শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

শতবর্ষের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ৭৪টি নরবলি

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু   |   শনিবার, ১১ জুলাই ২০২০

শতবর্ষের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ৭৪টি নরবলি

গত ১ জুলাই মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ১০০ বছরে পড়েছে। এ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তণ ছাত্ররা শতবর্ষ উল্লেখসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের লগো ও নিজের ছবিসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের স্মৃতিচারণসহ নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করছেন। উচ্ছাস প্রকাশ করছেন। পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে অন্যান্যের মতো আমিও গর্বিত। আমার দু:খবোধও প্রচণ্ড। আমার পড়াশোনার জন্য ভর্তুকি দিয়েছে জনগণ, তাদের প্রতি আমার দায় পরিশোধ করতে না পারার দু:খ। আমাদের নিজেদের খরচ কত ছিল? যৎসামান্য। মাসিক বেতন ১০ (দশ) টাকা, হলে সিট ভাড়া ৫ (পাঁচ) টাকা প্রতিবেলা খাওয়ার জন্য দুই টাকা। এর বাইরে সামান্য কিছু পরীক্ষা ফি দিতে হয়েছে সাবসিডিয়ারী, অনার্স ও মাষ্টার্স পরীক্ষার আগে। তাই দিতে আমার অভিভাবক গলদঘর্ম। আমি তো তাদের একা নই। আরো ভাইবোন আছে আমার। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আমাকে পড়াশোনা করাতে দেশবাসী প্রতি বছর ভর্তুকি দিয়েছে প্রায় বারো হাজার টাকা (১৯৭৯ সালের হিসাব) । আমার জন্য আমার অথবা আমার অভিভাবকের বার্ষিক খরচ ছিল আড়াই হাজার টাকা। ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র তার ব্যক্তিগত খরচ অর্থ্যাৎ বেতন, সিট ভাড়া থাকা-খাওয়াসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় করেছে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা, সেক্ষেত্রে সরকার বা জনগণ তার পেছনে বার্ষিক ভর্তুকি দিয়েছে এক লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৮ টাকা। সন্দেহ নেই গত তিন বছরে ভর্তুকির পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স যখন ৪৬ বছর তখন থেকে এই মহান বিদ্যাপীঠের সাথে আমার ঘনিষ্ট পরিচয়। ওই সময় আমার বয়স মোটে ১৪ বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ৫৩ বছর তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে অবস্থান করে আমি এইচএসসি পরীক্ষা দেই। কারণ ঢাকায় পরিচিত বলতে ওই হলে আমার এক জ্ঞাতি ভাই থাকতেন। এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে একই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কম খরচে পড়াশোনা করতে পারার সুবিধাপ্রাপ্ত সামান্য কিছুসংখ্যক ছাত্রের একজন। আমার ছাত্রত্বের মেয়াদে (১৯৭৪-৮০ যদিও সেশন শুরুর কথা ছিল ১৯৭৩ সালে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত হাজার। সাড়ে সাত হাজারের একজন হয়েও কেন আমার দু:খ? শূচিতা অর্জন, পাপমোচন এবং ইশ্বর বা দেবদেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য বলিদান বা কোরবানি দেওয়ার যে রীতি বিভিন্ন আদিম ও ধর্মীয় সমাজে প্রচলিত রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই রীতি পালন করা হচ্ছে ‘নরবলি’ দেওয়ার মধ্য দিয়ে। একশ’ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত ছাত্র সংখ্যা ৭৪ (কোনো কোনো সূত্রে ৭৯ জন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতরা এ সংখ্যার বাইরে)। রেকর্ড হিসেবে সংখ্যাটি উল্লেখযোগ্য। এ হত্যাকাণ্ডে সূচনা ঘটেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ২২ বছর পর ১৯৪৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারী। নাজির আহমদ ও মোতাহার হোসেন নামে দু’জন ছাত্রকে হত্যা করা হয় ক্যাম্পাসে।


হিন্দু দাঙ্গাকারীদের হাতে তারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলে দুটি ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটে। একটি ১৯৬৮ সালে (সাইদুর রহমান পাঁচপাত্তুর), অপরটি ১৯৬৯ সালে (আবদুল মালেক)। এর পরের ঘটনাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল ভোররাতে মোহসীন হলের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ জন ছাত্রকে হত্যা করা হয় তাদেরকে ঘুম থেকে উঠিয়ে এনে। নিহতরা ওই সময়ের ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতা এবং ঘাতরাও একই ছাত্র সংগঠনের নেতা ছিলেন। ঘটনাটি যখন ঘটে তখন আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। আগেই উল্লেখ করেছি পরীক্ষা চলাকালে আমি এসএম হলে অবস্থান করছিলাম, মোহসীন হল থেকে জহুরুল হক হলের ভেতর দিয়ে ৫/৭ মিনিটের দূরত্বে। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং যতোদূর মনে পড়ে বিকেল তিনটার মধ্যে হল খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ক্যাম্পাসে এতোটাই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল যে দুপুরের আগেই হলগুলো প্রায় ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। তখনো আমার তিনটি পরীক্ষা বাকি ছিল। কোথায় থেকে পরীক্ষা দেই? দু:শ্চিন্তায় পড়ে যাই। সুজা ভাইয়ের কথা মনে পড়লো, বাড্ডায় এক বাড়িতে লজিং থাকেন। একদিন দেখা হয়েছিল, বলেছিলেন ঘাটের কাছেই। বাংলাদেশ বিমানে কাজ করেন এমন একজনের বাড়ি। যাওয়া ঠিক হবে কিনা ভাবার সুযোগ ছিল না। অনেকটা বেপরোয়া হয়েই ওই বাড়িতে যাই। ভদ্রলোক অত্যন্ত উদারভাবে গ্রহণ করেছিলেন। ভালোভাবে পরীক্ষা শেষ করে বাড়ি চলে যাই। ফলাফল প্রকাশের পর ভর্তি হতে আসি। ভর্তি পরীক্ষা দেই। ভর্তি হয়ে এসএম হলেই থাকি। আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে ১৯৭৪ সালে আরেকটি ঘটনায় চারজন ছাত্র নিহত হয় জগন্নাথ হল ও শামসুন্নাহার হলের মধ্যবর্তী রাস্তায়।

১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালে আরো দুটি ঘটনায় আরো চার জন ছাত্র নিহত হয়। আরো দু’বার ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলে আমাকে হল ত্যাগ করতে হয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করার পরও হত্যাকাণ্ড প্রায় নিয়মিতই ছিল, যার ফলে ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশবিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিহতের সংখ্যা ৭৪ এবং আহতের সংখ্যা দুই হাজারে উন্নীত হয়েছে। আহতদের মধ্যে হাত-পা, চোখ হারানো ছাত্র সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। ব্যবসায়ীদের ধরে এনে হলে আটকে চাঁদা আদায়ের ঘটনা অহরহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো টেণ্ডারে ছাত্রনেতাদের ভাগ না দিয়ে কোনো ঠিকাদার কাজ করতে পারবে তা অকল্পনীয়। যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়া ছাড়া বিরোধী দলের সমর্থক কেউ কোনো আবাসিক হলে থাকার কথা ভাবতেও পারে না। ক্যাম্পাসে মিছিলের শ্লোগানের ভাষা হলো, “অমুককে ধরো, সকাল বিকাল নাশতা করো,” “রক্তের বদলে রক্ত চাই” ইত্যাদি।


‘প্র্রাচ্যের এই অক্সফোর্ড’ এ ঘটা হত্যাকাণ্ডের পরিসংখান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ’ বছরে পদার্পনের আনন্দ ম্লান করা আমার উদ্দেশ্য নয়। হত্যা মানে পাপমোচনের ও ইশ্বরকে সন্তুষ্ট করার একটি প্রক্রিয়া। আমরা তো আমাদের পাপের কারণে মুক্তির সন্ধান করি পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে, যা আগে নরবলির মাধ্যমে করা হতো সে কথা শুরুতেই উল্লেখ করেছি। এটাকে হত্যা বলা হয় না। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, “ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ, শক্তির উদ্বোধন।” আমার ছাত্রদের সময়ে যারা ঘাতক এবং ত্রাস হিসেবে জানতাম তাদের অনেককে পরবর্তী জীবনে সফল রাজনীতিবিদ, আইন প্রনেতা, আইনজীবী, আমলা, এমনকি বিচারক হিসেবে দেখেছি। মাশাআল্লাহ! এরা যে সাদা ভেড়ার পালে একটি মাত্র কালো ভেড়া তা নয়। অনেক। যারা ভালো তারা ৭৪ ছাত্রের প্রাণহানি, দুই সহস্রাধিক ছাত্রের আহত হওয়া প্রতিহত করতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স বৃদ্ধির সাথে এই কলঙ্কগুলো কোনোদিন মুছে দেওয়া যাবে না। আমার দু:খবোধ যাবে কী করে?


advertisement

Posted ৮:৩৩ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১১ জুলাই ২০২০

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আমরা মরি কেন?
আমরা মরি কেন?

(641 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.