ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২১
গণতন্ত্রকে জীবন , সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে লালন পালনের কারণেই আমেরিকা সারা বিশ্বে সমাদৃত , সম্মানীয় এবং অনুকরণীয়। ২৪৪ বছর হলো আমেরিকা স্বাধীন হয়েছে । ১৭৭৬ সালের ৭ জুনে ভার্জিনিয়ার রিচার্ড লী প্রথম স্বাধীনতার ডাক দেন । ব্রিটেনের রাজা তখন তৃতীয় জর্জ । তিনি এ আহ্বানে সাড়া না দিলে থমাস জেফারসন ও জন অ্যাডামস স্বাধীনতা ঘোষণার একটি খসড়া দলিল প্রণয়ন করেন যা ১৭৭৬ সালের জুলাই মাসের ৪ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয় এবং ২ দিন পর ফেনসালভেনিয়া ইভনিং পোস্ট পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় । রেভলুশনারী ওয়ার সহ নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ১৭৮৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্যারিস চুক্তি সম্পাদনের ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে । ১৭৮৭ সালে ‘কনস্টিটিউশন অফ দি ইউনাইটেড স্টেটস’ প্রণীত হয় এবং ১৭৮৯ সালের ৩০ এপ্রিলে বাস্তবায়ন শুরু হয়। প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োজিত হন জর্জ ওয়াশিংটন। স্বাধীন আমেরিকাকে পরিচালনা করা অত্যন্ত চেলেঞ্জিং কাজ ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে আমেরিকার আদি অধিবাসী এবং কালোদের অংশ গ্রহণ কোর্টে দেওয়া হয়নি । গৃহ যুদ্ধ শুরু হতে খুব দেরী হয়নি। বর্ণ বিদ্বেষ, ক্রীতদাস প্রথা চালু রাখা মূলত এ দু কারণে শুরু হওয়া গৃহ যুদ্ধ দীর্ঘদিন চলতে থাকে। তবে , বিনির্মাতাদের নিরলস ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় হাজারো ঘাত- প্রতিঘাত সামাল দিয়ে দেশটি পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী ও সম্পদশালী দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে ঠিকে আছে।
আমেরিকাই একমাত্র দেশ যেখানে আদর্শ, মূল্যবোধ হিসেবে তো বটেই, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রধানতম হাতিয়ার হলো গনতন্ত্র। একে সযত্নে সুরক্ষার জন্য এন্তার সংগঠন, রাষ্ট্রের প্রতিটি ধাপে, পর্যায়ে। সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে নানা রক্ষাকবজ, নানান প্রতিষ্ঠান । জবাবদিহিতার ব্যবস্থা পদে পদে । এবার ব্যক্তিস্বাধীনতা যেমন অমূল্য, অন্যের অধিকার, চলাফেরার , কথাবলার তথা মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও অতি মূল্যবান। এগুলো সবই গণতান্ত্রিক মুল্যবোধের স্ফুরণ, বিকাশ ও দৃঢ়ভাবে মণ মানসে গ্রন্থনের মাধ্যম । প্রাতিষ্ঠানিক যে সব কাঠামো সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে সুসংহত করে জনকল্যাণে , দেশের আভ্যন্তরীন ও আন্তর্জাতিক বলয়ে কল্যাণমুখী সম্পর্ক সংস্থাপনে যা নিশ্চয়ই হবে গনতান্রিক মূল্যবোধ থেকে উৎসারিত তা সযত্নে লালন , রক্ষা ও চর্চা করেই দেশটি এতদিন পর্যন্ত বিশ্বে সর্বসেরা উদার গণতান্ত্রিক, মুক্ত বাজার অর্থনীতির দেশ হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল। বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্র কঠিন সমস্যায় নিপতিত হয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্র্যাম্পের ব্যক্তিগত উদগ্র ক্ষমতা লিপ্সার কারণে । যে দেশে চরম বর্ণ বৈষম্য, গৃহযুদ্ধ , জিম ক্রু’র প্রেতাত্মা এবং তার নির্বোধ অনুকরণে বিভিন্ন ধরণের সামাজিক অন্যায়, অনিয়ম, অনাচার অব্যাহত আছে সত্য তবে আইনের শাসনের দৃঢ় ভিত্তিমূলের কারণে এসব অপ্রতিহত ভাবে সীমা লংঘন করে অবাধ হতে পারেনি । ত্রুম্প ২০১৬ সালে প্রশ্নবিদ্ধ কৌশলে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিগত ৪ বছরে গণতন্ত্র এ দেশে পদদলিত হচ্ছে হামেশাই ।
ব্যবসায়িক লালসা চাতুর্যের কাছে জনগণের মঙ্গলের প্রশ্নটি বারবার ধাক্কা খাচ্ছে। বিশুদ্ধু বায়ু , সুপেয় পানির ভাণ্ডারে তৈল সরবরাহের পাইপলাইন নির্মাণের যে কাজটি জনতার আন্দোলন ও দাবীর মুখে স্থগিত করা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়ে সেটি বাতিল করে তেল শিল্পের কারটেল ও ব্যবসায়ীদের কাছে দীর্ঘ মেয়াদী ইজারা দেয়া হয়েছে । এদিকে , যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত জোরেশোরে রাশিয়া এবং জার্মানীর জৌথ উদ্যোগে নরড স্টীরম-২ (North Stream) প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করছে । মূলত বাণিজ্যিক কারণেই ৯০% বেশীর ভাগ সম্পন্ন কয়লা ও নিউক্লিয়ার শক্তির বিকল্প হিসেবে গ্যাস ব্যবহারের উদ্যোগটি নস্যাৎ কোর্টে চাচ্ছে । এটি সমন হয়ে চালু হলে যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপে তরলায়িত গ্যাস রপ্তানি বাণিজ্যের সম্ভাবনা অনেকটা কমে যাবে। তবে, প্রেসিডেন্ট ট্র্যাম্পের এ উদ্যোগে দেশপ্রেমের আদর্শ থেকে তৈল ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও কারটেলের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে এমন মনে করার অনেক কারণ আছে।
প্রেসিডেন্ট ট্র্যাম্পের কর্মকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের বহুমাত্রিক অনিষ্ট হয়ে গেল বা এখনো হচ্ছে । প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে স্বচ্ছতার ব্যাপারে প্রশ্ন অনেকগুলো কেস করে ও বারবার হেরে যাওয়ার পরও জর্জিয়া সহ আরও পাচটি ষ্টেটের প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনের ফলাফল মেনে না নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট সহ অন্যান্য পর্যায়ে মামলা করেছে ; ষ্টেট ইলেকশন বোর্ড সারটিফাই করার পর ও বারবার আপত্তি দিয়ে , বিবৃতি দিয়ে ও বক্তব্য রেখে আইনসিদ্ধ নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে চেষ্টা করে বিফল হয়ে তাঁর অতি উগ্র সমর্থকদের জানুয়ারী ৬ তারিখে ফলাফল সারটিফাই করা যাতে সম্ভব না হয় সে উদ্দেশ্যে সরাসরি ষড়যন্ত্র মূলক উস্কানি দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্র্যাম্প রায়ট বাধানোর অপচেষ্টা করেন।
কংগ্রেস অধিবেশন অবশ্য এ রকম নজিরবিহীন হুমকি , এমনকি প্রাণহানি হতে পারে এমন সম্ভাবনার মুখে ও ফলাফল প্রত্যয়ন করে বৈধতা দেয় । উল্লেখ্য যে এ রায়টে একজন পুলিশ সহ পাঁচ জন প্রাণ হারায় । কেপিটল বিল্ডিং , আইন প্রণেতাদের হল ও কক্ষসমূহ ভাংচুর করা হয় , আসবাবপত্র , দলিল দস্তাবেজ লুটপাট করা হয় । সবকিছুই প্রেসিদেতের প্রত্যক্ষ মদদে করা হয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহ সকল মহলই মনে করে । ডেমোক্রেসি সমুন্নত রাখার সুমহান দায়িত্বে নিয়োজিত পবিত্র প্রতিষ্ঠানকে এভাবে ভায়োলেট করার নজির গণতন্ত্রের ধারক বাহক দেশটিতে এই প্রথম । আশা করা যায় প্রেসিডেন্ট ট্র্যাম্পের বিদায়ের সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সকল স্তরের , পর্যায়ের মানুষের সম্মিলিত চেষ্টায় গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও বোধ নতুন শক্তিতে অগ্রসরমান হবে, ট্র্যাম্প ও তার প্রেতাত্মা চিরতরে নির্বাসিত হবে স্বপ্ন পূরণের দেশটি থেকে।
Posted ৮:৩৮ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh