ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২০
(দ্বিতীয় পর্ব) : প্রথম পর্বে প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের এক মহা অত্যাচারী সম্রাট এবং আধুনিক সময়ের এক প্রেসিডেন্টের স্বেচ্ছাচারিতার বিবরণ ও বিশ্লেষণ সংক্ষেপে বিধৃত করা হয়েছে। বর্তমান পর্বে মধ্যযুগের একজন রাজা ও প্রসঙ্গক্রমে এক বা একাধিক ধর্মযাজকের কাহিনী তুলে ধরা হবে। তারা মধ্যযুগের ইউরোপ তথা সে সময়ে প্রচলিত খ্রিস্টান ধর্মের, প্রচলিত বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও অনুশাসনের প্রতি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনাচারে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। সময়টি ছিল জেরুজালেম দখল নিয়ে মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়া দুইশত বছরের ও বেশী সময় ধরে চলতে থাকা তথাকথিত ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডের শেষ পর্যায়ের। পবিত্র নগরী ও বেশীর ভাগ অধিকৃত অঞ্চল ক্রীস্টানদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার প্রাক্বালে যে অরাজকতা ও শোচনীয় অবস্থা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হয়েছিল তার পটভূমিতে রাজন্যবর্গ, প্রধান ধর্মযাজক এবং তাদের কুশীলবরা গভীর ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পরেন। লোভ , লালসা, অর্থ ও ক্ষমতার লিপ্সা তাদের এমন অমানুষ করে তোলে যে ইতিহাসে তাদের স্মরণ করা হয় ধিক্কার জানিয়ে। ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ চতুর্থ এবং পোপ ক্লিমেন্ট ফিফথ মূলত এ দু’জনের ষড়যন্ত্র, খল অভিসন্ধি ও দুষ্কৃতি নিয়ে এ কাহিনী হলে ও অনেক পার্শ্ব চরিত্র ও ঘটনা এতে আসবে।
স্মরণ করা যেতে পারে যে পোপ আরবান দ্বিতীয় রোমভিত্তিক চার্চের ক্ষমতার বলয় বিস্তৃত ও সুদৃঢ় করার মূল উদ্দেশ্য সামনে রেখে ধর্মযুদ্ধের অবতারণা করেন। তবে, পোপ গ্রেগরি রোমান চার্চের ক্ষমতা এতই বৃদ্ধি করেন যে রাজা, যুবরাজ এবং অন্যান্য সম্ভ্রান্তদের বিশপ এবং ‘এবট’ নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে যান এই জুক্যিতে যে ঈশ্বরের সরাসরি প্রতিনিধি হিসেবে দুনিয়াতে একমাত্র পোপেরই ধর্মীয় পদে নিয়োগ দেয়ার অধিকার আছে, অন্য কারোরই নেই। রাজা রাজরা , এমনকি রোমান সাম্রাজ্যের অধিপতি হেনরিকে ও নিত্য নতুন ধর্মীয় ডিক্রী ঘোষণার মাধ্যমে হাজার হাজার হেক্টর দেবোত্তর জম্বির এয়ের একটা অংশ থেকে বঞ্চিত করা হয়। স্থানীয় পর্যায়ের ধর্মযাজকের উপর তাদের কোন কতৃত্ব বলতে গেলে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এ ভাবে খ্রিস্টান ইউরোপের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভূমি ও এলাকার উপর পোপের সরাসরি একনায়কতান্ত্রিক কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০ বছর বয়স্ক রোমান অধিপতি সম্রাট হেনরি এ ডিক্রী প্রত্যাখ্যান করলে পোপ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন এ মর্মে ধর্মীয় নির্দেশ জারি করেন এবং যতদিন না তিনি মাপ করবেন ততদিন কেউ সম্রাটের নির্দেশ মানলে একঘরে করা হবে। প্রজারা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলে হেনরি নগ্ন পায়ে প্রচণ্ড শীতে পুরো এক রাত অপেক্ষা করলে তবেই পোপে তাঁকে সাক্ষাত দেন এবং শাস্তি তুলে নেন। তবে, হেনরি প্রতিশোধের সুযোগ খুঁজতে থাকেন। জার্মানির ও সম্রাট হওয়ার সুবাদে তিনি সেখানে গিয়ে অনুগত সেনা বাহিনী নিয়ে ইতালি পুনর্দখল করেন। পোপে পলায়ন করে কাস্তেল সান্ত এঞ্জেলো দুর্গে আশ্রয় নেন। নরমানরা তাঁকে উদ্ধার করে সালেরোতে অন্তরীন করে রাখে এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তবে, তিনি যে নজির রেখে যান তাঁর পরম্পরায় শাসক এবং চার্চের মধ্যেকার বিরোধ চলতেই থাকে। মধ্যযুগের ইউরোপের ইতিহাসের একটা উল্লেখযোগ্য সময় (৭৫ বছরের ও বেশী)পোপদের ফ্রাঞ্চেই থাকতে হয়েছে, রোমে থাকার মত পরিস্থিতি তখনো পুনঃসৃষ্টি হয় নি।
ক্লিমেন্ট (পঞ্চম) অত্যন্ত বুদ্ধিমান পোপে ছিলেন। বৈষয়িক বুদ্ধিতে তাঁর মত পরিপক্ষ দ্বিতীয় কোন ধর্মযাজক মধ্য যুগে রোমান চার্চে সম্ভবত আর কেউ ছিলেন না। রোমে পদার্পণের সম্ভাবনা নাই দেখে তিনি প্রুভেঞ্চের এভিননে জমি কিনে পাপাল প্যালেস তৈরি করেন। উদ্দেশ্য , এখান থেকে তাঁর ধর্মীয় সাম্রাজ্য পরিচালনা করবে। রাজা ফিলিপের আশ্রয়ে ভীতু স্বভাবের পোপ তাঁর ধর্মীয় ব্যবসা কারো তোয়াক্কা না করে চালিয়ে যাবেন। চার্চের ট্রেজারি বৃদ্ধির জন্য বেশুমার মেরিটস এবং আশীর্বাদ যা যিশু খ্রিষ্টের উপর বরষন করেছেন তার অংশীদার/হলি মাদার হলেন পোপ। সদয় হয়ে এ সব কৃপা বিক্রি করে পোপ ক্লিমেন্ট পঞ্চম অভূতপূর্ব বিত্তের মালিক হন অচিরেই। তাঁর ভাণ্ডারে বিক্রীর মত পুরস্কার, তিরস্কার, বিভিন্ন ধরনের পাপ ও শাস্তি মোচন ইত্যাদির জন্য মূল্য সদাই মজুত থাকত। একজন ঐতিহাসিকের মতে, তাঁর সম্পদ, বৈভব ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাত্রা ছিল চোখ ধাঁধানোর মত । অন্যদিকে পোপের আশ্রয়দাতা, জীবনের নিরাপত্তা দাতা কিং ফিলিপ ছিলেন দেনার দায়ে পরযুদস্ত। রাজ্য চালানোর জন্য, সেনাবাহিনী প্রতিপালন, আরও একটি ক্রুসেডের জন্য, ইতালি ও ইংল্যান্ডের সাথে বছরের পর যুদ্ধ এবং দেনা, বিশেষত নাইট টেম্পলারদের পাওনা, পরিশোধের জন্য তার অনেক টাকার প্রয়োজন ছিল। পোপের সম্পদের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি থাকলে ও তাঁকে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য না ক্ষেপানোই শ্রেয় মণে করে অন্যসব রাস্তা খুঁজতে লেগে যান।
কুশলী আমলা খাজাঞ্চিখানার দায়িত্বে নিয়োজিত দ্য নগাররেতের পরামর্শ মোতাবেক রাজ্যের সমস্ত নিরীহ ইহুদীদের ১৩০৬ সালের ২২ শে জুলাই অ্যারেস্ট করে একই দিনে কারারুদ্ধ করা হয়। তাদের সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে নিলামে দিয়ে রাজার ভাণ্ডারে জমা করা হয়। সুদর্শন রাজা তাঁর একসময়ের সমকামের সঙ্গী ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডের ছেলের সাথে তাঁর মেয়ের বিয়ের মাধ্যমে সখ্যতা পুনঃস্থাপন করে যুদ্ধের অবসান টানেন। বিভিন্ন ধরণের ছলাকলা, অপবাদ, জোরজবরদস্তি প্রয়োগ করে কিং ফিলিপ পোপ ক্লিমেন্ট পঞ্চমকে তার সমস্ত কোথা মেনে চলতে বাধ্য করেন। অন্যথা করলে তাঁর সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত করবেন তাও একান্ত বৈঠকে বলে দেন পরিষ্কার ভাষায়। সবদিক গুছিয়ে রাজা ফিলিপ ফ্রাই ডে অক্টোবর ১৩, ১৩০৭ সালে ফ্রান্সের সমস্ত নাইট টেম্পলারদের প্যারিস টেম্পল থেকে তাদের গ্র্যান্ড মাষ্টার জ্যাকো দ্য মলে সহ গ্রেপ্তার করান। দুর্বল চিত্তের পোপকে দিয়ে তাঁর আশ্রিত কারারুদ্ধ সমস্ত নাইট টেম্পলার ও তাদের গ্র্যান্ড মাষ্টারকে বানোয়াট সব দোষে গুরুতর অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়। ১৩১১ সালে শুরু হওয়া মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্রে ভরপুর নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৩১৪ সালে ফ্রান্সের নিরাপরাধ নাইট টেম্পলার ও তাদের গ্র্যান্ড মাষ্টারকে নিষ্ঠুর ভাবে আগুনে পুড়িয়ে মারার হত্যা করার মাধ্যমে। যে গ্র্যান্ড মাষ্টার কিং ফিলিপের বোন ও মেয়ের বিয়ের জন্য রাজার অনুরোধে টেম্পলারদের গচ্ছিত টাকা ধার দিয়েছিলেন তারই হীন ষড়যন্ত্রে তাঁকে খ্রিস্টান জগতের স্বনামখ্যাত নাইট টেম্পলারদের সহ জীবন দিতে হলো। এর এক বছরের মাথায় কিং ফিলিপ এবং পোপ ক্লিমেন্ট ও মারা যান। জনশ্রুতি , শেষনিঃশ্বাস তাগের পূর্বে গ্র্যান্ড মাষ্টার এমনই অভিশাপ দিয়েছিলেন। চলবে
Posted ১১:৫৫ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh