এমাজউদ্দীন আহমদ | বৃহস্পতিবার, ০২ জুলাই ২০২০
দেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা যখন ক্রমবর্ধমান তখন সরকার এ মাসের শুরু থেকেই ছুটি না বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, তা সঠিক হয়নি বলেই মনে করি। এমন বিপর্যয়ের সময় সবকিছু শিথিল করা কতটা দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করেছে- এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। জীবিকার প্রয়োজনে সীমিত পরিসরে সবকিছু চালু করার সরকারের এই ভাবনা যথোপযুক্ত হয়নি বলে সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞ অনেকেই বলেছেন। করোনা দুর্যোগ রোধে সরকার কঠোরভাবে লকডাউন কার্যকর না করে ছুটির ঘোষণা দিয়ে আগেই ভুল করেছিল- এ নিয়েও বিস্তর কথা হয়েছে। এখন ঝুঁকির মধ্যেই করোনাকালে সবকিছু খুলে দিয়ে আরেক দফা ভুল করেছে সরকার- এই বক্তব্য অমূলক নয়। এর মধ্যেই চলছে সরকারি মহলের দোষারোপের রাজনীতি।
এই দুর্যোগকালে এমনটি কাম্য কিংবা প্রত্যাশিত না হলেও আমরা তাই লক্ষ্য করছি। বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের তরফে জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে সরকারের প্রতি বারবার আহ্বান জানালেও তা আমলে তো নেওয়া হয়ইনি, উপরন্তু এরও সমালোচনা হয়েছে কিংবা হচ্ছে অগঠনমূলকভাবে। করোনা পরিস্থিতি সমগ্র বিশ্বচিত্র বদলে দিয়েছে। দেখা দিয়েছে মানবতার চরম বিপর্যয়। উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত দেশ তো বটেই, উন্নত দেশগুলো পর্যন্ত কীভাবে বিপন্ন বিপর্যস্ত হয়ে অনেকটাই করোনার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, তা অস্পষ্ট নয়। কিন্তু সেসব দেশে দুর্যোগকালে আমাদের মতো রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ি নেই বললেই চলে। জাতীয় দুর্যোগে জাতীয় ঐক্যের দৃষ্টান্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে। আমাদের দেশে সরকারি মহলের কাছে বিষয়টি কেন গুরুত্বহীন, তা বোঁধগম্য নয়। রাজনীতি তো দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের স্বার্থেই। যদি তাই হয় তাহলে জাতীয় ঐক্যের বিষয়টি উপেক্ষণীয় কেন? জাতীয় স্বার্থ কিংবা প্রয়োজনে এমন উদ্যোগ নেওয়া কি বাঞ্ছনীয় নয়?
যদি করোনা দুর্যোগে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠত কিংবা গড়ে তোলা যেত, তাহলে এর ইতিবাচক প্রভাব দৃষ্টিগ্রাহ্য হতো বলেই মনে করি। যে যে ক্ষেত্রে অনিয়ম কিংবা ত্র“টি দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে, সেসব নিরসনেও তা বিশেষ ভূমিকা রাখত বলে মনে করি। আমরা বলে থাকি, পরমতসহিষ্ণুতার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশে উদ্যোগী হতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই দাবির অসারতা পদে পদে চোখে পড়ে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের রাজনীতিতে বিরোধী কণ্ঠ আমলেই নেওয়া হয় না। অথচ গণতন্ত্রে সরকারবিরোধী শক্তিশালী কণ্ঠ গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ভুলত্রুটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। অন্যের গঠনমূলক সমালোচনায় ভুলত্রুটি সংশোধনের পথ সৃষ্টি হলেও আমাদের দেশের রাজনীতিতে তা অপাক্সক্তেয়।
করোনা পরিস্থিতি আমাদের দেশে ক্রমেই জটিল হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সমন্বয়হীনতাও। পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা আগে থেকেই বলে আসছেন, সংক্রমণ বৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী ধারা আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকবে। এমতাবস্থায় আমাদের সার্বিক পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে, তা সহজেই অনুমেয়। অর্থাৎ দুর্যোগ আরও প্রকট হবে। এই পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে জাতীয় ঐক্যের প্রাসঙ্গিকতা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি। এ ক্ষেত্রে কোনো কৃতীত্ব নেয়ার বিষয় নেই। সবাই মিলে যূথবদ্ধ প্রয়াস চালিয়ে জীবন রক্ষার তাগিদে জীবনের সম্মিলন ঘটাতে হবে। এ বিষয়ে সরকারপক্ষের উদারতা জরুরি। রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির সময় এখন নয়। এই বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
করোনা দুর্যোগকালে ঘূর্ণিঝড় আম্পান তার ছোবল বসাল। আমাদের পার্র্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজভিটা কলকাতাসহ কয়েকটি জেলা আম্পানের ছোবলে ক্ষতবিক্ষত। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। কেন্দ্রে রয়েছে বিজেপি সরকার। আম্পানের আঘাতের পর লণ্ডভণ্ড পশ্চিমবঙ্গের ক্ষতচিত্র স্বচক্ষে দেখে যাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে রাজ্য সরকারের (পশ্চিমবঙ্গ) মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আহ্বান জানান। মোদি ছুটে আসেন পশ্চিমবঙ্গে। মোদি-মমতা একসঙ্গে মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ক্ষত সারিয়ে তুলতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দেন নরেন্দ্র মোদি। প্রণয়ন করেন কর্মপরিকল্পনা। এটাই হলো গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংস্কৃতি ও সৌন্দর্য।
আমরা কি এমন সংস্কৃতি-সৌন্দর্য রচনা করতে পারি না? অবশ্যই পারি। কিন্তু এ জন্য প্রয়োজন উদার মানসিকতা। তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপির সম্পর্ক সাপে-নেউলে হলেও দুর্যোগ-দুর্বিপাকে এই দু’দলের শীর্ষজনেরা যে ইতিবাচকতা স্থাপন করলেন, তা দৃষ্টান্তযোগ্য। এভাবেই তো গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ ঘটে। আর তা হয় জনকল্যাণের পরিপূরক। আবারও বলি, রাজনীতি যদি হয় জনকল্যাণের অপর নাম এবং গণতন্ত্র যদি হয় সবার উদার মানসিকতার স্তম্ভ ফসল, তাহলে পরস্পর বিদ্বেষের পথ ত্যাগ করে ঐকমত্যের সড়ক নির্মাণ করতে হবে। বহু মত-পথ গণতন্ত্রে থাকবে; এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু যে কোনো রাজনৈতিক বিষয় কিংবা ইস্যুতে এক কাতারে দাঁড়ানোই তো গণতান্ত্রিক রাজনীতির সৌন্দর্য।
রাজনীতির তুলনামূলক বিশ্নেষণে এই বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, যতই বলা হোক না কেন- আমরা বিকশিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছি; তা প্রকৃতপক্ষে অমূলক। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কাঠামোয় প্রাণের সঞ্চার হয়নি- এটাই সত্য। বলা হয়, গণতন্ত্র ‘সম্মতির শাসনব্যবস্থা’, ‘সম্মতিভিত্তিক সরকার’। এর পক্ষে দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই গণতন্ত্রের অবস্থা ভালো না। কর্তৃত্ববাদি শাসনব্যবস্থা তো গণতন্ত্রস্বীকৃত নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংরক্ষণে সমাজে গড়ে তুলতে হবে গণতান্ত্রিক মন। এ জন্য গণতান্ত্রিক কাঠামোই যথেষ্ট নয়। এই কাঠামোর অভ্যন্তরে স্পন্দিত হতে হবে গণতান্ত্রিক অন্তঃকরণ। ব্যক্তি পর্যায়ে সামাজিক পর্যায়ে, রাজনৈতিক দলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত থাকলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রাণবন্ত হয়।
করোনা দুর্যোগ ফের আমাদের সামনে এই বিষয়গুলো তুলে ধরেছে। করোনা দুর্যোগ নিশ্চয় একদিন কেটে যাবে। মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসই এই অন্ধকার দূর করবে। কিন্তু এরই মধ্যে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে কিংবা আরও হবে, তা এত সহজে সেরে যাবে না। সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। অপ্রিয় হলেও তাই সত্য। এই কঠিন সময়ের মুখোমুখির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন যূথবদ্ধ প্রয়াস, সম্মিলিত চিন্তাশক্তির প্রকাশ। এ জন্য চাই জাতীয় ঐক্য। ব্যক্তি বা দলের প্রাধান্যের পরিবর্তে দরকার সম্মিলিত প্রাধান্য। এই সম্মিলিত প্রাধান্যই আমাদের মুক্তির পথ সৃষ্টি করতে পারে; সহজ করে দিতে পারে। অনিয়ম, অস্বচ্ছতা দূর করে নিয়মতান্ত্রিকতা ও স্বচ্ছতার পথ সুগম করতে পারে, যার সুফল ভোগ করবেন ভুক্তভোগীরা। এই কঠিন সময়ে কিংবা দুঃসময়ে এর সারসত্য যেন আমরা ভুলে না যাই। সংকটে ঐক্যই বড় শক্তি।
এই সত্য মনে রেখে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সবাইকে একত্র হয়ে কাজ করতে হবে। যদি এই পরিস্থিতিতেও সরকার একলা চলো নীতি অনুসরণ করে চলে, তাহলে শুধু জনভোগান্তিই বাড়বে না; আরও কিছু সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর না করে যাদের জনসম্পৃক্ততা রয়েছে অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় করে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে। আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি বটে, কিন্তু বড়মাপের গণতন্ত্র চর্চা আমরা এখনও করতে পারছি না। সরকার ও সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি আমলে রাখলেই মঙ্গল। চলতি পথে যদি সংযুক্ত হয় জাতীয় সেবা আর ধীশক্তি, তাহলে এর ইতিবাচকতা অবশ্যই আশা করা যায়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী; সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Posted ১১:৫০ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০২ জুলাই ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh