ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ০৭ অক্টোবর ২০২১
নারী প্রগতি শিক্ষা এবং চলা-ফেরার স্বাধীনতার উপর নির্ভর করে অন্য যে কোন চলকের (াধৎরধনষব) চেয়ে বেশী। আফগানিস্তানে মেয়েদের জন্য যখনি শিক্ষার সুযোগ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে তারা প্রশংসনীয়ভাবে প্রমাণ করেছে যে মেধায়, কর্মদক্ষতায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে, নেতৃত্ব প্রদানে তারা সিদ্ধহস্ত । মহিলা উন্নয়ন একটা সম্মানজনক পর্যায়ে উপনীত হওয়ার সন্ধিক্ষণে আল কায়দা এবং দোসর তালিবানরা এতে বিঘ্ন ঘটায় । আফগানিস্থানে নারী উন্নায়নের যে জোয়ার শুরু হয়েছিল তাতে বিপত্তি সাথে সাথেই শুরু হয়।
ধর্মীয় কুপমন্ডতা তথা কুসংস্কার ও অন্ধ সনাতনী বিশ্বাসের কারণে এই যে লিঙ্গ ভিত্তিক অধিকার হরণ, পরিবার, গোত্র ও সমাজে নারী পুরুষে অসাম্য ও বৈষম্য বপন তা দেশটিকে উন্নয়নের সকল নিরিখেই দ্রুত পিছিয়ে দিচ্ছে। অথচ ২০০১ সালে সেপ্টেম্বর দেশের ১১ তারিখে যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তানে আল-কায়দা ও তালিবানদের শাস্তি দেয়ার জন্য যুদ্ধ শুরু করে বেশ কিছু মিত্র দেশ সাথে নিয়ে, তখন প্রেসিডেন্ট বুশ এবং তাঁর ডিফেন্স সেক্রেটারি ঘোষণা করেছিলেন যে আল-কায়দা, ওসামা বিন লাদেন এবং তাদের অনুসারী তালিবানদের নির্মূল না করে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করবেন না ।
কিন্তু এ প্রত্যাশা তাঁর প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে পূরণ হয়নি । তবে, মেয়েদের ও মহিলাদের স্বাধীন ভাবে চলাফেরার অধিকার এ সময়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি হয়েছিল। আফগান জনসাধারণ, বিশেষত নারী সম্প্রদায় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন সমুজ্জ্বল সুন্দর ভবিষ্যতের। ২০০১ সালের পর থেকে ২০ বছর ব্যাপ্তিতে এ স্বপ্ন অনেকাংশে বাস্তবে রূপ নিয়েছে। এ সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের উপস্থিতির হার ছেলেদের সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছিল ।
স্কুল, কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ও মহিলা শিক্ষক প্রচুর সংখ্যায় নিয়োগ লাভ করেন । সরকারী চাকুরী, ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সেবামুলক সংগঠন, বিদেশী দূতাবাস, অনুবাদক হিসেবে কাজ, নার্স , ডাক্তার ইত্যাদি রকমারি পেশা মহিলাদের ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে সফল হয়।
গৃহ বন্দী, পর্দা প্রথায় অবরুদ্ধ নারী স্বাধীনচেতা মহিলা হিসেবে সমাজে স্বীকৃতি পায়, সম্মানের আসনে স্থান পায়। বলাবাহুল্য, পরিবার ও পুরুষদের সহযোগিতা ছাড়া পুরুষ প্রধান সনাতন সমাজে নারী সমাজে নারী স্বাধীনতা ও অধিকার ক্ষেত্রে এহেন প্রগতি সম্ভব হতো না কিছুতেই। শুধু মহিলা উন্নয়নের ক্ষেত্রেই নয় , লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ এখন লিখতে ও পড়তে পারে। জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন ঘটেছে যেমন বেড়েছে মানুষের গড়পড়তা আয়ুষ্কাল ও। শিশু মৃত্যুহার কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা’র প্রত্যক্ষ উদ্যোগে এবং সুনির্দিষ্ট নির্দেশে ওসামা বিন লাদেনের প্রাণ সংহারের পরবর্তীতে আফগানিস্থানে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের যে ছোঁয়া লাগে তাতে সবচেয়ে বেশী লাভবান হয়েছিল নারী সমাজ। পুরুষতান্ত্রিক সামন্ত সমাজে যেখানে ধর্মীয় অপব্যাখ্যার আড়ালে নারীদের ঘরের বাইরে চলাফেরার স্বাধীনতা ছিলই না সেখানে আল-কায়দা এবং তালিবানদের অবর্তমানে আফগানিস্থানে নারীরা সমাজের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে। কিন্তু বিশ্ব বছর পেরুতে না পেরুতেই তাদের জন্য নেমে আসে ঘোর অমাবস্যা।
আলোকজ্জল জীবন প্রণালী মোড় নিতে শুরু করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। তালিবানদের কাবুল দখলের প্রায় সাথে সাথেই নারীদের পর্দা প্রথা পুরোমাত্রায় চালু করার ঘোষনা আসে। নারীদের চাকুরী-বাকুরি করার প্রতি নিষেধাঙ্গা জারী করা হয়। তালিবান সরকারের নিয়োগকৃত কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর গত সেপ্টেম্বর মাসের ২৭ তারিখে এক টুইটার বার্তায় ঘোষণা করেছেন যে সত্যিকারের ইসলামিক পরিবেশ চালু না হওয়া পর্যন্ত মহিলারা শিক্ষাদান করতে পারেন না অর্থাৎ শিক্ষক হিসেবে ক্লাসে উপস্থিত হতে পারবেন না । ছাত্রীরা ও শ্রেণীকক্ষে হাজিরা দিতে পারবেনা । অবশ্য টুইটার বার্তা পরবর্তীতে ডিলিট করে দেওয়া হয়। এ বাঁধা বিপত্তি কাবুল, কান্দাহার সহ আফগানিস্থানের সব জায়গায়ই।
থমকে গেছে নারী প্রগতি । ৯/১১ এ আল কায়দা ও দোসররা নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার হ্যাইজাক করা দুটো যাত্রীবাহী বিমান স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বিধ্বস্ত করে। একই দিনে আরেকটি বিমান পেন্টাগনে ও আঘাত হানে । যুক্তরাষ্ট্র সরকার দোষী সাব্যস্ত করে মোটে ও দেরী করেনি। এ চরম শোকের মাঝে ও প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে প্রেসিডেন্ট বুশ ও তাঁর প্রশাসন যন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলো, তাদের জোট প্রতিহিংসা নিতে তৎপর হয়।
ওসামা বিন লাদেন ও তাঁর আল কায়দা বাহিনী, মোল্লা ওমর ও তালিবান সদস্যদের খুঁজতে পাহাড়, পর্বত, গুহা ইত্যাদি কোন স্থান বাদ দেয়নি । তবে বুশের আমলে মূল হোতা বিন লাদেন’কে পায়নি । আল কায়দা ও দোসর তালিবানরা পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, চীন ও রাশিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন মুসলিম দেশগুলোতে আত্ম গোপন করে । আমেরিকা ও মিত্র বাহিনী অনেককে মেরে ফেলতে ও সক্ষম হয়; বন্দী করে অনেককে যাদের গুয়ান্তেমালা কারাগারে রাখা হয় । বিচারের পুরো প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি।
আফগান যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে সেখানকার শান্তিপ্রিয় লোকজনদের মনে স্বস্তি আসে। বেশী আনন্দিত হয় যুগ যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নানান ধরনের অবহেলা, অবজ্ঞা, নিষ্পেষণের শিকার নারী সম্প্রদায় । মেয়েরা স্কুল, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, নার্সিং, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলে দলে ভর্তি হয়। অভাবিত উন্নতি সাধন করে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। কিন্তু, স্বস্তি, প্রগতির এ উল্লফন বেশী দিন টিকেনি। বিশ বছর পার হতে না হতেই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচন প্রতিশ্রুতি পালনে আমেরিকান সেনা সদস্যদের ফিরিয়ে আনতে শুরু করে।
সাথে সাথেই তালিবানরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। আমেরিকা ও মিত্র দেশের প্রশিক্ষকদের উন্নত মানের প্রশিক্ষণ, আফগান সেনাদের আধুনিক যুদ্ধাস্র ইত্যাদি সুযোগ সুবিধা দেয়া সত্ত্বে ও তালিবানদের হাতে কাবুলের পোতন হলে এবং আমেরিকান সৈন্যরদের অপসারণ করা হলে আফগান সেনা বাহিনী হাওয়া হয়ে মিলিয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট ঘানি ও রাতের আঁধারে পালিয়ে যান। সুশাসনের ২০ বছর শেষ হয়ে তালিবান শাসন শুরু হয় ।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মেয়েরা । এরা আতঙ্কিত এজন্য যে এদের চলাফেরার স্বাধীনতা, শিক্ষার সুযোগ ইত্যাদি সব অর্জনই ভেস্তে যাবে মোল্লাতন্ত্রের পুনরায় আবির্ভাবে। বিশ বছরের সকল অর্জন বিফলে যাবেনা সত্য তবে দেশটি, এর সমাজ, বিশেষত বিকাশমান নারী সম্পদ ও শক্তি থমকে দাড়িয়ে পড়লো ।
Posted ৭:৪৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৭ অক্টোবর ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh