বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

দিল্লির করিম’স ও নিউইয়র্কের খলিল’স

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু   |   বৃহস্পতিবার, ১২ মে ২০২২

দিল্লির করিম’স ও নিউইয়র্কের খলিল’স

গত ৯ মে সোমবার ব্রঙ্কসের ‘খলিল বিরিয়ানি’ নিউইয়র্কে কর্মরত সাংবাদিকদের সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন। সাধারণত আমি সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিসহ খাওয়ার দাওয়াত পরিহার করি। কারণ আমি স্বল্পাহারী, ভোজন রসিক নই। আমার না খাওয়ার তালিকা অতি দীর্ঘ। এমনকি আমার ৪১ বছরের প্রিয় স্ত্রীর তৈরি করা তার প্রিয় খাদ্যগুলোও আমি খাই না। আমার আহার শাকসব্জি, লতাপাতা নির্ভর। ভাত অবশ্যই থাকে। কালেভদ্রে চাল-গোশত সহযোগে তৈরি বিরিয়ানি, তেহারি জাতীয় খাবার গ্রহণ করি, কিন্তু এসবের মধ্যে চিকেন, মাটন থাকলে সেগুলো খাওয়া শুরু করার আগেই পাশের কাউকে দিয়ে দেই। আমি পেটুক নই, আমার জিহ্বা লম্বা নয়; আমার চোখের ক্ষুধা নেই এবং তা জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই নেই। আমার পাশে বসে কেউ সুবাস ছড়ানো উপাদেয় খাবার খায়, আমি চেখে দেখার আগ্রহও অনুভব করি না।


বাংলাদেশে ‘জিয়াফত’ অথবা অনুরূপ ধরনের ঘরোয়া দাওয়াতে গেলে ‘সাহিব-এ-দাওয়াত’ অর্থ্যাৎ দাওয়াত দানকারী তাঁর খাতিরের দু’জনকে বেশি সমাদর করতে তাদের পাত্রে বেশি করে খাবার তুলে দেন। আমি সমাদর পাওয়ার মতো কেউ নই, কিন্তু সর্বত্র নাছোড়বান্দা ধরনের লোক থাকে, মানা করার পরও জোর করে পাতে খাবার দেয়। দু’একবার মানা করার পরও যদি কেউ জবরদস্তি করে আমার পাতে খাবার তুলে দেন, তাহলে তাদের দেওয়া অতিরিক্ত খাবার আমার পাতেই পরে থাকে। দু’একবার এই ‘বেয়াদবী’ প্রদর্শন করার পর ‘সাহিব-এ-দাওয়াত’ সিরাতুল মুস্তাকিম অর্থ্যাৎ সরল সোজা পথ ধরেন। অন্তত দ্বিতীয় দাওয়াতে তারা আর জবরদস্তি করেন না সাধেনও না। আমি নিজে যে সামান্য খাবারটুকু নেই তা চেটেপুটে খাই, একটি ভাত অথবা অন্যকিছু একটুও ফেলে রাখি না। কারণ আমি শৈশব থেকে শুনে এসেছি, “দানে দানে পে লিখখা হ্যায় খানে ওয়ালে কা নাম।”

তবুও কেন খলিল বিরিয়ানি’র দাওয়াতে গেলাম? মুখ্য কারণ দাওয়াত দিয়েছেন আমার প্রিয় মানুষ, শুধু আমার নয়, সবারই প্রিয় হাবিব ভাই এবং বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। খলিলুর রহমান উদ্যোগী মানুষ, ২০১৭ সালে ব্রঙ্কসে একেবারে ছোট্ট পরিসরে ‘খলিল বিরিয়ানি’ চালু করেন এবং নিজ প্রতিভাবলে এখন চারটি প্রতিষ্ঠানের মালিক, যেখানে ৬৫ জন কর্মী নিয়োজিত। গত এক যুগে নিউইয়র্কে কত প্রতিষ্ঠানের উত্থান-পতন লক্ষ্য করেছি। অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে যাদের ব্যবসা শুরু করতে দেখেছি, অল্পদিনের মধ্যে তাদেরকে কলহে লিপ্ত হয়ে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে দেখেছি। সেদিক থেকে খলিলুর রহমান ব্যতিক্রম যে তিনি একক হাতে ব্যবসা পরিচালনা করছেন এবং ব্যবসায়ে সাফল্য তাকে আরও উৎসাহিত করছে ব্যবসা সম্প্রসারিত করতে।


পান-ভোজনে আমার আসক্তি না থাকা সত্ত্বেও আমি ‘খলিল বিরিয়ানি’র এমন খ্যাতি ও সাফল্য চাই, যাতে আমাকে কুইন্সের দক্ষিণ জ্যামাইকা থেকে ব্রঙ্কসের পার্কচেষ্টারে অবস্থিত ‘খলিল বিরিয়ানি’তে কোনো না কোনো খাবারের টানে যেতে হয়। যারা ভারতের রাজধানী দিল্লির ‘করিম’স নামটির সঙ্গে পরিচিত, বা করিম’স এ একবার গেছেন, করিম’স তাদের টানবেই। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে চলে আসার পূর্ববর্তী সময়ে প্রায় দুই দশক পর্যন্ত আমাকে বিভিন্ন সেমিনার, কনফারেন্স উপলক্ষে প্রতিবছর অন্তত একবার, অনেক সময় একাধিকার দিল্লিতে যেতে হয়েছে।

পুরোনো দিল্লির জামা মসজিদের উত্তর পাশে সরু একটি রাস্তার ওপর অবস্থিত করিম’স থেকে আমি ও আমার সফরসঙ্গীরা যত দূরেই অবস্থান করতাম না কেন, অন্তত একবার করিম’স অবশ্যই যেতাম। শেষ বার গেছি একটি বড় গ্রুপের প্রতিনিধি হয়ে। সেবার ছিল দিল্লির আন্তর্জাতিক মিলনায়তন কেন্দ্র ‘বিজ্ঞান ভবনে’ আইইউসিএন (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ কনজারভেশন অফ নেচার) এর নির্বাচন। প্রফেসর আইনুন নিশাতের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলে আমি ছাড়াও ছিলেন খ্যাতিমান সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ, ডেইলি স্টারের সাবেক চিফ রিপোর্টার শেহাবউদ্দিন নাফা, বেগম হাসনা মওদুদ, ব্যাঙ্ককে আইইউসিএন এর আঞ্চলিক দফতরের বাংলাদেশী প্রধান জব্বার সাহেব সহ আরও ক’জন। আইনুন নিশাত কোনো একটি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি আমাদের খাওয়াতে চান। আমি করিম’স এর প্রস্তাব করি, সবাই সমর্থন করেন। করিম’স এ গিয়ে চেয়ার দখল করে খাবার অর্ডার দিলেই চলে আসবে এমন নয়। শূণ্য চেয়ারের জন্য ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়। আমরা অর্ডার করে গলিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি। ঘন্টাখানেক পর আমাদের ডাক পড়ে। খেয়ে সবাই উচ্ছসিত হয়। এমন একটি খাবার স্থানের সন্ধান দেওয়ায় সবাই আমার প্রশংসা করেন। খেয়ে বের হওয়ার পর জব্বার সাহেব করিম’স এর সামনে পানের দোকান থেকে প্রতিটি পাঁচ রুপি দামের ‘পালং তোড়’ (খাট ভাঙা Ñ পানের এ ধরনের নামের মর্ম পাঠকের বোঝার কথা) পানের খিলি খাওয়ান।


দিল্লিতে ভোজন রসিক, বিশেষ করে যারা আমিষ ভোজনে অভ্যস্ত তাদের মধ্যে এমন লোক কম পাওয়া যাবে, যারা করিম’স এর নাম শোনেননি অথব সেখানে খেতে যাননি। করিম’স এর ৯০ শতাংশই অমুসলিম। ‘খলিল বিরিয়ানি’র ক্ষেত্রেও আমি তা দেখতে চাই বলে সেদিনের অনুষ্ঠানে গেছি। কথাগুলো বলারও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু অন্যান্যের কথা বলার সময় স্যুপ পরিবেশন করায় শ্রোতাদের মন স্যুপে নিবিষ্ট হয়েছিল, যারা তখনও বলছিলেন, তাদের কথায় কেউ আর মনোযোগ দেননি।

করিম’স এর বয়স ১০৯ বছর। জামা মসজিদের ঠিক উত্তর পাশে ‘গলি কাবাবিয়ান’ এ করিম’র এর প্রতিষ্ঠা ১৯১৩ সালে। হাজী করিমউদ্দিন এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বলতেন, “আমি সাধারণ মানুষের মাঝে শাহী খানা পরিবেশন করে খ্যাতি ও অর্থ উপার্জন করতে চাই। আল্লাহ’র ৯৯টি নামের একটি ‘করিম’, এই নামের বরকতে ‘করিম’স এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ‘খলিল’ও আল্লাহ’র ৯৯ নামের একটি। ইতোমধ্যে এই নামের বেশ বরকত হাসিল করেছে ‘খলিল বিরিয়ানি’। করিম’স এর প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে শোনা যায় হাজী করিমউদ্দিনের পিতা মোহাম্মদ আজিজ শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জিাফরের শাহী পাকশালায় বাবুর্চি ছিলেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর শেষ মোগল সম্রাটকে রেঙ্গুনে (ইয়াঙ্গুন) এ নির্বাসিত করার পর মোহাম্মদ আজিজ দিল্লি ত্যাগ করেন। ১৯১১ সালের ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জের অভিষেক এর সময় আজিজের এক পুত্র করিম দিল্লিতে ফিরে এসে দরবারে যোগদানকারী বহু লোকের খাবার চাহিদা মেটাতে একটি ধাবা চালু করেন ‘রুমালি রোটি’র সঙ্গে শুধু ‘আলু গোশত’ ও ডাল বিক্রির জন্য। পরে তিনি স্থায়ীভাবে তাঁর রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন।

সময়ের সঙ্গে করিম’স এর খ্যাতি বেড়ে চলে এবং পুরোনো দিল্লি ও ‘করিম’স নামটি এক সময় সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। ব্যবসা সম্প্রসারণের সঙ্গে কাহিনিও যুক্ত হতে থাকে। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অর্ধ শতাব্দী পর করিম’স এর দ্বিতীয় শাখা চালু নিজামুদ্দিনে। তৃতীয় শাখার চালু হয় ২০০০ সালে। বর্তমানে দিল্লি রাজধানী এলাকায় করিম’স এর শাখা তেরোটি।

নিজাদুদ্দিনে শাখার নাম ‘দস্তরখান-এ-করিম’। ১৯৮৮ সাল থেকে করিম’স একটি পারিবারিক লিমিটেড কোম্পানি “করিম হোটেলস প্রাইভেট লিমিটেড”। ভারতের দুই সাবেক রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ ও জাকির হোসেন করিম’স এর নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন। করিম’স এর নিজামুদ্দিন শাখা উদ্বোধন করেন মিসেস ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ। ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর পুত্র সন্ধয় গান্ধীও করিম’স খাবার পছন্দ করতেন। ইন্দিরা গান্ধীর খাবার প্রস্তুত করার সময় করিম’স এর কিচেনে সিকিউরিটির সদস্যরা উপস্থিত থাকতেন।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী খাবারের ব্র্যান্ডিংয়ে ‘খলিল বিরিয়ানি’র উদ্যোগের সাফল্য কামনা করি। কেউ যদি দিল্লি ভ্রমণে যান তাঁকে অবশ্যই করিম’স এ যেতে বলবো; নিউইয়র্কে বসবাসকারী ভোজন বিলাসী বাংলাদেশী অথবা যারা নিউইয়র্ক ভ্রমণে আসবেন, তাদের অবশ্যই খলিল বিরিয়ানি বা খলিল চাইনিজে অন্তত একবার যাওয়ার পরামর্শ দেব। করিম’স যেভাবে আমাকে টানে, খলিল’স সেভাবে তাদের আকৃষ্ট করবে বলে আমার বিশ্বাস।

advertisement

Posted ১০:০৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১২ মে ২০২২

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আমরা মরি কেন?
আমরা মরি কেন?

(634 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.