বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

বৈরুত এবং একটি আহত আত্মার আত্মকথন

ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ   |   বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট ২০২০

বৈরুত এবং একটি আহত আত্মার আত্মকথন

বৈরুতকে নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি। ১৯৭৩ সালের আগষ্ট মাসে, খুব সম্ভবত ১৬ তারিখে আমরা সাত জন বাংলাদেশী যুক্তরাষ্ট্র সরকারের (ইউএসএআইডি) বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুত, লেবাননে আসি। বিমান বন্দরে অবতরণ করার সময়ে ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশি দেখে বিমোহিত হয়ে যাই। নামতেই দেখি প্লাকার্ড হাতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অভ্যর্থনা করতে দাঁডিয়ে আছে প্রতিনিধি। সাথে দু’জন বাংলাদেশী বড় ভাই ও ছিলেন। প্রথমবারের মতো বিদেশ যাত্রা তাই স্বদেশীদের দেখে আশ্বস্ত বোধ করি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানালেন দু’ঘন্টার মধ্যে আমাদের ইংলিশ প্রফিসিয়েন্সি টেষ্ট বা ইএলটিসি দিতে হবে। শুনে অনেকেই বেশ ঘাবডে গেলেন। যাই হোক, পূর্ব থেকেই ঠিক করা এপার্টমেন্টে পৌঁছলাম। নতুন আগত তিনজন, মফিজ (অর্থনীতির অধ্যাপক) হযরত আলী (বার্ড) ও আমাকে একটি কক্ষ দেয়া হলো। চা- নাস্তা খেয়ে ফিনফিনে পাজামা -পাঞ্জাবী পরে ছুটলাম বড় দুইভাই, ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ মরতুফা ও মন্্জুর মোর্শেদের সাথে সাগর আর বীচ দেখতে। পড়ন্ত বিকেলে ভূমধ্যসাগরের বিসৃত জলরাশি আর বিকিনি পরিহিত অনিন্দ সুন্দরী লেবানিজ মেয়েদের দেখে বিমোহিত হয়েছিলাম। আশেপাশে লোকজন যে আমাদের নিয়ে মজা করছিল খেয়ালই করিনি।

খুব সম্ভবত মন্জুর মোর্শেদ ভাইয়ের মৃদু ধাক্কায় সম্বিত ফিরেছিল। বল্লেন, এক আমাদের পাজামা-পাঞ্জাবী লোকজন হাসছে কারণ এগুলো এদের চোখে রাতে শোয়ার পোষাক; দুই, আমাদের ইংরেজী দক্ষতা জ্ঞানের পরীক্ষার শুরুর মাত্র ২০ মিনিট সময় বাকী ; তিন, বীচ ও সমুদ্র অবলোকন ও উপভোগের ঢের সময় পাব কারণ যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছি এর প্রাইভেট বীচটি বৈরুতে শ্রেষ্ট বীচগুলোর অন্যতম। তড়িঘড়ি করে এপার্টমেন্টে গিয়ে প্যান্ট- শার্ট পড়ে জীবনে দেখা সুন্দরতম ক্যাম্পাসে উপস্হিত হলাম। গেটেই ছবি তুলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আইডি কার্ড দিলে পরীক্ষার হলে এসকোর্ড করা হলো। পরীক্ষা দিলাম। পরের দিনই স্কোর দেয়া হলো। আমরা দু’জন পাশ করেছি আর বাকীরা একসপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষা দেবে। ফেল করলেও এক সেমিষ্টার শুধু ইংরেজী শেখার ক্লাসই করতে হবে। এ পর্ব শেষ হলে সন্ধ্যেয় নবাগতদের রিসেপশন পার্টি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের সৌজন্যে এ পার্টি ছিল খুবই জাঁকজমকপূর্ণ। বেশীরভাগ নবাগত ছাত্র-ছাত্রী যার যার জাতীয় পোষাক পরে আসলে ও আমরা বাংলাদেশীরা প্যান্ট-শার্ট বা স্যুট, মহিলারা শাড়ী পড়ে গিয়েছলাম। বড় ভাইদের পরামর্শ মেনে লুঙ্গী- পাঞ্জাবি পরিনি যদিও এজন্য একরকম তৈরীই ছিলাম। হরেক রকম খাওয়া- দাওয়ার সাথে সাথে পরিচিতি পর্ব চলছিল।


আমাকে সংক্ষেপে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর বলতে হয়েছিল। হাততালি পেয়েছিলাম প্রচুর। পাকিস্তানী ছাত্র-ছাত্রী কেউ বক্তব্য রাখেনি। পরে শুনেছি আমার বক্তব্যে নাকি তারা দারুণভাবে গোস্বান্বিত হয়েছিল। একাত্তরের হত্যাকাণ্ড, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জন, তেলিয়াপাডার কাছে দক্ষিণ সুরমায় আমার সাত-আটজন আত্মীয়কে মসজিদে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা, আমাদের বাড়ীর সকলের কিছুটা ভাটি অঞ্চলে ছোট বোনের শ্বশুডালয়ে পলায়ন ও আশ্রয় নেয়া সবই এই তেয়াত্তরে স্মৃতিতে জ্বল জ্বল করে ভাসছিল। নিজের প্রতি ধিক্কার বোধ ও বোধ করি আবেগময় হতে কাজ করেছিল। একাত্তরে আগরতলা গিয়েও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পারিনি এ বেদনাবোধ থেকেই নিজেকে আজীবনই অপরাধী মনে হয়েছে। আমার খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু ও গুলোর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠী আব্দুল কুদ্দুস মাখন একরকম জোর করেই আমাকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। তার যুক্তি ছিলো আমি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিলে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত আমার সিএসপি ভাই নিশ্চিত ভাবে অসুবিধেয় পরবেন। তাছাড়া, আমি যেহেতু ছাত্র ইউনিয়নের একটি বিশেষ অংশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংপৃক্ত ছিলাম, তখোনকার সময়ে অগোছালো পর্যায়ে থাকা মুক্তিবাহিনী সংগঠনে আমার অসুবিধে হতে পারে। যুক্তিগুলোর সারবত্তা অনুধাবন করে আমি ধর্মঘর সীমান্ত দিয়ে গ্রামের বাড়ীতে চলে আসি। এর দু’চারদিনের মধ্যেই কিছু সংখ্যক রাজাকার আমাদের বাড়িতে হানা দেয় এবং আমার মায়ের একটি পালিত খাসী নিয়ে যায়।

তাছাড়া, লিচু গাছ থেকে যেনতেন ভাবে পাকা লিচু পাড়তে শুরু করে। আমি ডাল না ভেঙ্গে পাড়তে বল্লে তারা আমাকে ধরে নিয়ে যেতে চায়। আমার বড় ভাই (মরহুম) মোহাম্মদ আলাউদ্দিন (ডাক্তার সাহেব) ও গ্রামের লোকজনের আকুল অনুরোধ ও অনেক মানুষের সমাগম দেখে রাজাকারর আমাকে ছেড়ে দেয়। এ ঘটনার পর বাডীতে থাকা নিরাপদ নয় দেখে পাঁয়ে হেটে নাসিরনগর হয়ে ব্রাক্ষণবাডিয়া পৌঁছি এবং সেখান থেকে ট্রেণে ঢাকা পৌঁছি। সমন্বিত পল্লীউন্নয়ন কর্মসূচীতে আমার কাজে যোগদান করতে যাই অনেকট ভয়ে ভয়ে কারণ প্রায় দু’মাসের মতোন কাজে অনুপস্থিত ছিলাম। সে সময় কর্মসূচীর নির্বাহী পরিচালক (পরবর্তীতে মহাপরিচালক) ছিলেন জনাব এম. মোকাম্মেল হক। তাকে সব খুলে বললে তিনি দিরুক্তি না করে আমাকে যোগদান করতে দিতে রাজী হন। সেখানে চাকুরীরত থাকাকালে তিনি মনোনয়ন দিলে মন্ত্রণালয় বৈরুতে উচ্চশিক্ষার্থে যাওয়ার মনোনয়ন অনুমোদন করে। আমি ও বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী থেকে জনাব হযরত আলী (প্রয়াত) লোকপ্রশাসন বিষয়ে মাষ্টার্স প্রোগ্রামে অধ্যয়নের জন্য মনোনীত হয়ে ছিলাম। লেবাননে গৃহযুদ্ধের কারণে ডিগ্রী সম্পন্ন করতে আমার দু’বছরের ও অধিক সময় লেগে য়ায়। বেশ কয়েক বার নিরাপত্তা প্রশ্ন বিবেচনায় আমাদের বৈরুত থেকে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এ অবস্থা আমার জন্য ভালোই হয়েছিল কারণ আমি এমনি এক সুযোগে ১৯৭৫ সালের আগষ্ট মাসের ৮ তারিখে বিয়ে করে ফেলি। আমার ভাই মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের এ সময়েই বোষ্টন ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার তারিখ নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল বিধায় খুবই তাডাহুডোর মধ্যেই বিয়ের সমুদয় কাজ সম্পন্ন করতে হয়েছিল। আমরা নবদম্পতি কক্সবাজারে মধুচন্দিমা যাপন করে ঢাকায় ভাইয়ের বাসায় ফিরে আসার পরের দিন ভোর রাতে বঙ্গবন্ধু হত্যার মতো হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে। এবারে বৈরুত নেমে ট্যাক্সিতে ওঠেই যে প্রশ্নটি শুনতে হলো তা হলো তোমরা তোমাদের জাতির পিতাকে মেরে ফেললে কেনো?
(চলবে) – লং আই ল্যান্ড, আগস্ট ১১, ২০২০


advertisement

Posted ৭:৫৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট ২০২০

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

গল্প : দুই বোন
গল্প : দুই বোন

(6238 বার পঠিত)

স্মরণে যাতনা
স্মরণে যাতনা

(1303 বার পঠিত)

মানব পাচার কেন
মানব পাচার কেন

(1147 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.