আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : | বৃহস্পতিবার, ০৯ জুন ২০২২
আমার প্রিয় খাদ্য লতাপাতাও মহার্ঘ হয়ে ওঠেছে। সীমিত আয়সম্পন্ন যারা মহার্ঘ আহার্য গ্রহণ করেন খাদ্য ক্রয় খাতে তাদের ব্যয় দেড় থেকে দুইগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি স্বল্পাহারী হওয়া সত্ত্বেও করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর আমার আয়ের উৎসগুলো, বিশেষ করে অ্যাসাইলাম অফিস, কোর্টে বাংলা ও হিন্দিভাষীদের পক্ষে ইন্টারপ্রেটার বা দোভাষীর কাজ বন্ধ হওয়ার পর এখনও চালু হয়নি।
উনচল্লিশ সপ্তাহের সরকারি আর্থিক সহযোগিতা হয়তো সাময়িক উপশম ছিল, আয়ের ঘাটতি মেটানোর মত ছিল না। তার ওপর নিউইয়র্ক স্টেটের রাজস্ব বিভাগ প্রনোদনার অর্থের ওপর কর দাবী করছে, যার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। এখন আমার আয়ের উৎস ও সরকারি প্রনোদনা উভয়ই বন্ধ। তদুপরি দুই মাসের ব্যবধানে খাদ্যসামগ্রীর মূল্য এত বেড়েছে যে, প্রয়োজনের তালিকা কাটছাঁট করেও সামাল দেওয়া কঠিন হচ্ছে।
শৈশবে যখন পড়তাম, “শায়েস্তা খানের আমলে ঢাকায় ১ টাকায় আট মণ পাওয়া যাইত,” তখন অবিশ্বাস করতাম, হাসতাম। শায়েস্তা খান বাংলায় দুই দফা মোগল সুবেদার ছিলেন: ১৬৬৩-৭৮ ও ১৬৮০-৮৮ মেয়াদে।
শায়েস্তা খানের সময়ের খাদ্যমূল্য নিয়ে আমার হাসিমস্করা ও অবিশ্বাসের সময়কাল ১৯৬০ এর দশকের প্রথম ভাগ, আমি নিতান্তই শিশু। আমি যদি বলি ১৯৬১ সালে আমি চালের মূল্য দেখেছি প্রতি সের চার আনা, বড় জোর পাঁচ আনা তাহলে সবাই হাসবে এবং আমার মস্তিস্কের স্থিরতা নিয়ে সন্দেহ করবে। কিন্তু হাসির কথা নয়, এমন দিনকাল ছিল। ১৯৭০ সালে “সোনার বাংলা শ্মশান কেন” শিরোনামে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পোস্টারে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিমণ চাল ৫০ টাকা অর্থ্যাৎ সের প্রতি ১.২৫ টাকা এবং আটা প্রতিমণ ৩০ টাকা অর্থ্যাৎ সের প্রতি ৭৫ পয়সা, সরিষার তেল সের প্রতি ৫ টাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে এসব পন্যের মূল্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মূল্যের অর্ধেক। পোস্টারে প্রতি ভরি সোনা পূর্ব পাকিস্তানে ১৭০ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতি ভরি ১৩৫ টাকা দেখানো হয়েছিল।
পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যেকোনো পন্যমূল্য কম ছিল। কিন্তু পোষ্টারটি প্রকাশের উদ্দেশ্য যেহেতু রাজনৈতিক, তাতে পন্যমূল্য কিছুটা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল এবং তা সোনার মূল্যের ক্ষেত্রেও। আমার এক চাচা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তিনি ছুটিতে বাড়ি আসার সময় কয়েকটি সোনার মুদ্রা আনতেন, এক ভরি ওজনের চকচকে মুদ্রায় উৎকীর্ণ থাকত ১০০ টাকা। সুবর্ণ মুদ্রাগুলো তিনি আব্বাকে দিতেন উপযুক্ত মূল্যে বিক্রয় করার জন্য। অনেক সময় আব্বা আমাকে একটি মুদ্রা দিয়ে বলতেন ওই সময়ে শেরপুরের একমাত্র মুসলিম জুয়েলার নয়ানি বাজারের “মুসলিম জুয়েলার্স” এ দিয়ে টাকা নিয়ে আসতে। আমি জুয়েলারকে (নাম মনে নেই) মুদ্রাটি দিলে ১৯৭০ সালেও তিনি আমাকে এক ভরি সোনার বিনিময়ে ১৩৮ টাকা দিতেন।
নিউইয়র্কে দু’মাস আগে যে চালের ২০ পাউন্ডের ব্যাগ ১৫ ডলারে পাওয়া যেত তা এখন ১৯ ডলার, ১১ ডলার মূল্যের ১০ পাউন্ডের পোলাও চালের প্যাকেট ১৮ ডলার। এক গ্যালন দুধ তিন ডলার থেকে সাড়ে চার বা পাঁচ ডলারে ওঠেছে। যে কোনো আকৃতির ডিমের মূল্য দ্বিগুণের বেশি। দুই তিন বছর আগেও সামারে ‘মিডিয়াম’ আকৃতির এক ডজন ডিম অনেক সময় মাত্র ৫০ সেন্ট, অর্থ্যাৎ চার ডজন ডিম মাত্র ২ ডলারে পাওয়া যেত, এখন সেই ‘মিডিয়াম’ এক ডজন ডিমের দাম ৩ ডলার। মাংস, তা মুরগী, খাসি, গরুর হোক না কেন, প্রতিটিই মূল্য দৌড়ে টগবগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি মাংস খাই না বললেই চলে, কিন্তু বাড়িতে আরও সদস্য আছে, মেহমান-নেওয়াজি আছে, অতএব কিনতেই হয়। তারা তৃণভোজী নন।
পণ্যমূল্য আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন আমেরিকান অর্থনীতিবিদরা। কারণ জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে, অতএব পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি স্বাভাবিক। প্রতিটি শিপিং রুটে ৪০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনার ভাড়া দ্বিগুণ তো বটেই ৫ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। কানাডা ও মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে কনটেইনার ট্রাকের ভাড়া দ্বিগুণ হয়েছে। কনটেইনার পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিকৃত প্রতিটি পন্যের মূল্য এভাবেই বাড়তে থাকবে।
Posted ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৯ জুন ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh