আসনের বেশি পাবে না। কিন্তু সংখ্যানুপাতিক ভোটের নির্বাচন হলে ওরা যদি ১৫% ভোটও পায় তাহলে ৪৫টি আসন পেয়ে যাবে। এইসব বিবেচনা করে অনেকেই এই ব্যবস্থার বিপক্ষে। কেউ কেউ অতীতের ভোটের হিসেবও করছেন। সেই হিসেব অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়ও এসে যেতে পারে। কারণ অতীতের ভালো নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই গৃহীত ভোটের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের আশে-পাশে ভোট পেয়েছে। ২০০৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেলেও মোট ভোট পেয়েছিল ৩৯ শতাংশ এবং বিএনপি মাত্র ৩০টি আসন পেয়ে মোট ভোট পেয়েছিল ৩০.২০ শতাংশ।
যদি সেই নির্বাচনটি সংখ্যানুপাতিক ভোটের নির্বাচন হতো তাহলে আওয়ামী লীগ পেত ১৪৭টি আসন, এবং বিএনপি পেত ৯০টি আসন। এখানেই পার্থক্যটা। এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৪১.৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ২০০টি আসনে জয়লাভ করেছিল, প্রায় সমান সংখ্যক, ৪০.০২ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল মাত্র ৬২টি আসন। অথচ সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন হলে বিএনপি পেত ১২৩ টি আসন আর আওয়ামী লীগ পেত ১২০টি আসন।
অতীতে যেহেতু কোনো দলই ৫১% ভোট পায়নি তাই অনেকেই ধরে নিচ্ছেন এই পদ্ধতিতে কেউই এককভাবে জয়লাভ করে সরকার গঠন করতে পারবে না। কিন্তু তারা এটা ভাবছেন না, নতুন ব্যবস্থায় ভোটের হিসেব পাল্টেও যেতে পারে। এখন প্রার্থীরা নিজের নির্বাচনী এলাকায় নিজের জয়ের জন্য কাজ করে, তখন সারাদেশে তারা দলের জয়ের জন্য কাজ করবে। নির্বাচনের আগে অন্য দলের সঙ্গে ভোটের ঐক্য হতে পারে। নির্বাচনের পরে সরকার গঠনের ঐক্যও হতে পারে।
প্রচলিত ব্যবস্থায় নির্বাচন তো আমরা অনেক তো দেখলাম, এবার নতুন ব্যবস্থায় দেখি না কী হয়। একটা বিষয় নিশ্চিত করেই বলতে পারি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত পার্লামেন্টে একটা ইতিবাচক ভারসাম্য থাকবে, যা সরকারেও প্রতিফলিত হবে। চাইলেই হুটহাট নিজেদের সুবিধার জন্য যা খুশি আইন পাশ করে ফেলতে পারবে না কোনো দল। এই ব্যবস্থায় ফ্যাসিস্ট সরকার তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা একদনই কমে যাবে। ২০২৪-এর বিপ্লবের এটাই তো মূল লক্ষ্য, দেশে এমন একটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো ফ্যাসিস্ট তৈরি হতে না পারে।
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের কয়েকটা বড়ো সুবিধার কথা বলি। যেহেতু একক কোনো ব্যক্তি প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছে না তাই কারো কোনো নির্বাচনী এলাকা থাকছে না। ফলে নির্বাচনী এলাকায় টাকার ছড়াছড়ি বা পেশিশক্তির মহড়া বন্ধ হয়ে যাবে। ছোটো ছোটো রাজনৈতিক দলগুলো সারা দেশ থেকে যদি ১ শাতংশ ভোটও পায়, মানে প্রায় ১০ লক্ষ ভোট, তাহলে তারা সংসদে ৩টি আসন পেয়ে যাবে। এতে করে সংসদে বহুদলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে, একটি বৈচিত্রপূর্ণ বা বলা যায় সর্বদলীয় সংসদ হবে। এমনও হতে পারে তখন সব দল মিলে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনেরও সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যদি কোনো দল গঠন করতে চায়, তারাও সংসদে আসন পেয়ে যাবে। আমি মনে করি দুই প্রতিনিধির মধ্যে এলাকা ভিত্তিক মারামারি বন্ধ হওয়া, শত শত কোটি কালো টাকার ছড়াছড়ি বন্ধ হওয়া এগুলোও খুব বড়ো গুণগত পরিবর্তন।
এই পদ্ধতির একটি বড়ো অসুবিধা হলো কেউ এককভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে পারবে না, তাকে অবশ্যই কোনো না কোনো নিবন্ধিত দলে যোগ দিতে হবে এবং সেই দলের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
আসন বন্টন নিয়ে যে সমস্যাটা হতে পারে তা হলো ফ্রাকশনের হিসেবটা কীভাবে হবে। যদি এই ব্যবস্থায় আমরা যাই তাহলে এই সমস্যা সমাধান করা কোনো কঠিন কাজ নয়। এমন হতে পারে, একটি দলকে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে হলে কমপক্ষে ১ শতাংশ ভোট পেতে হবে, এর নিচে পেলে সেই ভোটগুলো বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে এবং এই সুবিধাটা সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত দল পাবে।
হিসেবটা এমন হতে পারে, ধরুন এ, বি, সি, ডি, ই পাঁচটি দল নির্বাচনে অংশ নিল। তারা যথাক্রমে ৪৫.০২, ৪০.৫৮, ৮.৪০, ৫.১০ এবং ০.৯০ শতাংশ ভোট পেল। এবার আসন বন্টন হবে ছোটো সংখ্যা থেকে। ই দল যেহেতু ১ শতাংশের কম ভোট পেয়েছে তাই কোনো আসন পাবে না। ডি দল পাবে [৩০০ঢ৫.১০%] ১৫টি আসন, সি দল পাবে [৩০০ঢ৮.৪০%] ২৫টি আসন, বি দল পাবে [৩০০ঢ৪০.৫৮%] ১২১টি আসন এবং বাকি ১৩৯টি আসন পাবে এ দল। এই হলো ৩০০ আসনের হিসেব।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই আসনগুলো দল কীভাবে বন্টন করবে? আমার প্রস্তাব, প্রতিটি দল তাদের ৩০০ জন প্রার্থীর তালিকা নির্বাচনের আগেই নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেবে। যে কয়টা আসন দল পাবে সেই আসনগুলো তালিকা থেকে যারা প্রথমে আছে তাদের মধ্যে বন্টন করা হতে পারে। অথবা ৫০% তালিকার ক্রমানুসারে বাকি ৫০% দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বন্টন করা যেতে পারে। তবে অবশ্যই দলকে সাংসদ নির্বাচন করতে হবে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তালিকা থেকেই। নতুন করে কোনো নাম যুক্ত করতে পারবে না। অথবা পুরো সিদ্ধান্তটাই দল নিতে পারে তবে অবশ্যই নির্বাচন কমিশন কর্তৃক অ্যান্ডোর্স করা তালিকার বাইরে যাওয়া যাবে না। কারণ নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই জমাকৃত তালিকার প্রার্থীদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে অ্যান্ডোর্স করেছে।
হোক না একটা নতুন কিছু। আমার তো মনে হয় ভালোই হবে। যেহেতু পৃথিবীর প্রায় ১০০ দেশ এই আনুপাতিক ভোটের নির্বাচন বা Proportional Representation [PR] পদ্ধতি অনুসরণ করে সুফল পেয়েছে, পাচ্ছে এবং এটিকেই সর্বাধুনিক ও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য গণতন্ত্র বলা হচ্ছে, নীরিক্ষার খুব একটা ঝুঁকি আমাদের নিতে হচ্ছে না।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২১ অক্টোবর ২০২৪।
Posted ১২:৫২ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh