মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ | ৫ চৈত্র ১৪৩০

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

মৃত্যুর মিছিলে আমার সহপাঠিরা

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু   |   বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই ২০২১

মৃত্যুর মিছিলে আমার সহপাঠিরা

গত আড়াই বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে আমার সাত জন সহপাঠি এবং দু’জন সহপাঠির স্ত্রী পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। সহপাঠিদের মধ্যে দুইজন করোনো ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে, চার জন হৃদরোগে এবং একজন দীর্ঘদিন নানা শারীরিক জটিলতায় অসুস্থ হয়ে ইন্তেকাল করেছেন। তারা ছিলেন: এডভোকেট আশরাফ হোসেন (ফেব্রয়ারি ২০১৯), আনোয়ার হোসেন (২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯), মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ (আগস্ট ২০১৯), মুহাম্মদ আবু তাহের (মে ২০২০), মোসলেহউদ্দিন চৌধুরী বেলাল (ডিসেম্বর ২০২০), জিএম আলী হোসেন (ফেব্রুয়ারি ২০২১) ও এসএমএইচ বুখারি (১ জুলাই ২০২১)। এছাড়া সহপাঠি মোসলেহউদ্দিন ঢালীর স্ত্রী কাওকাব রেজা ঢালী (ফেব্রুয়ারি ২০২১) ও সহপাঠি ও প্রিয় সহকর্মী শাহজাহান সরদারের স্ত্রী হাসিনা সরদার (এপ্রিল ২০২১) ইন্তেকাল করেছেন। আমি তাদের সকলের রুহের মাগফিরাত ও পরকালীন শান্তি কামনা করি।


আমাদের বয়স্ক প্রিয়জনের মৃত্যু হলেই আমরা ভাবি, কীভাবে আমরা প্রতিদিন মৃত্যুর নিকটবর্তী হচ্ছি। তবুও আর ক’টা দিন পৃথিবীতে থাকার ইচ্ছা পোষণ করি। মৃত্যুকে বিলম্বিত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি। অ্যাপল কম্পিউটারের জনক খ্যাত স্টিভ জবস (ঝঃবাব ঔড়নং ১৯৫৫-২০১১) ২০০৫ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তাঁর অগ্নাশয়ের ক্যান্সার ও মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার কথা বলেন: “কেউ মরতে চায় না। এমনকি যেসব লোক স্বর্গে যেতে চান, তারাও সেখানে যাওয়ার জন্য মরতে চান না। তা সত্ত্বেও মৃত্যুই আমাদের অনিবার্য গন্তব্য। আজ পর্যন্ত মৃত্যু থেকে কারও পক্ষে নিস্কৃতি পাওয়া সম্ভব হয়নি। এবং মৃত্যুর যেমন হওয়া উচিত, মৃত্যু তাই; কারণ মৃত্যুই সম্ভবত একক সেরা উদ্ভাবন। মৃত্যু নতুনদের পথ করে দেওয়ার জন্য পুরনোদের বিদায় করে। ঠিক এ মুহূর্তে তোমরা নতুন, কিন্তু একদিন, যা এখন থেকে খুব দূরে নয়, তোমরাও ক্রমশ বৃদ্ধ হবে এবং তোমাদের অপসারণ করা হবে। কথাটি নাটকীয়ভাবে বলার জন্য আমি দু:খিত, কিন্তু এটিই চরম সত্য।”


ব্রিটিশ গণিতবিদ ও দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল পৃথিবীতে মানব অস্তিত্বকে বহতা নদীর সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন: “মৃত্যু ভীতি জয় করার সর্বেত্তম উপায় হচ্ছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমার অহঙ্কারের প্রাচীর অপসারিত না হয় এবং তোমার জীবন ক্রমবর্ধমানভাবে সার্বজনীন জীবনের সঙ্গে একীভূত না হয়, ততক্ষণ মানুষকে তাদের আগ্রহের দিকগুলোকে ক্রমশ বিস্তৃত করা এবং নিজেকে অধিক নৈর্বক্তিক করে তুলতে হবে। কোনো একক ব্যক্তির অস্তিত্ব একটি নদীর মত; প্রথমে ছোট আকৃতির, কোনোমতে তীর পর্যন্ত পানি ধারণ করে এবং প্রবল হয়ে শিলাখন্ড ডিঙিয়ে জলপ্রপাতের ওপর দিয়ে ধেয়ে অগ্রসর হয়। ক্রমশ নদী প্রশস্ত আকার ধারণ করে, নদী তীর দূরে চলে যায়, স্রোত শান্তভাব ধারণ করে এবং শেষ পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো বিরতি ছাড়াই সাগরে মিলিত হয় এবং বেদনাহীনভাবেই তাদের একক সত্তাকে বিসর্জন দেয়। কোনো ব্যক্তি যদি বার্ধক্যে উপনীত হয়ে তার জীবনকে এভাবে দেখেন, তাহলে তিনি মৃত্যু ভয়ে কাতর হবেন না, কারণ যেসব বিষয় তার প্রিয় সেসব অব্যাহত থাকবে। ক্ষয়িষ্ণু জীবনী শক্তির সঙ্গে ক্লান্তি, অবসন্নতা বৃদ্ধি পায়, তাহলে বিশ্রাম গ্রহণের ভাবনা অনাকাঙ্খিত বিবেচিত হবে না। কাজে থাকা অবস্থায় আমার মৃত্যুও ইচ্ছা পোষণ করা উচিত এবং একথা জেনে যে আমি যা আর করতে সক্ষম হবো না, অন্যেরা তা অব্যাহত রাখবে এবং এই ভাবনায় আমার সন্তুষ্ট হওয়া উচিত যে, যা কিছু আমার পক্ষে সম্ভব ছিল করা হয়েছে।”


যদিও মৃত্যু নিয়ে আমি প্রায়ই রসিকতা করি এবং জন্মের মতই মৃত্যুকে স্বাভাবিক ও এক ধরনের লুকোচুরি খেলা হিসেবে নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করি, তবুও প্রিয় মানুষের চিরতরে হারিয়ে যাওয়া আমাকে বিষাদগ্রস্থ করে। মৃত্যুর এই বিষাদ ও উদ্বেগ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলেই মৃত্যু বা মৃত্যুর পর কী ঘটবে বা ঘটতে পারে তা নিয়ে কাউকে অহেতুক বিচলিত বোধ করতে হবে না।

একবার মাদার তেরেসা দীর্ঘ বিমানযাত্রা শেষে যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর এয়ারপোর্টে পৌঁছে তাঁর আমন্ত্রণকারীদের বলেন তাঁকে সিটির দরিদ্রতম বাসিন্দাদের কাছে নিয়ে যেতে, যাতে তিনি তাদেরকে ইশ্বরের ভালোবাসার স্পর্শ দিতে পারেন। তাঁর আমন্ত্রণকারীরা আপত্তি জানান:
“কাজটি সঠিক হবে না। আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন। তা না হলে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন।”


মাদার তেরেসো উত্তর দেন, “তাতে কী?”
“তাছাড়া এলাকাটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। আমরা আপনার নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারি না।”
“তাতে কী?” তিনি একই উত্তর দেন।
“প্রিয়তমা মা, আপনি যদি এখন সেখানে যান, আপনার মৃত্যু হতে পারে।”
মাদার তেরেসা এক মুহূর্ত ভেবে বলেন, “তাতে কী?”
নিজের মৃত্যু নিয়ে উদ্বেগমুক্ত হয়ে মাদার তেরেসা তাঁর অন্তর থেকে যা করা উচিত বলে অনুভব করতেন, তিনি তাই করতেন, — দরিদ্র মানুষের সেবা Ñ ইশ্বরের কাছে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ। মৃত্যু নিয়ে উদ্বেগ যখন আমাদের হৃদয়কে পীড়িত করবে না তখন আমরা আমরা জীবিত থাকার সময়গুলোতে স্বচ্ছন্দে, নিরুদ্বিগ্ন হয়ে কাজ করতে পারি। তাছাড়া আমরা যারা আনন্দময় পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস করি, মৃত্যু হলো সেই জীবনে প্রবেশ করা উপায়। আর যারা পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস করেন না, মৃত্যু তাদের জন্য অনন্ত নিদ্রা, চেতনার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্নতা। অপরদিকে পরলোকের অস্তিত্বে বিশ্বাস না করে কেউ মারা গেলে, তার বিশ্বাস অনুযায়ীই তার পক্ষে যেহেতু মৃত্যু পরবর্তী অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ নেই, অতএব মৃত্যুতে তার ভীত হওয়ার কী আছে।

কুয়েতি লেখক আবদুল্লাহ যারাল্লাহ এক নিবন্ধে মানুষের মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন এভাবে:
“মৃত্যুর পর আমাকে প্রথমেই যা হারাতে হবে, তা আমার নাম। কারণ আমি মৃত্যুবরণ করলে লোকজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলবে, ‘লাশ কোথায়?’ কেউ আমাকে আর নাম ধরে সম্বোধন করবে না। যখন তারা আমার জানাযার নামাজের প্রস্তুতি নেবে, তখন বলবে, ‘জানাযাহ’ নিয়ে আসো।’ তারা আমাকে নাম ধরে সম্বোধন করবে নাৃ! যখন তারা দাফন শুরু করবে তখন বলবে, ‘লাশ এখানে নিয়ে এসো’, তারা আমার নাম ধরে ডাকবে নাৃ! এ জন্যই পৃথিবীতে আমার বংশ পরিচয়, আমার গোত্র পরিচয়, আমার পদমযার্দা এবং আমার খ্যাতি কোনকিছুই যাতে আমাকে ধোঁকার মধ্যে না ফেলে। ———- যারা তোমাকে জানতো, মৃত্যুর পর তারা তোমাকে হতভাগ্য বলবে; তোমার বন্ধুরা তোমার জন্য কয়েক ঘন্টা, বড়জোর কয়েক দিন দু:খ করবে, এবং এরপর তারা আগের মত গল্পগুজব বা হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠবে; আর যারা গভীরভাবে দু:খিত হবে, তারা তোমার পরিবারের মানুষ, তারা এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ, একমাস, দুইমাস কিংবা বড় জোর একবছর দু:খ করবে। এরপর, তারা তোমাকে যত্ন করে তাদের স্মৃতিতে রেখে দেবে। মানুষের মাঝে তোমাকে নিয়ে গল্প শেষ হয়ে যাবে। অত:পর, তোমার জীবনের নতুন গল্প শুরু হবে, আর, তা হবে পরকালের জীবনের বাস্তবতা।”

advertisement

Posted ১১:২৮ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই ২০২১

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আমরা মরি কেন?
আমরা মরি কেন?

(631 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.