কাজী জহিরুল ইসলাম : | শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫
পায়ের নিচে মেঘ, তার নিচে সুপ্রাচীন কায়রো। প্রিয় কথাশিল্পী নাগিব মাহফুজের প্রাণের শহর। আকাশ থেকে নীল নদ দেখা যায় না। তবে লাইভ ভিডিওতে মানচিত্রটা জুম করলে নীল দাগ দেখা যায়। এটি মিশর এবং সুদানের হার্টলাইন। এই নদীর পাড়ে ক্যাফে নাইল। ওখানে রোজ বিকেলে কফির কাপে তরুণদের সঙ্গে আড্ডা জমিয়ে তুলতেন নাগিব। তিনি আড্ডা দিতে কখনোই কোনো বন্ধুর বাড়ি যাননি। ৯৪ বছরের এক দীর্ঘ জীবন মিশরেই কাটিয়ে দেন, তিনি দেশের বাইরে যাননি বললেই চলে।
এমন কী নোবেল পুরস্কার আনতেও যাননি, মেয়েকে পাঠিয়েছেন। হজেও যাননি। মুসলমান হয়ে হজে যাননি কেন? এক ব্রিটিশ সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি ভিড় পছন্দ করি না। অন্য এক ইন্টারভিউতে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, ইচ্ছে হয় না পৃথিবীটা ঘুরে দেখার? নাগিব বলেন, আমি একটি ছোট্ট জীবন পেয়েছি৷ সেই তুলনায় আমার দেশ, মিশর একটু বেশিই বড়ো, এই জীবনে বোধ হয় আমি মিশরটাই দেখে শেষ করতে পারবো না। কত কী আছে দেখার এই সুপ্রাচীন দেশটির পাহাড়ে, সমতলে।
সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের বোয়িং ট্রিপল সেভেন যখন মিশর অতিক্রম করছিল, স্ক্রিনে ভেসে উঠছিল কায়রো, আলেক্সান্দ্রিয়া, তখন নাগিবের মুখটাই চোখের সামনে ভেসে উঠল। এই এক অদ্ভুত ঘটনা আমার মধ্যে সব সময় ঘটে। মনে হয় পৃথিবীর সব লেখকই আমার সতীর্থ, আমার বন্ধু; তার দেশ, জাত, রঙ, ধর্ম, বয়স যাই হোক না কেন, তার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়েছে কী হয়নি বিষয়টা কোনো ম্যাটারই করে না।
গতকাল ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নোবেল জয়ী কবি লুইস গ্লুক মারা গেলেন, আমার মনে হলো আমি একজন বন্ধুকে হারালাম। লুইসের ব্যাপারটা একটু বেশিই ধাক্কা দিয়েছে এজন্য যে, আমেরিকার যেসব কবিদের ইন্টারভিউ করবো বলে তালিকা তৈরি করেছিলাম লুইস সেই তালিকায় ছিল। কাজটি আর করা হলো না বলেও আমি কিছুটা হতাশ হয়েছি। আমাদের দেশের মতো এখানেও কবিদের মধ্যে বেশ ঈর্ষা আছে। আমি আমেরিকার কয়েকজন বিখ্যাত কবির ইন্টারভিউ করেছি।
তাদের সঙ্গে লুইসের কথা বলতেই তারা আমাকে নিরুৎসাহিত করেন, প্রকৃতপক্ষে ওদের এই নেতিবাচকতার জন্যই আমি এতোদিন লুইসের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করিনি। ভেবেছিলাম আরো কিছুদিন যাক। ওদের সঙ্গে যে লুইসের বিষয়ে আমার কথা হয়েছে সেটা ওরা ভুলে যাক।
নিউইয়র্ক টু রিয়াদ, লম্বা ফ্লাইট। এখনো প্রায় ৩ ঘন্টা বাকি। হাঁটতে হাঁটতে ফুড কেবিনের কাছে যাই। দেখি হট কিছু পাওয়া যায় কিনা। ফ্লাইট স্টুয়ার্ট আদনান, সৌদি যুবক, একটি হাসি দিয়ে বলে, কী সেবা করতে পারি স্যার? এর আগেও বেশ ক’বার সে আমার আসনে পানি এবং খাবার দিয়ে এসেছে, কাজেই ওর সঙ্গে বডি ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে কিছুটা বন্ধুত্ব হয়েই ছিল। আমি বলি, উষ্ণ কিছু দাও। ও ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই পাত্র, সেই বাক্স হাতড়াচ্ছে। সম্ভবত আমার কপাল মন্দ, সব পাত্রই শূন্য। আদনান জানাল, আপনার কপাল ভালো স্যার, গরম চা দিতে পারব, তবে কফি শেষ। আমি বলি, আচ্ছা আদনান প্লেনে ওঠার পরপর বেশ সুস্বাদু একটি খেজুর আর শাদা কাপে এক কাপ কফি দিয়েছিলেন। সেই কফিটা আছে? আদনান এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ে, জিভ কাটে। ওটা খুব স্পেশ্যাল সৌদি কফি। যা ছিল শুরুতেই শেষ হয়ে গেছে। বিশ্বাস করুন, কাউকেই এক কাপের বেশি দিতে পারিনি। কফিটা খুব দারুণ ছিল। অসাধারণ একটা ফ্লেবার। আচ্ছা এই কফির কি বিশেষ কোনো নাম আছে? আদনান ঠোঁট ওল্টায়। না নেই, সৌদি কফি, ব্যাস এইই তো। ঠিক আছে, তাহলে এর আরবী নামটাই বলেন। আমার আগ্রহ ওকে অবাক করে, আদনান অনাগ্রহের সঙ্গে বলে, গাওয়া সৌদি বলতে পারেন। কিছুক্ষণ আলাপের পরেই আদনান জানতে চায় আমার বাড়ি কোথায়, কোথায় থাকি এবং কী কাজ করি। বাংলাদেশ শোনার সঙ্গে সঙ্গে সে বিমান কাঁপিয়ে একটা চিৎকার দেয়। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হই, ওর এই চিৎকার আনন্দের, দুঃখের, নাকি ভীতির কিছুই বুঝতে পারি না। আদনান ইংরেজি, আরবী মিলিয়ে একগাদা কথা বলে বাংলাদেশ সম্পর্কে। ভালো করে কিছুই বুঝিনি, শুধু এইটুকু বুঝেছি বাংলাদেশের মানুষ খুব ভালো, অনেক মানুষ দেশটিতে এবং একটি দরিদ্র দেশ। ও সবচেয়ে বেশি জোর দিলো লোকসংখ্যার ওপর। আদনান বললো, এ পর্যন্ত আমি যতবার ফ্লাই করেছি সবচেয়ে বেশি পেসেঞ্জার পেয়েছি বাংলাদেশের। সব ফ্লাইটেই বাংলাদেশের মানুষ থাকে। প্রচুর মানুষ আপনাদের দেশে। আমার কর্মস্থল জাতিসংঘ শুনে ও কিছুই বুঝলো না। আমাকে বরং পরামর্শ দিলো, আপনি তো ভালো ইংরেজি জানেন, অভিজ্ঞ মানুষ, হাস্যোজ্জ্বল, কথা বলতে পছন্দ করেন, এমন মানুষ সৌদি এয়ারলাইন্সে খুব দরকার। আপনি কেন আবেদন করছেন না? আবেদন করলেই আপনার চাকরি হয়ে যাবে।
আমি বলি, আমার বর্তমান চাকরিটিও মন্দ নয়, আমি খুব হ্যাপি, সৌদি এয়ারলাইন্সে চাকরি নেবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমার এই অনাগ্রহ ওকে বেশ আহত করলো। এরপর একটা সেল্ফি তুলে ফুড কেবিন থেকে বেরিয়ে আসি।
Posted ৪:১১ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh