বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

সাত ভাষা-শহীদকে নিয়ে লেখা গ্রন্থ উত্থানপর্বের গল্প

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু   |   বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১

সাত ভাষা-শহীদকে নিয়ে লেখা গ্রন্থ উত্থানপর্বের গল্প

ভাষার মাস। আমি ঠিক করেছি আজ আমি একটি বই নিয়ে লিখবো। এমন একটি বই, যে বইটি রচিত হয়েছে আমাদের ভাষা আন্দোলনের সাতজন শহীদের ওপর। সাতজনকে নিয়ে লেখা সাতটি গল্প। গল্পের আকারে লেখা হলেও ‘উত্থান পর্বের গল্প’ আসলে কোনো গল্পগ্রন্থ নয়। গল্পের আড়ালে একটি জাতি ও একটি রাষ্ট্র গঠনের কাহিনি। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার যে উন্মেষ ঘটেছিল, যে সাত শহীদের প্রাণের বিনিময়ে ভাষা আন্দোলন ধাপে ধাপে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল, তা বিবৃত হয়েছে এ গ্রন্থে।

গ্রন্থটির লেখক কাজী জহিরুল ইসলাম মূলত একজন কবি, কিন্তু গল্প রচনায়ও তিনি সিদ্ধহস্ত। তাঁর লেখনির গুণে ইতিহাস পাঠে বিমুখ পাঠকও গল্পের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের অলিগলিতে অনায়াসে বিচরণ করেন। ভাষা আন্দোলনে মোট ক’জন শহীদ হয়েছিলেন তা এখনও বিতর্কিত। ভাষা আন্দোলনকে দমাতে শাসকের লেলিয়ে দেয়া বাহিনীর গুলিতে যে ক’জনের মৃত্যু ঘটেছিল, তারা রাষ্ট্রভাষার মর্ম কতটা উপলব্ধি করে গুলির মুখে এগিয়ে গিয়েছিলেন তা প্রধান বিবেচ্য নয়। যারা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, ইতিহাসে তাদের নাম আছে, তাদের পদ-পদবী ও ভূমিকা সবই জানা যায়। কিন্তু তাদের একজনও শহীদ হননি। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে খুব কম সেনাপতিই নিহত হন। কারণ তারা যুদ্ধক্ষেত্রে পেছনের অবস্থানে থেকে যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল নির্ণয় করেন, যুদ্ধক্ষেত্রে রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। যারা যুদ্ধক্ষেত্রে থাকে তারাও যে শহীদ হওয়ার জন্য নিহত হয়, এমন নয়। শহীদ হওয়ার জন্য কেউ গুলির মুখে বুক পেতে দেয় না। মরে গিয়ে শহীদ হয়। মৃত্যুর উপলক্ষটাই এখানে বড়। তারা ভাষা-আন্দোলনের মিছিলে ছিলেন, যারা আন্দোলন দমন করতে মিছিলের ওপর গুলি ছুড়েছিল তারা ভাষা আন্দোলনকে দমন চেয়েছিল। তাদের গুলিতে মৃতরাই শহীদের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন। রাষ্ট্র তাদেরকে শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, দেশবাসীর স্মৃতিতেও তারাই ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিত হয়েছেন।


ইতিহাসে দেখা যায়, উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে পরিচিত ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ দমন করতে ব্রিটিশ শাসকদের আদেশে ভারতীয়রাই তাদের স্বদেশী জ্ঞাতি ভাই-বিদ্রোহীদের দমন করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। ব্রিটিশ বাহিনীর ভারতীয় সৈন্যরা ব্রিটিশদের সহায়তায় এগিয়ে না এলে ১৮৫৭ সালেই ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসকদের বিলুপ্তি ঘটতো। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন দমন করতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি প্রশাসকেরাই আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি বর্ষণ করেছিল এবং বাঙালি পুলিশরাই মিছিলকারীদের ওপর গুলি ছুঁড়েছিল। ইতিহাসের এই অন্ধকার দিকগুলো কখনোই বিবেচনায় আসে না। কারণ তারা আইনের আশ্রয়ে দায়মুক্তি লাভ করেন। ইতিহাসের এই অন্ধকার দিকটি আমার কাছে দুর্বোধ্য।


কাজী জহিরুল ইসলাম তাঁর ‘উত্থানপর্বের গল্পে’ ভাষা শহীদ সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, সফিউর, অহিউল্লাহ ও আউয়াল এর কাহিনি তুলে ধরেছেন। তাঁর কাহিনি রূপক হলেও সত্যতা থেকে দূরে নয়। ভাষা দিবস যখন ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা হারিয়ে ‘শহীদ দিবস’ এর পরিবর্তে বাঙালির উৎসবে পরিণত হয়েছে সে অবস্থার মধ্যে কবি জহিরের গল্পগুলো পাঠকদের মূল চেতনার মধ্যে ফিরে যেতে সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস। শহীদ সালামের গল্পে তিনি ভাষা আন্দোলনের সূচনাকালের বর্ণনা তুলে ধরতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র একটি নিবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যে নিবন্ধে ড. শহীদুল্লাহ পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একাধিক রাষ্ট্রভাষা চালু থাকার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন এবং বলেছেন যে, বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ না করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। এই গল্পে লেখক বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে তমুদ্দুন মজলিসের বক্তব্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ষ্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি গড়ে তোলা এবং পর্যায়ক্রমে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠাসহ সালামের শাহাদত বরণ করা পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের সুখপাঠ্য বর্ণনা তুলে ধরেছেন।

শহীদ বরকতকে জীবন্ত করতে আমাদের জানা সময়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সামরিক শাসন জারির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে লেখক আমাদের নিয়ে যান গাজীপুরে তার বাড়িতে। পরিবারের সঙ্গে আলাপচারিতার সূত্রে তুলে ধরা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরে বরকতের জন্ম, পড়াশোনা, দেশ বিভাগ, পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, রেসকোর্সের যে সমাবেশে জিন্নাহ উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিয়েছেন সেখানে উপস্থিত থাকা থেকে তার শহীদ হওয়া পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। বরকতের কাহিনি পড়ার সময় পাঠক ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির মিছিলে গুলিবর্ষণের ঘটনার মধ্যে নিজেকে উপস্থিত দেখতে পাবেন।


শহীদ জব্বারের কাহিনির প্রথমাংশের বর্ণনার সাহিত্য-মূল্য থাকলেও আমার কাছে বাহুল্য মনে হয়েছে। দ্বিতীয়াংশে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের ‘চরমপত্র’ খ্যাত এম আর আখতার মুকুলের সঙ্গে আলাপচারিতা। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে এম আর আখতার মুকুলের নিবিড় সম্পৃক্ততা নিয়ে আমার সংশয় সন্দেহ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বহুল পঠিত গ্রন্থ ‘আমি বিজয় দেখেছি’র বর্ণনায় তিনি নিজেকে প্রায় সর্বত্র উপস্থিত দেখিয়েছেন। কিন্তু ওই সময়ের, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের যুদ্ধ নিয়ে যারা অধিক পড়াশোনা করেছেন তারা সহজে এম আর আখতারের বর্ণনাকে মেজর সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ এবং লে: জেনারের সুখওয়ান্ত সিং এর ‘লিবারেশন অফ বাংলাদেশ’গ্রন্থের হুবহু অনুবাদ হিসেবে দেখতে পাবেন। কিন্তু আমি ‘বিজয় দেখেছি’র কোথাও এ ধরনের স্বীকারোক্তি নেই। অতএব ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সংঘটিত ঘটনা সম্পর্কে কারও দ্বিমত না থাকলেও এম আর আখতারের মুখ দিয়ে তা বলানো গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি না। তাছাড়া শহীদ জব্বার তাঁর অসুস্থ শাশুরির জন্য ওষুধ কেনার মতো জরুরী কাজ ফেলে মিছিলে অংশ নিয়েছেন এমন বর্ণনাও একটু বেশি রূপক হয়ে গেছে বলে মনে হয়।

শহীদ রফিকের গল্পে উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে রয়েছে ভাষা আন্দোলনের নেতা ভাষা মতিনের সাক্ষাৎকার। এরপর রয়েছে শহীদ সফিউর, শহীদ অহিউল্লা, শহীদ আউয়ালের গল্প। বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানে না বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। ভাষা আন্দোলন নিয়ে যারা মাথা ঘামান বা কিছুটা জানেন তাদের কাছে অহিউল্লা ও আউয়াল প্রায় অপরিচিত নাম। ১৯৫২ সালে অহিউল্লার বয়স বেশি হলে দশ বছর। পুরোনো ঢাকার বাসিন্দা এক রাজমিস্ত্রির ছেলে। ২১ শে ফেবব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেলের সামনে ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়ে অজানা সংখ্যক ছাত্রকে হত্যার প্রতিবাদে পরদিন ২২ ফেব্রয়ারি নওয়াবপুর রোডে আয়োজিত বিক্ষোভের ওপর গুলিবর্ষণে নিহত হয়েছিলেন অহিউল্লা। ভাষা আন্দোলনের ওপর লেখা কিছু বইপত্রে, ওই সময়ের সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে অহিউল্লার শাহাদত বরণের ঘটনা প্রমাণিত হলেও এখন পর্যন্ত তাকে সম্মানিত করার কোনো উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গ্রহণ করা হয়নি।

স্বীকৃতি না পাওয়া আরেক ভাষা শহীদ আউয়াল। তিনি রিকশা চালক ছিলেন। তিনিও নিহত হন ভাষা শহীদদের জন্য আয়োজিত গায়েবানা জানাজায় অংশ নিয়ে। জানাজায় অংশগ্রহণকারীদের ওপর ট্রাক চালিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং ঘাতক ট্রাকের নিচে চাপ পড়ে নিহত হন আউয়াল। আউয়ালের কাহিনি পড়ার সময় হোঁচট খেতে হয় তথ্যের ঘাটতির কারণে। মনে হয়েছে আউয়ালের ওপর গল্প দাঁড় করাতে গিয়ে কবি জহির তাড়াহুড়া করে ফেলেছেন। সে কারণে পটভূমির ওপর মনোযোগ বেশি ছিল। গবেষকেরা হয়তো এ অস্পষ্টতা কাটিয়ে উঠতে পারবেন। কিন্তু সে উদ্যোগ এখন আর নেই। এখন মোটামুটি শিক্ষিত প্রবীণ কোনো ব্যক্তি দেশের যে প্রান্তেই মারা যান তার নামের আগে ‘ভাষা আন্দোলনের বীর,’ ‘ভাষা সৈনিক,’ ইত্যাদি শব্দ জুড়ে দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ ঢাকা কেন্দ্রীক। এর সমর্থনে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের দু’একটি বড় শহরে প্রতিবাদ হলেও তা গুটিকয়েক মানুষের মধ্যে সীমিত ছিল। এটি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া কোনো গণআন্দোলন ছিল না।

একথা সত্য, ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর শেষ হয়ে যায়নি। আন্দোলন ভিন্ন রূপ নিয়েছে। ১৯৫৬ সালে যদিও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা স্বীকৃত হয়েছে, কিন্তু অফিস আদালতে বা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা চালু না হওয়ায় আন্দোলন অব্যাহত ছিল। এমনকি ষাটের দশকে স্কুলের ছাত্র থাকাকালে আমিও এইসব দাবী লেখা প্লাকার্ড হাতে অন্যান্য ছাত্রদের সাথে মিছিলে অংশগ্রহণ করেছি। মিছিলকারীরা যেখানেই ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড দেখেছে, সেগুলো নামিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে। তাহলে কি আমিও ভাষা সৈনিক? আসলে এভাবে হয় না। মানুষের নামের সাথে পাইকারি হারে ‘ভাষা সৈনিক’ জুড়ে দেয়া ভাষা আন্দোলনকে ছোট করে ফেলার শামিল ও বালখিল্যতা। এই প্রবণতা বন্ধ করার পাশাপাশি প্রকৃত ভাষা শহীদদের মর্যাদায় অভিষিক্ত করা উচিত, তারা মিস্ত্রিপুত্র হোক, বা রিকশা চালক হোক।

সবকিছু মিলিয়ে ভাষা শহীদদের নিয়ে কবি কাজী জহিরুল ইসলামের এ ধরনের ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা তাদেরকে কিছুটা হলেও ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে নিয়ে যাবে এবং তারা হয়তো ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানতেও আগ্রহী হয়ে উঠবে। কবি জহিরের উদ্যোগের প্রশংসা করি। উত্থানপর্বের গল্প বইটি প্রকাশ করে প্রশংসার কাজ করেছে অগ্রদূত অ্যান্ড কোম্পানি।

advertisement

Posted ৯:০৫ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আমরা মরি কেন?
আমরা মরি কেন?

(633 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.