শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

নজিব ভাইয়ের জীবনও কেড়ে নিল করোনা

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু   |   বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২১

নজিব ভাইয়ের জীবনও কেড়ে নিল করোনা

এসএসসির সার্টিফিকেট অনুযায়ী নজিবুর রহমান ভাই আমার চেয়ে এক বছরের বড়। উনি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন ১৯৬৮ সালে, আমি দিয়েছি ১৯৬৯ সালে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা করেছেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলাম। বাংলাদেশে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় আট বছর আগে ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল। ১১ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত চারটি দিন আমরা এক সঙ্গেই ঘুরেছি নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসি’র বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে। মাত্র তিন দিনে আমাদের মাঝে যে নিবিড় হয়েছিলাম, বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে বহু বছর ধরে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা সাক্ষাতেও সে সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। তাঁর নাম নজিবুর রহমান। আমার পরিচিত জগতে অত্যন্ত সহজ-সরল, নির্মোহ-নিরহঙ্কার ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি: এর হিউম্যান রিসোর্সেস ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বশীল সাবেক এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর। ব্যাংকের চাকুরি থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি জিএমএস নিটিংয়ের এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালে তার পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় এবং গতকাল ২২ এপ্রিল বৃহস্পতিবার তিনি ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফিরদৌসে দাখিল করুন।


নজিবুর রহমান ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রপাত ঘটে তাঁর মেয়ে তাজকিয়া বিনতে নাজিবের ঞধুশরধ ইরহঃব ঘধলরন মাধ্যমে। তাজকিয়া দিগন্ত টেলিভিশনে সংবাদ পাঠক ছিলেন। এটি ছিল তার খন্ডকালীন কাজ। তিনি মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করতেন। সংবাদ মাধ্যমের অনেক কর্মী আমার ফেসবুক বন্ধু। তাজকিয়াও আছেন। ঢাকায় থাকাকালে তার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। ফেসবুকে টেক্সট বিনিময় বা টেলিফোনে কথা হয়নি। ২০১২ সালের শেষ দিকে তাজকিয়া আমাকে জানান যে তার আব্বা ফ্লোরিডায় আসছেন কোনো বাংকিং সেমিনারে। সেখান থেকে নিউইয়র্কে যাবেন এবং ব্রঙ্কসে তাঁর এক বোনের বাড়িতে উঠবেন। আমার সময় সুযোগ হলে আমি যাতে তাকে কিছু দর্শনীয় স্থানে নিয়ে যাই। ফ্লোরিডার কনফারেন্স শেষে তিনি নিউইয়র্কে আসার পর আমি ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল সকালে ব্রঙ্কস থেকে তাঁকে নিয়ে ম্যানহাটানের কিছু স্থান, ব্রুকলিনের ওয়াল স্ট্রিট, সাউথ ফেরি, কুইন্সের বাঙালি এলাকা জ্যাকসন হাইটস ঘুরিয়ে দেখাই। ওয়াশিংটন ডিসিতে যেতে চান কিনা জানতে চাইলে তিনি সম্মত হন। আমরা পরদিন সকালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমার ওই সময়ের সকল কাজে সহায়তাকারী কামাল ভাইকে ফোন করে ওয়াশিংটনে পরিচিত কাউকে জানাতে বলি যাতে ১২ এপ্রিল তিনি আমাদের বাস স্টপেজ থেকে নিয়ে রাত্রিযাপন ও পরদিন নগরী ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা করেন। কামাল ভাই করিৎকর্মা মানুষ। সকল আয়োজন সম্পন্ন করে তিনি আমাকে একটি ফোন নাম্বার দেন। ওই নাম্বারে কল কলেই কেউ এসে আমাদের নিয়ে যাবেন।

১২ এপ্রিল দুপুরের পর ব্রঙ্কস থেকে নজিবুর রহমান ভাইকে নিয়ে লোয়ার ম্যানহাটানের চায়না টাউনে এসে ক্যানাল স্ট্রিট থেকে বাসে ওঠে ওয়াশিংটন ডিসি’র উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। তিনি বাস ভাড়া এবং আগের দিন ঘোরাঘুরি ও চা-নাশতা খেতে যা খরচ হয়েছে তা আমার পকেটে গুঁজে দেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বার বার বলছিলেন, ‘আপনাকে খরচ করিয়েছি শুনলে আমার মেয়ে আমাকে খুব বকাবকি করবে। এমনিতেই আপনার অনেক সময় নিয়ে নিচ্ছি।’ আমি তাঁকে নিরস্ত করে বলি, ‘আপনার মেয়ে আমারও মেয়ে। ফেসবুকের কথাবার্তায় আমি ওর নাম ধরে নয়, ‘মা’ বলে সম্বোধন করি। তাছাড়া আমি আপনাকে বিমানে তুলে নিয়ে যাচ্ছি না।’ চায়না বাসে অবিশ্বাস্য কম ভাড়ায় যাতায়াত করা যায়। যাত্রী পিছু রিটার্ন টিকেট মাত্র ২৬ ডলার। ওয়ানওয়ে ভাড়া একটু বেশি ১৭ ডলার। রিটার্ন টিকেট ব্যবহারের দিন তারিখ নির্ধারিত থাকে না; যেকোনো সময় ব্যবহার করা যায়।


নিউইয়র্ক থেকে বাসে ওয়াশিংটন ডিসি চার ঘন্টার দূরত্ব। আমাদের বাস সন্ধ্যার পর পৌঁছে। কামাল ভাইয়ের দেয়া নাম্বারে কল করার কিছুক্ষণ পরই রেজাউল নামে একজন আসেন। তার বাড়ি রাজশাহীতে। নজিবুর রহমান ভাইয়ের বাড়িও পাবনায়। অতএব স্বচ্ছন্দ হতে সময় লাগে না। তিনি আমাদের এক বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টে নিয়ে যান। আমাদেরকে উপলক্ষ করে ওয়াশিংটনের আরও কয়েকজন বাংলাদেশীকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। আমরা বিব্রত বোধ করলেও তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। তারা জানান যে আমাদের পক্ষে ডিসি’র অধিকাংশ দর্শনীয় স্থান দেখা সম্ভব হবে না। কারণ পরদিন ১৩ এপ্রিল চেরি ফেস্টিভ্যাল। সিটির অধিকাংশ এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে চেরি উৎসব দেখতে পারবো এবং হাঁটা দূরত্বে আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো দেখতে পারবো। এর আগে আমি বেশ ক’বার ওয়াশিংটন ডিসি গেলেও চেরি ফেস্টিভ্যাল দেখা হয়নি। এবার দেখতে পাবো। নজিবুর রহমান ভাইকেও বললাম যে, আমরা ভালো একটি সময়ে এসেছি। ওয়াশিংটনের চেরি ফেস্টিভ্যাল দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকা থেকে তো বটেই, বাইরের দেশগুলো থেকেও অনেকে আসে। কারণ চেরি ফেস্টিভ্যাল শুধু চেরি ফুল ফোটা দেখা নয়। সপ্তাহ জুড়ে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। হোটেলগুলো অগ্রিম বুকড হয়ে যায়। রেস্টুরেন্টে খাবারের জন্য দীর্ঘ লাইন ধরতে হয়।

ডিসি থেকে কয়েক মাইল দূরে ভার্জিনিয়ার ছোট্ট এক সিটিতে আমরা এক বাংলাদেশী ভদ্রলোকের বাড়িতে রাত কাটালাম। সকালে রেজা ভাই এসে আমাদের নিয়ে ডিসি’র উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। দূরত্ব কম হলেও ডিসিমুখী গাড়ির ভিড়ে পথ শেষ হচ্ছিল না। তিন মাইল যেতে বোধ হয় এক ঘন্টার বেশি সময় লেগেছিল। যেখান থেকে ডিসিতে যানবাহন প্রবেশ বন্ধ করা হয়েছে রেজা ভাই আমাদের সেখানে নামিয়ে পথের দিশা বলে দিলেন। তিনি জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির একজন বাংলাদেশী ছাত্রকেও বলে দেবেন, যিনি চেরি ফেস্টিভ্যাল ছাড়াও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো যথাসম্ভব ঘুরিয়ে দেখাবেন।


নজিবুর রহমান ভাই না এলে আমার চেরি ফেস্টিভ্যাল দেখা হতো কিনা জানি না। কারণ তিনি আসার আগেও আমি এ ফেস্টিভ্যাল দেখিনি, পরেও আর দেখা হয়নি। প্রতিবছর চেরি ফেস্টিভ্যাল আসে। নজিবুর ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। আমরা একসঙ্গে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য অবলোকন করেছি। অন্য কোনো সৌন্দর্যের সঙ্গে এর তুলনা হয় না। কয়েক ঘন্টা ধরে আমরা চেরির সৌন্দর্য দেখলাম ছবি তুললাম। ইতোমধ্যে বাংলাদেশী ছাত্রটি (দু:খিত তার নাম ভুলে গেছি) চলে এসেছিলেন। তিনি আমাদের লিঙ্কন মেমোরিয়াল, অ্যারোস্পেস মিউজিয়াম, ভিয়েতনাম ওয়ার মেমোরিয়াল, ক্যাপিটল হিল, হোয়াইট হাউসসহ আরও কিছু স্থাপনা দেখানোর পর ন্যাশনাল প্রেস বিল্ডিংয়ে নিয়ে যান লাঞ্চ করাতে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর আমরা একটি টেবিল পাই। ভিড়ের কারণে সার্ভিসও বিলম্বিত ছিল। লাঞ্চ সেরে আমরা তাকে বিদায় জানিয়ে নিউইয়র্কের বাস ধরতে চলে আসি। নিউইয়র্ক পৌছতে রাত ৯টার মতো বেজে গিয়েছিল। তাঁকে সাবওয়ের ব্রঙ্কসগামী সিক্সথ ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে, একটি ম্যাপ ধরিয়ে বার বার বলে দেই কোন্ স্টেশনে নামতে হবে। বাড়ি ফিরে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফোন করি যে তিনি তার বোনের বাড়িতে ঠিকঠাক পৌঁছেছেন। পরদিন ১৪ এপ্রিল তিনি কারও সঙ্গে জ্যাকসন হাইটসে এসে আমাকে কল করেন। তাঁর এক আত্মীয়ের বাসায় এসেছেন। আমি সেখানে নিয়ে আবার বের হই এবং জ্যাকসন হাইটসে ঘুরে চা সিঙ্গারা খেয়ে তাকে পৌছে দেই এবং বিদায় নেই। তিনি আর দু’দিন থাকবেন। তাজকিয়ার এক সময়ের সহকর্মী স্পোর্টস রিপোর্টার আলমগীর হোসেন, তার বাড়িও পাবনা, তিনি নজিবুর ভাইকে সিটির আরও কিছু দর্শনীয় স্থান দেখাবেন।

তাঁর সঙ্গে এই সম্পর্ক পারিবারিক পর্যায়ে পৌছে। আমি তাকে কল করি, তিনিও কল করে আমার খোঁজখবর নেন। আমার গিন্নি ঢাকা গেলে তিনি ও তার কন্যা দাওয়াত করেন। ঘোরার জন্য নিজের গাড়ি দিয়ে দেন। তাঁর স্ত্রী ও কন্যা আমার জন্য উপহার পাঠান। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে আমার ছেলে সাদের স্ত্রী নাইমা কন্যা সন্তানের জন্ম হয় মিরপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে। নজিবুর রহমান ভাই তখন ব্যাংক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক। তিনি সার্বক্ষণিক আমার ছেলের স্ত্রী ও নবজাত কন্যার অবস্থার খবর নিয়েছেন। ভাবি ও তাজকিয়া হাসপাতালে গিয়ে সার্বক্ষণিক খোঁজ রেখেছেন। এমনকি হাসপাতালের বিলে যা ছাড় দেয়া সম্ভব সে ব্যবস্থাও করেছেন। আমরা পুরো পরিবার তার কাছে কৃতজ্ঞ। নানা ব্যস্ততায় আমি অনেকদিন পর্যন্ত তাঁর খোঁজ নিতে পারিনি। তাঁর ইন্তেকালের খবরে গ্লানি বোধ করছি। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন। নাজিব ভাইয়ের পরকালীন শান্তি কামনা করি।

advertisement

Posted ১১:১৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২১

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আমরা মরি কেন?
আমরা মরি কেন?

(641 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.