শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ | ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

ডা. ড্যানের ২ লাখ খতনা এবং আমার স্মৃতি

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু   |   বৃহস্পতিবার, ০৬ এপ্রিল ২০২৩

ডা. ড্যানের ২ লাখ খতনা এবং আমার স্মৃতি

জানার শেষ নেই। শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ড্যানিয়েল ই, ম্যাকক্রিমনস এর সঙ্গে দেখা না হলে আমার বিশ্বাস হত না যে, একজন ব্যক্তির পক্ষে তার ৪৪ বছরের পেশা জীবনে দুই লাখের অধিক শিশুর খতনা করানো সম্ভব। তিনি ইহুদি ধর্মাবলম্বী কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান। খতনা করেন সকল ধর্মাবলম্বী মা-বাবার ছেলেশিশুদের- ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম। নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণকারী ড্যানিয়েল হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে বায়োকেমেস্ট্রিতে ব্যাচেলর ডিগ্রি নেয়ার পর কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস এন্ড সার্জনস থেকে মেডিকেল ডিগ্রি গ্রহণ করেন। বর্তমানে প্রাকটিস করেন ক্যালিফোর্নিয়ার রাজধানি সেক্রামেন্টাতে।

ডা. ড্যানিয়েল ই, ম্যাকক্রিমনস

গত ১২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় আমার কন্যার ২৭ দিন বয়সের ছেলেকে খতনা করাতে নিয়ে গেলে তার সঙ্গে পরিচয় হয়। বয়সে আমার চেয়ে এক বছরের বড়ো। তিনি প্রচুর কথা বলতে পছন্দ করেন এবং উচ্ছসিত হাসতে পারেন। ভারতের ইতিহাস ও রাজনীতির ওপর বেশ পড়াশোনা তাঁর। মহাত্মা গান্ধী ও বাবাসাহেব আম্বেদকরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তিনি একজন মানবতাবাদী, বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাঁর বেশ কটি ফিকশন ও নন-ফিকশন বইও আছে।


বাংলাদেশে গ্রামের হাজাম ও শহরের ডাক্তারদের দ্বারা খতনা করানো দেখেছি। যুক্তরাষ্ট্রে নাতির খতনা দেখার সুযোগ না হলে একটি পাশ্চাত্যে এ কর্ম কীভাবে সম্পন্ন হয় সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করা থেকে বঞ্চিত হতাম। বাংলাদেশে খতনা করানোর সাধারণ বয়স ৭/৮ বছর, ওই বয়সে আমি গ্রামে থাকতাম। পিঠাপিঠী ভাই, সমবয়সী চাচা, চাচাতো-জেঠাতো ভাই, ফুফাতো ভাই মিলে মোটামুটি জনাদশেক শিশুকে শীতের এক বিকেলে হাজাম এসে সবাইকে ‘মুসলমানি’ করিয়ে দিয়ে যায়। অনেক পরে জানি, এটাই ‘খতনা’ বা ‘সুন্নতে খতনা’। মুসলমানির আগের দিন থেকে আমাদের সমাদর বেড়ে গিয়েছিল।

আমাদের জন্যে কিনে আনা হয়েছিল সেলাই ছাড়া ছোটো সাইজের লাল রঙের ডোরাকাটা লুঙ্গি। দুই ফুফু ও ফুফাতো ভাইবোনেরা আসে। খাসি জবাই করা হয়। উৎসবের আমেজে আমরা খুব খুশি। যেহেতু কী ঘটবে তা জানা নেই, অতএব ভয় পাওয়ার সঙ্গত কারণ ছিল না।


এত আয়োজনের কারণ যে দু’একজন টের পেত না এমন নয়, মুরুব্বিারা তাদের চোখে চোখে রাখতেন, যাতে পালাতে না পারে। তারা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, একবার যদি কারো মনে ভয় ঢুকে, তাহলে তাকে মুসলমানি করানো কঠিন হয়ে পড়বে। তাই হয়। আমার এক ডাক্তার বন্ধু শিহাব উদ্দিন বলেন যে, তার এক বন্ধু শৈশবে মুসলমানির হাত থেকে বাঁচতে কয়েক বছর পর্যন্ত পালিয়ে পার করেছে এবং যখন স্কুলে শেষ দিকের ক্লাসে উঠে তখন গোয়ার্তুমি করে আর মুসলমানি করায়নি। আগে এসএসসি পাস করেই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হওয়া যেত।

তিনি চট্টগ্রামের কোনো এক স্কুলের শিক্ষক হন এবং তার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর বিপাকে পড়েন। স্ত্রীর কাছে তার ‘মুসলমান’ না হওয়া গোপন রাখবেন কীভাবে! তার সমস্যার কথা ডাক্তার শিহাবকে বলেন। তিনি তাকে ১০/১২ দিনের ছুটি নিয়ে ঢাকায় চলে আসতে বলেন। বেচারা ঢাকায় আসেন, ডাক্তার শিহাবের কাছে খতনা করিয়ে ‘মুসলমান’ হয়ে এলাকায় গিয়ে বিয়ে করেন।


ইসলামে ‘খতনা’ করার বাধ্যবাধকতা নেই। ‘খতনা’ সম্পর্কে কোরআনে কোনো নির্দেশ নেই, হাদিসে খতনার উল্লেখ থাকলেও খতনাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, এমন সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই। এমনকি মহানবী সা: এর খতনা হয়েছিল কিনা, হলেও কীভাবে হয়েছিল, তা নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে। অতএব, ধরে নেয়া যায়, ব্যাপারটি পুরোপুরিই সাংস্কৃতিক ও সামাজিক।

তবে ইহুদিদের জন্যে খতনা করার ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা রয়েছে এবং হাজার হাজার বছর ধরে তা অনুসৃত হচ্ছে। তাদের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, “ইশ্বর আব্রাহামকে বলেন তার সকল পুত্র, দাস এবং ছেলেশিশুদের জন্মের আট দিবস পর খতনা করাতে। কোনো বালককে খতনাবিহীন রাখার অর্থ ধর্মীয় বিধান লঙ্ঘন করা।” ইশ্বর ইব্রাহিমের সঙ্গে কথা বলার পর তিনি তাঁর নিজের, পুত্রদের, দাসহ বাড়ির সকল পুরুষ সদস্যদের খতনা করান। আব্রাহামের বয়স তখন ৯৯ বছর (ইসলামী গবেষকদের মতে, ইব্রাহিম আ: যখন নিজের খতনা করান তখন তার বয়স ছিল ৮০ বছর।)

যেকোনো সমাজে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোই যে অবশ্য পালনীয় হয়ে উঠে এর বড়ো একটি প্রমাণ ‘খতনা’। কেউ ইসলামের ফরজ পালন না করেও তার মুসলিম হওয়া নিয়ে সংশয়ে থাকবেন না, কিন্তু যদি কোনো কারণে কারো ‘খতনা’ না হয়ে থাকে, তাহলে তিনি নিজের মুসলমানিত্ব নিয়েই সারাক্ষণ সন্দ্বিগ্ধ থাকবেন। খতনা করে না, এমন ধর্মাবলম্বী কোনো পুরুষের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছাড়া কোনো মুসলিম নারী ‘খতনা’বিহীন মুসলিম স্বামী মেনে নেবেন বলে আমার মনে হয় না; এমনকি খতনাবিহীন ধর্ষকও মেনে না নিয়ে জীবন দেবেন এক বছর আগে যমুনা টিভিতে প্রচারিত এক খবরে আমার এ ধারণা দৃঢ় হয়েছে।

টাঙ্গাইলের ধনবাড়িতে এক হিন্দু ছেলে মুসলিম পরিচয় দিয়ে এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। মেয়েটিকে এক নির্জন বাড়িতে নিয়ে কয়েক বন্ধুসহ ধর্ষণ করে। বন্ধুরা চলে গেলে হিন্দু ছেলেটি আবারও ধর্ষণ করার পর মেয়েটি টের পায় যে ছেলেটি হিন্দু। ছেলেটি তার ধর্মনাশ করেছে বলে চিৎকার শুরু করলে ছেলেটি নিজের জীবন বাঁচাতে মেয়েটিকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালিদের লুঙ্গি খুলে মুসলমানিত্ব যাচাই করত, এখন ভারতে বিজেপি’র চ্যাংড়ারা কাউকে মুসলিম শণাক্ত করতে একই কর্ম করছে। খতনা নিয়ে সবচেয়ে মজার রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি। ফিরোজ খান নুন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে তিনি নাকি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের লোকজন ‘খতনা’ করে না। মাওলানা ভাসানি পল্টনের জনসভায় এর প্রতিবাদে যা বলেছিলেন, তা মোটামুটি এমন: “ফিরোজ খান নুন, তুমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়া দুই দিনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে আসলা, পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়া কইলা, ‘বাঙালিরা খতনা করে না, খতনা করে না,’ তুমি তোমার এত কাজের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের লুঙ্গি উঁচা কইরা কইরা দেখার সময় কখন পাইলা?”

যাহোক, আমাদের সময়ে প্রায় শতভাগে মুসলমানি হাজামরাই সম্পন্ন করেছে। চাচা সম্পর্কের একজন শক্তসমর্থ লোক আমাকে হাজামের মুখোমুখি পিড়িতে বসিয়ে পেছন দিক থেকে দুই হাঁটুর নিচ দিয়ে পা প্রসারিত করে ধরেছেন। হাজাম বাঁশের তৈরি চিমটা দিয়ে আলগা চামড়া টেনে চোখের পলকে ক্ষুর দিয়ে ক্যাচ করে কেটে কর্তিত স্থানে গোবরের ছাই দিয়ে ব্যাণ্ডেজ করে সেটির দুই মাথা কোমরে ফিতার সঙ্গে বেঁধে দিলেন। বিপদ ঘটে পরদিন থেকে। কাটা স্থানে কাপড়ের ঘষায় প্রাণ বের হওয়ার অবস্থা, বয়স এত কম নয় যে বস্ত্রহীন থাকা যায়। ওই যে সেলাই ছাড়া লাল লুঙ্গি, এমন পরিস্থিতিতে সেটিই মোক্ষম বসত্র। কোমরে আটকে ঘা না শুকানো পর্যন্ত লুঙ্গির সামনের অংশ উঁচু করে ধরে রাখতে হয়েছে প্রায় দুই সপ্তাহ।

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রথমবার সার্জনের হাতে আমার দুই ভাগনের খতনা করানো প্রত্যক্ষ করি। তিনি লোকাল অ্যানেসথেশিয়া দেন, আলগা চামড়া একটু একটু করে কাটেন এবং কাটা ও ব্যান্ডেজ বাঁধায় এক একজনের অন্তত আধা ঘন্টা করে সময় লাগে। অ্যানেসথেশিয়ার প্রভাব কেটে গেলে দুই ভাগনের চিৎকার পাষাণ বিদীর্ণ করার মতো ছিল। নিকটজনের জন্যে এমন নির্মম খতনার দৃশ্য দেখা কষ্টকর। এর কয়েক বছর পর যখন সার্জন আমার ছেলের খতনা করেন, তখন আমি সামনে যাইনি। ক্যালিফোর্নিয়ার ডা. ড্যানিয়েল এর প্রক্রিয়া প্রায় অভিন্ন।

ব্যতিক্রম ছিল অ্যানেসথেশিয়া না দেওয়া এবং কাটকাটির সরঞ্জামের আধিক্য। নড়াচড়া রোধ করতে তিনি শিশুর হাত-পা বেল্ট দিয়ে আটকে দিলেন। সেই যে চিৎকার শুরু হলো, প্রায় পনেরো মিনিট পর্যন্ত প্রক্রিয়া চলাকালে মুখের হা আর বন্ধ হয়নি। ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার পর ড্যানিয়েলকে বললাম, তোমার প্রক্রিয়া কষ্টকর। আমাদের গ্রামে এ কাজ মুহূর্তে হয়ে যায়। একজন শক্ত করে ধরে, আরেকজন চোখের পলকে কেটে ফেলে। তিনি হাসলেন, “আমি শুনেছি, উগান্ডায় নাকি অমন করেই খতনা করানো হয়।” তার কাছে উগান্ডা ও বাংলাদেশ অভিন্ন!

advertisement

Posted ১:১৮ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৬ এপ্রিল ২০২৩

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আমরা মরি কেন?
আমরা মরি কেন?

(645 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.