আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু | বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন ২০২১
১৯৮৯ সালের মে মাসে তোলা ছবিতে ক্যালিফোর্নিয়ার মেনলো পার্কে “সানসেট ম্যাগাজিন” অফিসের লনে রয়টার্স ফাউন্ডেশনের ডাইরেক্টর ডেভিড চিপ (David Chipp) এর সঙ্গে আমি ও নাইজিরিয়ার সাংবাদিক তুনজি লার্ডনার (Tunji Lardner)। শিরোনামের কথাগুলো ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও পিএ মিডিয়ার সাবেক প্রধান সম্পাদক পরলোকগত ডেভিড চিফ এর। আমার পরিচিত এবং জীবনের কোনো পর্যায়ে ঘনিষ্ট কয়েকজন ব্রিটিশ সাংবাদিকের মধ্যে সেরা ছিলেন বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সাবেক সম্পাদক ডেভিড চিপ। আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ১৯৮৮ সালে। তখন তিনি সক্রিয় সাংবাদিকতা থেকে অবসর নিয়েছিলেন এবং ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত রয়টার্স এর আর্থিক অনুদানে পরিচালিত নন-প্রফিট সংস্থা রয়টার্স ফাউন্ডেশনের পরিচালকের দায়িত্বে বহাল করা হয়েছিল। রয়টার্স ফাউন্ডেশনের কাজ ছিল বিশ্বের সেরা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য সাংবাদিকদের ফেলোশিপ প্রদান, বিভিন্ন দেশে প্রশিক্ষণ ওয়ার্কশপ, সেমিনার সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা। বাংলাদেশ থেকে আমিই প্রথম রয়টার্স ফাউন্ডেশনের ফোলোশিপ লাভ করি ১৯৮৮ সালে। ফেলোশিপের আওতায় আমাকে ১৯৮৮-৮৯ মেয়াদে পড়াশোনার জন্য আসতে হয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ায় উত্তরাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সেরা উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে।
১৯৮৯ সালের সামারে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পরবর্তী মেয়াদের জন্য ফোলো বাছাই করার জন্য বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় স্ট্যানফোর্ডে। রয়টার্স ফাউন্ডেশনের বোর্ড অফ ট্রাস্টির সদস্যরা আসেন। ডেভিড চিপও আসেন। আরেক খ্যাতনামা সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েলও এসেছিলেন লন্ডন থেকে, যার সম্পর্কে এর আগে লিখেছি। ট্রাস্টি বোর্ডের আনুষ্ঠানিক সভাগুলো ছাড়া তাদের বাদবাকি অনুষ্ঠান এবং লাঞ্চ ও ডিনারে রয়টার্সের ফেলো হিসেবে নাইজিরিয়ার তুনজি ও আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হতো। তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্রাভেল, কুকিং ও গার্ডেনিং বিষয়ক ম্যাগাজিন “সানসেট” অফিস পরিদর্শন আমার অভিজ্ঞতার ঝুড়িকে সমৃদ্ধ করেছে। ‘সানসেট ম্যাগাজিন’ উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার ঘরোয়া নাম।
ম্যাগাজিনটির প্রকাশনা শুরু হয়েছিল ১৮৯৮ সালে। আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের বেশ ক’টি স্থানে এটির অফিস ছিল। স্যান ফ্রান্সিসকো থেকে মেনলো পার্কে সাত একর জমির উপর অফিস স্থাপন করা হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। একতলা-বিশিষ্ট অফিস ভবন ছাড়াও ম্যাগাজিনের কুকিং সেকশনের ব্যবহারের জন্য একটি সবজি বাগান ছাড়াও, ফুল ও উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার বৈশিষ্টমন্ডিত সকল গাছের অপূর্ব সমাহার সেখানে। সকলের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু ৫০ বছর পর ২০১৫ সালে ‘সানসেট ম্যাগাজিন অফিস মেনলো পার্ক থেকে ওকল্যান্ডে স্থানান্তর করা হয়েছে।
সানসেট ম্যাগাজিন অফিসে ম্যাগাজিনের সম্পাদকমন্ডলীর সঙ্গে বৈঠকের পর লনে লাঞ্চের সময় ডেভিড চিফ তার সাংবাদিকতা জীবন সম্পর্কে অনেক কথা বলেন। ১৯৫৩ সালে বগুড়ার মোহাম্মদ আলী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তখন প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে বগুড়াও গিয়েছিলেন। ঢাকায় তার আরও কয়েকজন বন্ধুর কথা বলেছিলেন। তাঁর পরিচিত Dacca’র বানান বদলে Dhaka’ করায় তিনি তার কষ্ট পাওয়ার কথাও বলেন। তাঁর নেয়া চীনের কারারুদ্ধ শেষ সম্রাট পু ই’র (Pu Yi) এবং কমিউনিস্ট নেতা মাও জে দং এর সাক্ষাৎকার রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর সম্রাট পু ই রাজধানী থেকে পালানোর সময় সোভিয়ে বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং ১৯৪৯ সালে প্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাকে চীনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পু ই টোকিও ট্রায়ালে একজন অভিযুক্ত ছিলেন এবং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাকে দশ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে যে মাও জে দং এর হস্তক্ষেপে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়নি, কারণ মাও তাকে “নিহত সম্রাট” এর চেয়ে বরং সংস্কারে সংশোধিত সাধারণ মানুষ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি মারা যান।
১৯৫৬ সালে তাঁকে রয়টার্সের বেইজিং ব্যুরোর দায়িত্ব প্রদান করা হয় এবং কমিউনিস্ট চীনের তিনিই প্রথম নন-কমিউনিস্ট সাংবাদিক ছিলেন। মাও জে দং এর সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল। এক ভোজসভায় কথা বলার সময় বেখেয়ালে তাঁর পায়ের নিচে পড়েছিল মাও এর পা। তিনি চীনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ তাঁর বইয়ের নাম দিয়েছেন, “দ্য ডে আই স্টেপড অন মাও’র টোস (The Day I Stepped on Mao’s Toes’). চীনা সাংবাদিকরাও তাঁকে রসিকতা করে বলতেন, ‘The Englishman who stepped on Chairman Mao’s toes and lived to tell the tale’ (ইনি সেই ইংলিশম্যান, যিনি মাও এর পা মাড়িয়ে দিয়ে সে কাহিনি বলার জন্য বেঁচে আছেন) । ডেভিড চিপ ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে ৮১ বছর বয়সে মারা যান। তিনি কখনো বিয়ে করেননি।
সাংবাদিকতা শুরুর আগে ডেভিড চিপ একটি বাণিজ্যিক জাহাজে কাজ করেন এবং ১৯৪৪ সালে ১৭ বছর বয়সে মিডলসেক্স রেজিমেন্টে হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের পর তাঁর রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হলে তিনি ১৯৪৭ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ইতিহাসে ডিগ্রি নেন। ১৯৫০ সালে তিনি রয়টার্সের স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন এবং দুই বছর পর তাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাঠানো হয়। তিনি ইয়াঙ্গনে যুদ্ধ পরবর্তী রয়টার্স ব্যুরো চালু করেন এবং চীনে যাওয়ার আগে বার্মা ও ইন্দো-চীনের যুদ্ধ কভার করেন। বেইজিং থেকে লল্ডনে ফেরার পর ১৯৬৮ সালে তাঁকে রয়টার্সে প্রধান সম্পাদক নিয়োগ করা হলে তিনি মাত্র এক বছর এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে তাকে ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা “প্রেস এসোসিয়েশনের (পিএ) প্রধান সম্পাদকের পদ অফার করা হলে তিনি সেখানে যোগ দেন। এই বার্তা সংস্থার বর্তমান নাম “পিএ মিডিয়া।” ১৫৩ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত প্রেস এসোসিয়েশনের অত্যন্ত বিপন্ন অবস্থায় হাল ধরে ডেভিড চিফ প্রতিষ্ঠানটির আধুনিকীকরণ এবং কাজের ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে এটিকে লাভজনক সংবাদ সংস্থায় পরিণত করেন। ১৯৮৬ সালে সাংবাদিকতা থেকে অবসর নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। প্রেস এসোসিয়েশনে যোগ দেয়ার পর তার প্রথম এডিটোরিয়াল কনফারেন্সে যে কথাটি বলেছিলেন তা এখনো সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি জনপ্রিয় বক্তব্য হিসেবে রয়ে গেছে। তাঁর কথাটি ছিল, “Journalism should be fun and if we don’t find it so, we might as well be bank clerks.” (সাংবাদিকতা উপভোগ্য হওয়া উচিত। আমরা এ পেশায় যদি আনন্দ না পাই, তাহলে আমরা ব্যাংকের কেরানি হতে পারি)।
Posted ১১:৪২ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh