আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু | বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর ২০২১
মাসিমা এখন বেঁচে নেই। শেষবার দুর্গা পূজার সময় তার সাথে দেখা হলো তিনি অসুস্থ। হাসপাতাল থেকে মাত্র কিছুদিন আগেই ফিরেছেন। পরিবারের সবাই তার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। বছর দু’য়েক আগে মেশো মশাই গত হয়েছেন। জুটি ভেঙ্গে গেছে। সেই শোকেই হয়তো শয্যাগত। ডাক্তার দেখানোর পর অনেক জটিলতা খুঁজে পেলেন।
হাসপাতালে ভর্তি করা ছাড়া ঘরে চিকিৎসা সম্ভব নয়। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। তার দ্বিতীয় পুত্র আমার আবাল্য সহপাঠি ও বন্ধু এবং কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী বাদল জানতো যে ওর মায়ের সাথে আমার সম্পর্ক কেমন, আমাকে তার প্রতিদিনের অবস্থা জানাতো। ২০০২ সালে আমার মায়ের মৃত্যুর পর বাড়ি গেলে একজন মাতৃসম মহিলার সাথেই সাক্ষাৎ করতে যেতাম, পাশে বসতাম, তিনি খাবার তুলে দিতেন। মায়ের কথা মনে পড়তো এবং অনেক কষ্টে চোখের পানি ঠেকিয়ে রাখতাম। মাসিমা চলে গেলে আর কারো কাছে এটুকুও আর পাবো না। আমাকে দেখেই বিছানায় বসলেন, আমিও পাশে বসে তার শারীরিক অবস্থা জানতে চাইলে তিনি উত্তর না দিয়ে ছোট ছেলে সঞ্জীব চন্দ্র বিল্টুর স্ত্রীকে ডাকলেন আমাকে প্রসাদ দিতে। অন্যান্য বছর তিনি নিজ হাতে এ কাজটি করতেন। বিল্টুর স্ত্রী যথারীতি একটি বড় কাঁসার প্লেটে খাবার সাজিয়ে আনলে তার মনে হলো আরো কিছু আইটেম প্লেটে নেই, তিনি তাকে বললেন সেগুলোও দিতে। সে আরেকটি প্লেট সামনে এনে রাখার পর মাসিমা আদেশের সুরে বললেন, খাও।
আমি একটু একটু করে খাচ্ছি। মাসিমা আগে কখনো যে কথাগুলো বলেননি, আপন মনে বলতে শুরু করলেন। তার শৈশবের কথা যতোটুকু মনে ছিল, স্কুলে যাওয়া, বিয়ের পর শেরপুরে আসা, ছয় পুত্র ও তিন কন্যার জননী হওয়া। আমি শুনে যাচ্ছি। তিনি বললেন, অনেক কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার সময় শুয়ে থাকতে থাকতে কতকিছু ভাবতাম, কতো স্মৃতি মনে পড়তো, কতো মুখ ভেসে উঠতো, তোমার কথাও মনে পড়েছে। বাদল বা বিল্টুর কাছে তোমার কথা জানতেও চেয়েছি। আমার নিজের মধ্যে এক ধরণের অপরাধবোধ জাগলো, উনার হাসপাতালে থাকা অবস্থায় আমার অন্তত একটি দিন যাওয়া উচিত ছিল। আত্নপক্ষ সমর্থন করার জন্য শুধু বলতে পারলাম, মাসিমা, বাদলের কাছ থেকে আমি প্রতিদিন আপনার খবর নিয়েছি। মাঝে মাঝেই তিনি তাগিদ দিচ্ছেন খাবারগুলো খেতে। প্রসাদ হলেও অধিকাংশ খাবার যেহেতু আমার বয়সী লোকদের স্বাস্থ্যের পক্ষে হিতকর নয়, সেজন্য আমি মাসিমাকে দেখানোর জন্য এক আধটু নিচ্ছিলাম। বিল্টু এসে উদ্ধার করলো। মাসিমাকে বললো, মা এতোগুলো খাবার, নারকেলের নাড়ু, চিড়ার নাড়ু, এগুলো কি বড়রা খেতে পারে। তুমি জোর করো না মা, মঞ্জু ভাই যতোটুকু পারেন, খাবেন। মাসিমা আর কথা বাড়ালেন না। বললেন, বৌমাকে তো পূজায় একবারও নিয়ে এলে না। এর পরের বার পূজায় অবশ্যই আনবে। কিন্তু তার জীবনে আর কোন পূজা আসেনি। সে বছরই তিনি পরলোকে চলে গেলেন।
এরপর গত ছয়বছর ধরে আর পূজার মওসুমে শেরপুর যাওয়া হয়নি। মাসিমা নেই, অতএব আর কারো সাথে দেখা করতে যাওয়ার জন্য সে বাড়িতে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। বাদল ঢাকায়, একই কর্মস্থল। কথাবার্তা ওর সাথেই হয়। জীবন কিভাবে সংকুচিত, সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। যতোদিন শেরপুরে শিক্ষাজীবন কাটিয়েছি, হিন্দু বন্ধুদের নিমন্ত্রণ পাওয়ার অপেক্ষা করতাম না। লগ্ন বুঝে হাজির হয়ে যেতাম। তখন প্রসাদ লাভ একটি বড় ব্যাপার ছিল। নয়ানী বাড়িতে তিনটি পূজা হতো, সেখানে প্রতিমা দর্শনের পাশাপাশি যেতাম মহিষ বলি দেখতে। মহিষের গলা কড়িকাঠে আটকে বিশাল খাড়ার এক কোপে ধড় থেকে মস্তক ছিন্ন করে ফেলা ভীতিকর হলেও উপভোগ্য ছিল॥ কাজটা যে করলো তার শক্তি ও কৌশলের প্রশংসা করতো দর্শকরা। সন্ধ্যায় দলবেঁধে মন্ডপে মন্ডপে আরতি দেখতে যেতাম। বিসর্জনের দিন প্রতিটি মন্ডপের প্রতিমা ট্রাকে তুলে শহর প্রদক্ষিণ করার পর সন্ধ্যায় সবাই আড়াই আনী জমিদার বাড়ির বিশাল পুকুরে বিসর্জন পর্বটি ছিল সবচেয়ে উপভোগ্য। পুকুরের চারপাশ জুড়ে হাজার হাজার লোকের ভিড় আর ভিড় ঠেলে প্রতিমাগুলোকে তোলা হতো অনেকগুলো ড্রাম বেঁধে তৈরি বিশেষ ভেলায়। দীর্ঘক্ষণ ধরে প্রতিমাগুলোকে ভেলায় ঘুরানোর পাশাপাশি ঢাকের গগণবিদারী আওয়াজে কান স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি হতো। আমরা শেষ প্রতিমাটি বিসর্জন দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম। তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে যেত।
দুর্গা পূজা সম্পর্কে দশ বছর বয়স পর্যন্ত আমার কোন ধারণাই ছিল না। কারণ তখন আমি আমাদের গ্রামের বাড়িতে থাকতাম এবং আমাদের গ্রামে কোন হিন্দু ছিল না বলে মূর্তি সম্পর্কেও ধারণা ছিল না। আমার দাদার সাথে মাইল তিনেক দূরে একটি বাজারে যাওয়ার পথে সর্বপ্রথম একটি মন্দিরে কয়েকটি মূর্তি দেখলেও সে সম্পর্কে স্বচ্ছ কোন ধারণা হয়নি। আমাদের পড়াশুনার সুবিধার্থে আব্বা ১৯৬২ সালে আমার বড় ভাই ও আমাকে শেরপুরের গোবিন্দ কুমার ইন্সটিটিউটে ভর্তি করে দেন। আমার বড় ভাই ক্লাস সিক্সে আর আমি ক্লাস ফোরে। প্রথম দিন প্রথম ক্লাসে যে স্যার নাম ডাকলেন, তাতে বুঝলাম সহাঠিদের অধিকাংশই হিন্দু। কিছুদিন বড় মামার বাসায় থেকে ক্লাস করার পর আব্বা একটা বাসা ভাড়া নিলে আম্মা চলে আসেন।
অল্পদিনের মধ্যেই আব্বা একটি জায়গা কিনে বাড়ি তৈরি করলে আমরা নিজ বাড়িতে বসবাস শুরু করি। তখনকার শেরপুর ছিল হিন্দু প্রধান এবং আমরা যে মহল্লায় এলাম সেখানে বাড়িগুলো বেশ দূরে দূরে, অনেকটা নিভৃত পল্লীর মতোই এবং সবক’টিই হিন্দু বাড়ি। আমরা বরং সৌভাগ্যবান ছিলাম যে আমাদের বাড়ি থেকে আমাদের পড়শি হিন্দু বাড়িটির দূরত্ব ছিল সবচেয়ে কম এবং প্রায় পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানেও আমাদের দুই বাড়ির মাঝখানে আর কোন বাড়ি নির্মিত হয়নি, বরং আমাদের সম্পর্কের ব্যবধান কমেছে । এখন ওদের ছাড়া আমাদের চলে না, আবার আমাদের ছাড়া ওদের চলে না। বিশাল এলাকা জুড়ে তাদের বাড়ি, এক জমিদারের অধস্তন পরিবার। পড়শি বাড়ি থেকে প্রতিদিন শাঁখের আওয়াজ আসতো, ঘন্টা ও উলুধ্বনি শুনতাম। লক্ষ্মী পূজা বা কালি পূজা হলে তাদের বাড়ি থেকে খাবার পাঠাতো। এভাবেই হিন্দুদের সাথে, বিভিন্ন পূজা ও দেবদেবীর সাথে পরিচয় ঘটতে শুরু করে।
ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল এবং বই ধার নিতে হতো হিন্দু বন্ধুদের কাছ থেকেই। কারণ মুসলিম সহপাঠিদের অধিকাংশই গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান। পাঠ্য বই অনেক সময় তাদের কেনা হয়ে উঠতো না। যে বইগুলো ধার নিতাম সেগুলো অধিকাংশই ধর্মীয় কাহিনীভিত্তিক। ফলে দেবদেবী সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা শৈশব থেকেই লাভ করি, যা পরবর্তী সময়ে এবং এখনো কাজে লাগছে। দেবদেবীরা আমার মাঝে জানার যে কৌতুহল সৃষ্টি করেছিলেন, তার ফলেই পরবর্তী সময়ে আমাকে আরো জানার জন্য গীতা, রামায়ণ ও মহাভারত পাঠ করতে হয়। হিন্দুদের এই পবিত্র গ্রন্থগুলো আমার সংগ্রহে রয়েছে এবং যখন প্রয়োজন পড়ে তখন আমি পাঠ করি। ক’জন নিষ্ঠাবান হিন্দু পাওয়া যাবে, যারা গায়ত্রী মন্ত্র মুখস্থ করেছেন? আমার প্রয়োজন নেই, কিন্তু সীমাহীন আগ্রহের কারণে আমি তা অর্থসহ মুখস্থ করেছি।
আমার সিনিয়র সহকর্মী স্বপন কুমার সাহা ছিলেন কিছুদিন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ছিলেন। ধর্মীয় ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করলে তিনি বিনয়ের সাথে স্বীকার করতেন যে এসব ব্যাপারে তার তেমন ধারণা নেই। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে আমি এখানে গায়ত্রী মন্ত্রটি উল্লেখ করতে চাই:
“ঔম ভোর ভুওয়া সোয়াহা, তাতসাভিতুর ভারানিয়াম
ভারগো দেবছায়া ধিমাহি, ধিওইয়ো না প্রাচোদায়াত।”
অর্থ্যাৎ “হে পৃথিবী ও স্বর্গের ইশ্বর, আমরা তোমার শ্রেষ্ঠত্বের ধ্যান করি। তোমার সর্বব্যাপী ক্ষমতা দিয়ে আমাদেরকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করো। আমাদের পাপকে ধ্বংস করে আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করো।”
গীতার মর্মবাণী হচ্ছে, ‘নিস্কাম কর্ম’ অর্থ্যাৎ পুরস্কারের আশা না করে কর্তব্য পালন করে যাও । যখন জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছো তখন তুমি জয়ী হবে কি পরাজিত হবে, এতে তুমি আনন্দ পাবে না দুঃখ পাবে, তা ভেবে লাভ নেই। ইশ্বর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে পৃথিবীতে আবার অবতীর্ণ হয়ে পাপ ও মন্দ থেকে তিনি পৃথিবীকে মুক্ত করবেন। গীতায় অহিংসার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, যার অর্থ কাউকে আঘাত না করা।
আমি স্কুলের উপরের ক্লাসে পড়ার সময় ইম্মাউস বাইবেল স্টাডিসের ছাত্র ছিলাম এবং খ্রিস্টানদের নিউ টেস্টামেন্ট ও তাদের সেন্টদের সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ার সুযোগ হয়েছে। অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কেও অল্পবিস্তর পাঠ করেছি এবং এখনো করি। সত্য একটাই এবং সত্যের অনুসন্ধান করলে সেটাই সকলের জন্য কল্যাণকর। আমি বিভিন্ন ধর্মে যে পার্থক্য তা একেবারেই একটা সাংস্কৃতিক পার্থক্য বলে মনে করি এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্যো কারণে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সাংঘর্ষিক কিছু হতে পারে না। বিভেদ সৃষ্টির জন্য এক শ্রেণীর লোক থাকে, যারা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে।
Posted ৩:৩৪ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh